করোনাজয়ী জাহিদের ঈদ আনন্দ

ঈদের আনন্দে সন্তানদের সঙ্গে জাহিদ হোসেন। ছবি: সংগৃহীত
ঈদের আনন্দে সন্তানদের সঙ্গে জাহিদ হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

এই জীবন তো একদিন চলতে চলতে থেমে যাবে, কেউ তো জানে না কে কোথায় রবে...চলতে চলতেই থেমে যায় জীবন আবার সেই থেমে যাওয়া জীবন থেকেই কোন কোন জীবন ফিরে আসে, প্রাণ পায় আবার এই ধরনীতে।

কোভিড–১৯–এ এখন সারা বিশ্ব থেমে গেছে। ভ্যাকসিন, ওষুধ, অক্সিজেন, ভেন্টিলেটর কত কিছুরই জন্য মানুষ মরিয়া। আবার অনেকে করোনামুক্ত হয়ে ফিরে আসছেন মৃত্যঞ্জয়ী হয়ে।

কুমিল্লা সদরের জাহিদ হোসেন (৪১) ২০০০ সাল থেকে ইতালিতে আছে। প্রবাসজীবনের শুরু থেকেই চাকরি করছেন। ইতালির উত্তরাঞ্চলের বেরগামোতে দুই ছেলে, এক মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে সংসার। গত ২৪ মে ঈদের রোদ ঝলমলে দিনে নামাজ পড়েছেন বাসায়। এবার তিনি সব রোজাও করতে পেরেছিলেন। অথচ করোনাভাইরাসের আক্রান্ত হয়ে নিভেই যেতে বসেছিল জীবনপ্রদীপ। আর দেখা হতো না প্রিয় সন্তানদের মুখ। ওদের ভালো মানুষ করে গড়ে তোলার জন্য যে স্বপ্ন বুনে চলেছিলেন থেমে যেত মাঝপথেই।

কেমন ঈদ কাটালেন, প্রশ্নে জাহিদ হোসেন ফিরে গেলেন সেই সময়ে। ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রচণ্ড জ্বর আসে। খেতে থাকেন অ্যান্টিবায়োটিক, তবে তা চিকিৎসকেরই পরামর্শে, চলে যেতে থাকে সময়। ভয়, শঙ্কা আর প্রচণ্ড শারীরিক দুর্বলতায় ততক্ষণে জেঁকে বসেছে। জ্বরের ১৪ দিনের মাথায় জ্ঞান হারান, এক বন্ধুকে নিয়ে জরুরি বিভাগে আসেন স্থানীয় হাসপাতালের। গিয়ে দেখেন হাসপাতালের চেহারাই যেন পাল্টে গেছে। চারপাশের মানুষের চোখে ভয় আর চিকিৎসক-নার্সদের যে কি দৌড়া দৌড়ি, যেন একটা সেকেন্ড ও তারা জীবনের বিনিময়ে সেবার জন্য হারাতে চান না। কিন্তু বেরগামো ও মিলানোতে কোনো হাসপাতালে জায়গা ছিল না। ঝড়ের বেগে অ্যাম্বুলেন্স ছুটে যায় ব্রেসিয়ার পলিতে। অবস্থা এতটা খারাপ ছিল যে সেখানে পৌঁছানোর পর বেশি কিছু মনে করতে পারেননি। যন্ত্রণায় জ্ঞান চলে যায়। এরপর যখন জ্ঞান ফিরে ততক্ষণে ৪৮ ঘণ্টারও বেশি সময় পর্যন্ত যুদ্ধ করেছেন। তাকিয়ে দেখেন সেই প্রিয় মুখগুলো যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর ভালোবাসায় এই রোগকে কিছু মানুষ জয় করেছে। চিকিৎসক বললেন, ‘জাহিদ অনেক সাহসী, ওই অবস্থা থেকে ফিরে আসা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না।’

১৩ মার্চের দিকে ভালো হতে থাকেন। ১৬ মার্চে ভালোবাসার বাড়িতে আসেন। ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টিনে থাকেন। এর মধ্যে হাসপাতাল থেকে দুবার রক্ত পরীক্ষা করা হয়। দুবারই নেগেটিভ পাওয়া যায়। চিকিৎসক পরামর্শে প্রচুর ভিটামিন সি খেয়েছিলেন এবং এখনো খাচ্ছেন।

জাহিদ হোসেনকে জিজ্ঞেস করলাম এই রোগীকে অনেকেই অবহেলা বা ভয় করে, আপনার সঙ্গেও এমন কিছু হয়েছিল। উত্তরে বললেন, যখন তিনি হাসপাতালে, তখন তাঁর পরিবারের দেখাশোনা করেছে কমিউনিটির প্রবাসী বাংলাদেশিরা এবং এখনো করছেন। আর ইতালির চিকিৎসকদের কথা বললেন, তাঁদের ভেদাভেদহীন সেবা আর রোগীর মনে বেঁচে থাকার, এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কথাগুলো বলতেন, নার্সদের হাসিমুখের কথাগুলো আজ ও তার মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে। অন্তরের খুব গভীর থেকে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। জাহিদ বলেন, মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া কী পরিমাণ তা আমার জানা নেই। আল্লাহর পরেই আমি এদের কাছে ঋণী।

প্রশ্ন করলাম, তাহলে তো ঈদের দিনে খুব আনন্দে ছিলেন। তিনি খুব আবেগমাখা কণ্ঠে বললেন, বেরগামোর আরও দুজন বাংলাদেশি মারা গিয়েছেন এই করোনাভাইরাসে। প্রথমে আক্রান্ত হন তিনি (জাহিদ হোসেন) এর পাঁচ–ছয় দিন পর শরীয়তপুরের সালাউদ্দিন সৈয়াল এবং মানিকগঞ্জের মিজানুর রহমন। মূলত তাঁরা তিনজনই ছিলেন সবচেয়ে বেশি করোনায় আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগী। জাহিদ হোসেন বেঁচে যান কিন্তু অন্য দুজন মারা যান। তাঁদের ঘরে তাঁদের পরিবার ঈদ করছে হাহাকারের মধ্য দিয়ে। অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মনে বলেন, করোনায় মারা যাওয়া সেই দুজনের সঙ্গে তাঁর যে স্মৃতিগুলো রয়েছে, তা কোনোভাবেই ভুলতে পারেন না।

জাহিদ হোসেন একজন যোদ্ধা। আগের মতো এখন আবার তার পদচারণে বাজারে, রাস্তায়, দোকানে, বন্ধুদের আড্ডায়, সন্তানদের সঙ্গে নিবিড় আলিঙ্গনে। জাহিদ হোসেনের মতো করোনাজয়ীরা জীবনছন্দে নব আনন্দে ফিরে আসবে, এটাই চাওয়া।