আমাদের করোনা ঈদ

বাচ্চারা ঘুমায় দেরি করে, করোনা ইফেক্ট, সঙ্গে এখন সামার ভ্যাকেশন। বাবা ছেলেকে মনে করিয়ে দিচ্ছে সকালে জলদি উঠতে হবে। আমার বাবার বাসা থেকে ফোন এসেছে, রান্না করার দরকার নেই, এখানে খাবা। কখন আসবা? আমার রুমমেট বলে আটটায়! আমি জানি সে ওই সময়ে যেতে পারবে না। চুপচাপ শুনছি আর নিজের কাজ করছি।
মেয়ে কাজে যাবে, আসতে রাত হবে। বলছে, আমার ড্রেস রেডি রেখো, তাহলে সকালে ঝামেলা করতে হবে না। ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম কী পরবে? বলে, পুরোনো পাঞ্জাবি, যেটা গায়ে লাগে, সেটা পরবে। রুমমেট (প্লিজ পরেন, হাজব্যান্ড), তাকে জিজ্ঞাসা করিনি কিছু, আমি জানি সে তার মর্জিমতো কিছু পরবে, যা আমাদের সঙ্গে যাবে না।
বান্ধবী ফোন দিচ্ছে ওর ওখানে নামাজ পড়ে ব্রান্চ করতে (ব্রেকফাস্ট + লাঞ্চ)। আর দুটো ফ্যামিলি আসবে, সবাই সুস্থ, গাইডলাইন মেনে চলছে বলে! আমি গাইগুই করছি, সবার সঙ্গে আসব না। এ হলো প্রাক্‌–ঈদ।

রান্নাবান্না নেই আমার বাসায়! মেয়ে কাজে যাবে দুপুরে। গত রাতে তার ড্রেস হাতে দিয়েছি। আমি সকালে নিজের কাপড় খুঁজে পাই না। সবাই রেডি। ফেসবুক লাইভে খুতবা আর নামাজ হলো। আমি তখনো খুঁজছি (লেখা পর্যন্ত পাইনি)। আমাকে রেখেই যেতে বললাম সবাইকে আমার বাপের বাড়ি। রুমমেট আবার দয়া পরবশ হয়ে বলছে, তোমাকে নিয়েই যাব। অবশ্যই তার দেওয়া সময়ের পরে।
খিচুড়ি, আচার, ডিম, মাংস সঙ্গে জর্দা, সেমাই দিয়ে ভূরিভোজ হলো। ফটোসেশন করে বাসায় ফিরতে দেখি বান্ধবীর বাসায় গাড়ির ভিড় নেই। ভাবলাম সবাই আসার আগে দেখা করে আসি! ভদ্রতাবশে যেয়ে তো আটকা পড়ে গেলাম! এক কাপ চা নিয়েছিলাম, ভুলে গেছি খেতে।
সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে, মেয়ে কাজে গেল। মেয়ের বাবা, বেড়ালের সঙ্গে ন্যাপও নিয়ে নিল। ঈদের দ্বিতীয় রাউন্ড শুরু হবে শিগগিরই।
ঈদ কিছু মসজিদের কারণে (আমেরিকায় রোববার ঈদ) গত সোমবারও কেউ কেউ করেছেন। দু–একটি মসজিদে নাকি দূরত্ব বজায় রেখে সকালে জামাতও হয়েছে। কোথাও কোথাও মসজিদের পার্কিং লটে মানুষেরা নাকি গাড়িতেই নামাজ পড়েছেন। আমার বাসায় ঈদের নামাজ হয়েছে। মা–বাবাও তাঁদের বাসাতেই ঈদের নামাজ পড়েছেন। বান্ধবীর বাসায় ছোট জামাত করেছে। অনেকে পরিচিত লোকজন বন্ধুদের বাসার সামনে ড্রাইভ করে হাত নাড়িয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে এসেছে, অনেকে পার্কে যেয়ে দেখা করে এসেছে। যার যেভাবে করে, এই ভিন্নধর্মী ঈদ উদ্‌যাপন করতে ইচ্ছা করেছে, সে সেভাবে করছে। আমি খোঁজাখুঁজি বাদ দিয়েছি। এবার আবার খেতে যাব।
ছেলেমেয়েরা বাবা, নানা-নানি, আমার বান্ধবীর কাছ থেকে ঈদি পেয়েছে! মেয়ে তার বেড়ালের জন্য গিফট কিনবে ভাবছে।
বাসায় ফিরে আর কিছু করার মতো এনার্জি নেই। সন্ধ্যায় বান্ধবীর বাসা—এবার আর অন্য কারও সঙ্গে দেখাদেখি নেই। যেহেতু তার বাসায় কিছু দুপুরে খাইনি, খাবার টেবিলে দিয়ে দিল। খেয়েদেয়ে ঘরে ফিরতেই মাঝরাত। এর মধ্যে অন্যান্য বন্ধু–বান্ধবের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়। দেশে সবার কুশলাদি জানা, সবই হলো।
কোভিড আমাদের দ্রুত ছেড়ে কোথাও যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। এটা আমাদের নতুন নরমাল বিষয় শেখাচ্ছে। যেমন দূরত্ব বজায় রাখা, পরিচ্ছন্নতা, মিতব্যয়িতা ইত্যাদি! বলছে, জীবনধারণের জন্য খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই। সুঅভ্যাস আর স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন অপরিহার্য। কিন্তু যদি তার সঙ্গে মৃত্যুটা বাদ দেওয়া যেত! যদি জানা যেত কবে এর শেষ? যদি জানা যেত রোজা শেষে, ঈদ শেষে এরও পরিসমাপ্তি ঘটবে, কতই না ভালো হতো!
সে যা–ই হোক, দূরত্ব বজায় রেখে ঈদ, পরিজন নিয়ে ঈদ—দূরে থেকেও ভালোবাসি বলার ঈদ বা সবকিছু ভুলে যাওয়ার ঈদ, যার যেভাবে এটি উদ্‌যাপন করার, সে সেভাবেই করুক, শুধু সবাই সুস্থ থাকুক। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ ব্যক্তিদের কথা মনে রাখবেন, তাঁদের সুস্থতার সঙ্গে নিজেদের সুস্থতার জন্য যতটা সম্ভব নিজদের বাইরের লোকজন থেকে দূরে রাখুন। নিশ্চিত করুন যাঁদের সংস্পর্শে যাচ্ছেন, তাঁরা সুস্থ।
যদি আশপাশে কোনো অসুস্থ পরিবার থাকে, তাদের প্রতি মানবিক হোন। তাদের ঘরে হয়তো ঈদের আনন্দ নেই, কিন্তু তার দরজায় যদি আপনি একটু খাবার রেখে আসেন, সেটাই তাদের জন্য ভীষণ আনন্দদায়ক হবে। মানবিক হোন, সুস্থ থাকুন, অসুস্থদের সঙ্গে মানবিক হোন। ঈদ মোবারক।
* লেখক: চিকিৎসক