মায়ের কাছে প্রথম অক্ষরজ্ঞান ক খ শেখা

আমি যখন স্কুলে ভর্তি হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হই, তখন বাড়িতে এসে মায়ের সঙ্গে আবদার করে বললাম, আমাকে একটা স্লেট কিনে দিতে। মা বলত, বাবাকে বলতে। বাবাকে তো তখন আমরা বাঘের মতো ভয় পাই, তাই বলা সম্ভব হতো না। বাবাকে ছোট সময় থেকে ‘আপনি’ করে সম্বোধন করতাম, মাকে বলতাম ‘তুমি’ বলে। বাবা কখনো আদর করে কিছু বললে, তাঁর কাছে ঘেঁষলেও বাবাকে দু–একবার হাট থেকে স্লেট কিনে দেওয়ার অনুরোধ করেছি, তা মনে পড়ে। কিন্তু বাবাকে ভয় পাওয়ার কারণে মায়ের সঙ্গেই বেশি আবদার করতাম।
আমাদের গ্রামের বাড়ির কাছেই সপ্তাহান্তে হাট বসে। একদিন সেখান থেকে একটি কাঠের স্লেট কিনে এনে দিলেন বাবা। সেটা এনে মাকে দিলে মা আমাকে দিয়ে বলেছিল, মন দিয়ে পড়ালেখা করতে। বলেই স্লেটটি আমার হাতে তুলে দিয়েছিল মা। স্লেটটি পেয়ে মনে হয়েছিল আমার বুকের ভেতর ভরে রাখি। কিছুক্ষণ পরপর বগলতলায় নিয়ে স্কুলে যাওয়ার ভঙ্গিতে ঘরে হাঁটাহাঁটি করেছি। আমাদের ঘরে কাঠের চকি ছিল। চকিতে সবার ঢালাও বিছানা করা হতো। সেই বিছানায় শুয়ে সেই স্লেটে কিছু লেখার চেষ্টা করেছি।
স্লেটের সঙ্গে একটা সাদা চক কিনে এনেছিলেন। সেই চক দিয়ে কালো স্লেটে লম্বা আঁকাবাঁকা দাগ দিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করেছি। সেই দাগ দেওয়ার মধ্যে কী যে আনন্দ ছিল, তা আমার এই লেখায় বোঝানো অসম্ভব। কখনো সেই অনুভূতি কারও সঙ্গে শেয়ার করা হয়নি আমার। কালো গোলাপি বর্ডারের কাঠের সেই স্লেট পাওয়ার পর থেকে মাকে যন্ত্রণা দিতে শুরু করি স্লেটের ওপর কিছু লিখে দেওয়ার জন্য।

যতটা মনে পড়ে মা–ও ভালো করে লিখতে পারেনি তখন। তারপরও অনেক কষ্টে প্রথম ‘ক’ লিখে দিয়েছিল মা। সেটা দেখে আমার ইমিডিয়েট বড় বোন হাতে ধরে ‘ক’–এর ওপর ওভার রাইটিং করতে শিখিয়েছে। আমার ধৈর্য ধরছিল না, সেই একটি অক্ষর লেখার মধ্যে তাই অনুরোধ করছিলাম বারবার পরের অক্ষর লিখে দিতে। মা যন্ত্রণা আর আগ্রহ দেখে সেদিন ‘খ’ লিখে দিয়েছিল আমাকে শেখার জন্য। সেটিই ছিল আমার মায়ের হাতে প্রথম অক্ষরজ্ঞান লাভ। যদি বলি আমার হাতেখড়ি হয় মায়ের কাছে সেই দিনের সেই ক খ লেখার মধ্য দিয়ে, তাহলে ভুল বলা হবে না।
কিছুদিন পর স্কুলে যাওয়ার পালা। মা–ই প্রথম স্কুলে নিয়ে গিয়ে আগ্নেশ টিচারের (যেরুর মার) ক্লাসে বসিয়ে দিয়ে আসে। মা আমাকে ক্লাসে বসিয়ে দিয়ে চলে আসতেন। এরপর ঘণ্টা বাজিয়ে ক্লাস শুরু হলে আমাদের সবাইকে বলা হয় স্কুলে আসার আগে বাড়িতে মায়ের কাছে কে কী অক্ষর লেখা শিখেছি, তা ব্ল্যাক বোর্ডে লিখে দেখাতে। আমার মতো অনেকেই ছিল, যারা বাড়িতে মায়েদের কাছে এই অক্ষরজ্ঞান লাভ করেছিল। তারা যে যেভাবে সম্ভব লিখে দেখিয়েছে।
আমাকে যখন বলা হয়েছিল বাড়িতে কী শিখেছি তা ব্ল্যাক বোর্ডে লিখে দেখাতে, তখন চেষ্টা করেছি ক খ দুটি অক্ষর লিখে দেখাতে। লেখা আমার সুন্দর না হওয়ায় টিচার তিরস্কার করে বলেছিলেন, কী লিখেছিস এসব বকের ঠ্যাং কাকের ঠ্যাং? তোর মা তোকে বাড়িতে কিছু শেখায় নায়?

আমার স্পষ্ট মনে আছে সেদিন ক্লাস টিচার আগ্নেশদির এমন তিরস্কারের কথা। মাকে নিয়ে এমন কথা বলায় আমি মনে মনে জিদ করেছিলাম। যার ফল ছিল পরবর্তী সময়ে নিয়মিত পড়া না শিখে ক্লাসে যাওয়া এবং ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা। যদিও আমি বরাবর ভালো ছাত্র ছিলাম না, তারপরও মা আমাকে খুব আদর দিয়ে সেই ছোট সময় থেকেই পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে বলত।
আমার আজকের এই লেখালেখি করার পেছনে মায়ের সেই প্রথম দিন কালো স্লেটে সাদা চক দিয়ে ক খ লিখে অক্ষর শেখানোর ফল। মা ছিল এবং হাতেখড়ি দিয়েছিল বলেই আমি আজকের আমি হতে পেরেছি। আমাকে নিয়ে মায়ের অনেক আশা ছিল, ছিল স্বপ্নও। আমার ধারণা, মায়ের কোনো আশা বা স্বপ্নই আমি পূরণ করতে পারিনি। তবে যা হতে পেরেছি, তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই মাকে।

আরও পড়ুন: