গ্রিস যেভাবে করোনা মোকাবিলায় রোল মডেল

গণতন্ত্রের জন্মভূমি, প্রাচীন সভ্যতার আদি ভূমি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি, বিখ্যাত দার্শনিকদের জন্মভূমি গ্রিস হাজার বছরের মহামারি প্রতিরোধের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে করোনা মোকাবিলায় ইউরোপ তথা বিশ্বে রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।

গ্রিক সাহিত্যের জগতে বিখ্যাত দুটি গ্রন্থ হোমারের ‘ইলিয়াড’ আর সাফোক্লিসের ‘রাজা ইপিডাস’ শুরুই হয়েছিল মহামারি দিয়ে। তাই গ্রিকরা জন্মলগ্ন থেকেই মহামারি প্রতিরোধের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।

গ্রিস স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গ্রিসে কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসে সর্বমোট আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৯১৭ জন, মৃত্যুবরণ করেছেন ১৭৫ জন এবং এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে গেছেন ১ হাজার ৩৭৪ জন।

ইউরোপের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে গ্রিস করোনা মোকাবিলায় সম্পূর্ণরূপে সফল।

সফলতার পেছনে কারণ হচ্ছে:

করোনা মোকাবিলায় গ্রিসের স্লোগানটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।  করোনা মোকাবিলায় গ্রিসের স্লোগান ছিল ‘আপনার মা–বাবাকে বাঁচান, আপনার দাদা–দাদিকে বাঁচান, দয়া করে আমাদের নির্দেশনাগুলো মেনে চলুন।’

তা ছাড়া গ্রিস শুরু থেকেই করোনা পরিস্থিতির ওপর করা নজর রেখেছিল, ডিসেম্বরের শেষের দিকে করোনা মোকাবিলায় জাতীয় কমিটি গঠন করে। জানুয়ারির শুরু থেকে বিদেশ থেকে আসা প্রত্যেক যাত্রীকে স্ক্যানিং করা হতো, যদি কারও মধ্যে করোনার উপসর্গ পরিলক্ষিত হতো, সঙ্গে সঙ্গে কোয়ারেন্টিনে রাখার ব্যবস্থা করা হতো।

ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। আক্রান্তের সংখ্যা একটু বৃদ্ধি পেলে প্রাথমিক অবস্থায় ১০ মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সব ধরনের উৎসব অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়। ২৩ মার্চ থেকে দেশ সম্পূর্ণরূপে লকডাউন ঘোষণা করা হয়।

লকডাউনের নির্দেশনা ছিল—

১.

জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হতে পারবে না। বের হতে হলে অবশ্যই এসএমএসের মাধ্যমে অনুমতি নিয়ে বের হতে হবে। বিনা অনুমতিতে বের হলে ১৫০ ইউরো জরিমানা করা হয়।

২.

শুধু ওষুধ এবং সুপার মার্কেট ছাড়া, রেস্তোরাঁ, কফিশপসহ (শুধু হোম ডেলিভারি চালু রেখে), সব ধরনের দোকানপাট, শপিং মল, শিল্পকারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

৩.

কার কিংবা ট্যাক্সিতে দুইজনের বেশি যাত্রী পরিবহন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়।

৪.

বড় সুপার মার্কেটে একসঙ্গে পাঁচজনের বেশি প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কেনাকাটা করতে বলা হয়।

৫.

কোনো ব্যক্তি অসুস্থ হলে হটলাইন ও অনলাইনের মাধ্যমে ডাক্তারি সেবা প্রদান করা হতো।

৬.

ভাইরাসের প্রকোপ প্রতিরোধে ব্যাপকহারে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করা। 

লকডাউন যথাযথ পালনের ফলে নতুন করে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি না পাওয়ায় সরকার জনজীবনে স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে তিনটি ধাপে নির্দিষ্ট কিছু শর্ত সাপেক্ষে লকডাউন উত্তোলনের ঘোষণা দেয়।

দীর্ঘ ২ মাস ১০ দিন সম্পূর্ণরূপে লকডাউনে থাকার পর, সরকারের সেই ঘোষণা অনুযায়ী প্রথম ধাপে গত ৫ মে থেকে ছোট ছোট দোকানগুলো, পার্ক, ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। তবে শর্ত ছিল, প্রতিটি স্থানে সামাজিক দূরত্ব বজাই রাখতে হবে এবং মাস্ক অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে।

দ্বিতীয় ধাপে ১৫ মে থেকে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি অফিস–আদালত খুলে দেওয়া হয়েছে, তবে কিন্ডারগার্টেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহ ১৮ মে থেকে খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে শর্ত হচ্ছে শ্রেণিকক্ষে এক ছাত্র থেকে আরেক ছাত্রের বসার দূরত্ব অবশ্যই ৫ ফুট হতে হবে এবং মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।

শেষ ধাপে ২৫ মে থেকে রেস্তোরাঁ, কফিশপ, বড় বড় শিল্পকারখানা, শপিং মলগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। এবং দেশের প্রায় ৫১৫টি সমুদ্রসৈকত জনসাধারণের জন্য শর্ত সাপেক্ষে উন্মুক্ত করা হয়েছে। 

দেশটির প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিতসোতাকিস দেশের অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি পর্যটনশিল্পকে আবার চাঙা করার জন্য ১৫ জুন থেকে বিশ্বের ২৯ দেশের নাগরিকদের গ্রিস ভ্রমণের অনুমুতি দিয়েছে। তবে গ্রিসে সবচেয়ে বেশি পর্যটক ভ্রমণকারী দেশ ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ইতালি, রাশিয়া, স্পেন ও ফ্রান্সে এখনো করোনা আক্রান্তের সংখ্যা না কমায় এসব দেশের অধিবাসীদের জন্য গ্রিস ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হয়নি।

যদিও এখন নতুন করে করোনাভাইরাসে কেউ আক্রান্ত হচ্ছে না। তবু শর্তসমূহ এখন বিরাজমান। মাস্ক পরে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কেউ এই আইন অমান্য করলে জরিমানা করা হচ্ছে।

করোনা মোকাবিলায় ইউরোপসহ সারা বিশ্বে গ্রিক মডেল প্রশংসিত। গ্রিক মডেলের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে মানবিকতা। এখানে কোনো চিকিৎসককে করোনা রোগীকে সেবা দেওয়ার ফলে বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ দেওয়া হয়নি, কোনো রোগীকে স্বাস্থ্যসেবার জন্য এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘোরাঘুরি করতে হয়নি, করোনায় আক্রান্ত হয়ে কোনো ব্যক্তি রাস্তায় মৃত্যুবরণ করতে হয়নি, কোনো করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেনি, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে কবর দিতে বাধা দেওয়া হয়নি।

গ্রিস থেকে আমাদের ‘মানবতা’ কী, সেটা শিক্ষা নেওয়া উচিত। জয় হোক মানবতার, করোনামুক্ত হোক বিশ্ব।