করোনার প্রাদুর্ভাবে মালিবিহীন ফুলবাগান

বিনয় গার্ডেন। ছবি: লেখক
বিনয় গার্ডেন। ছবি: লেখক

দীর্ঘদিন লকডাউনে থাকার পর কর্মক্ষেত্রে যোগদান করেছি। ঘরের ভেতর বন্দী থাকতে থাকতে শরীরে আগের মতো আর চঞ্চলতা নেই। অনেকদিন পর পরিচিত মুখ আবার দেখলাম। তবে এখনো অনেক সহকর্মী লকডাউনের আওতাধীন। দীর্ঘ প্রবাসজীবনে সেই সব পরিচিত মুখের সঙ্গে কোনো না কোনো কারণে প্রায় দেখা হতো। কুশলবিনিময় হতো। পারিবারিক বিষয় নিয়ে মাঝেমধ্যে আলাপের মাধ্যমে ভুলগুলো সমাধান করার উপায় খুঁজে পেতাম।

কোভিড-১৯ দুর্যোগ পরিবার, বন্ধু, আত্মীয়স্বজন সবাইকে আলাদা করে দিয়েছে। দেখা হলেও দূর থেকে একজন আরেকজনের দিকে কুশলবিনিময় ছুড়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কাছে গিয়ে কাঁধে কাঁধ মেলানো, করমর্দন—কোনোটা সম্ভব হয় না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে আমার সেকশন ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বললাম। ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ মিষ্টি হাসি দিয়ে আমার কাছে জিজ্ঞাসা করলেন কেমন আছি। আমি ছোট্ট করে উত্তর দিলাম, ‘ভালো আছি।’ মানুষ এখন নীরব হয়ে গেছে। গর্ব, অহংকার ধুলায় মিশে গেছে।

মানবজাতির এই চরম দুর্দিনে চারদিকে প্রকৃতি সেজেছে তার নিজেস্ব ঢঙে। প্রকৃতির সাধ জেগেছে আকাশ ছোঁয়ার। চারদিকে সবুজ ডালপালা বিছিয়ে পৃথিবীকে বলছে এখন আমাদের সময়। পাখিরা তৈরি করছে নতুন নতুন বাসা। সাগরপাড়ের লতাগুল্ম ঢেউ ছুঁতে অগ্রসর হচ্ছে জলের দিকে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল কালো ধোঁয়ামুক্ত। মানুষের জীবনে নেমেছে অমাবস্যা রাতের মতো গাঢ় কালো অন্ধকার।

আমার কর্মক্ষেত্রের মেইন অফিসের সামনে সুন্দর একটি ফুলের বাগান আছে। সেই ফুলের বাগানে বাহারি রকমের ফুলের গাছে সাজানো। ফুলবাগানের মনোরম দৃশ্য যেকোনো প্রকৃতিপ্রেমীর মন নিঃসন্দেহে পুলকিত করে সব সময়। ভালোলাগার মুহূর্ত হৃদয়ের জানালায় উঁকি দিয়ে জানায় বৃক্ষ ও মানুষের নিবিড় বন্ধুত্ব। ইন্দ্রিয় শক্তি জাগিয়ে তোলে প্রখর বেগে। বাগানের পশ্চিম পাশের কৃত্রিম ঝরনা থেকে জল গড়াতে গড়াতে চলে যায় পূর্ব পাশের লেকের ভেতর। লেকের জলে ভাসে পদ্ম ফুল। জলের ভেতর সৌন্দর্যবর্ধন বিভিন্ন রঙের মাছের ছোটাছুটি খেলা চলে সারাক্ষণ। দৃশ্যটা খুবই উপভোগের। লেকের মাঝবরাবর কাঠের সাঁকোর ওপর দাঁড়ালে বকুলগাছটি নিবিড় ছায়া দেয়। সাঁকো পার হলেই টিনে দুটি ছাউনি বাগানের সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়েছে।

করোনার কারণে মালি নেই বাগানের পরিচর্যায়। কিন্তু ফুলগুলো ঠিকই সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে। ছবি: লেখক
করোনার কারণে মালি নেই বাগানের পরিচর্যায়। কিন্তু ফুলগুলো ঠিকই সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে। ছবি: লেখক

বিনয় সেক্টরে চাকরির সুবাদে এই (বিনয় গার্ডেন) ফুলবাগানের সঙ্গে আমার ১০ বছরের পরিচয়। হাঁপিয়ে ওঠা জীবনে শীতল ছায়া শরীরে মাখতে মাঝেমধ্যে বাগানে যাই। একবুক সবুজ নিশ্বাস নিই। কৃত্রিমভাবে গড়ে তোলা ছোট্ট এই বাগানের সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করে সব সময়। ফুলের বাগানের দিকে তাকালে বোঝা যায় পৃথিবী কতটা বদলে গেছে। মানুষের ব্যস্ততা নেই। প্রকৃতির কাছে ছুটে গিয়ে অবসর উপভোগ করার সুযোগ নেই। প্রকৃতি এবং মানুষের বন্ধুত্বে ফাটল ধরেছে। করোনার আঘাতে বাগান পরিচর্যাকারী নেই। যে মানুষগুলো প্রতিদিন বাগানের যত্নে নিয়োজিত ছিল, তারা আজ করোনার ভয়ংকর আঘাতের ভয়ে ঘরের ভেতর থেকে দিন গুনছে সোনালি সকালের। কত দিন আর এই ঘরে বসে থাকা? কাজ ছাড়া মানুষের জীবন অচল মুদ্রার মতো। কেউ গুরুত্ব দেয় না। আপনজনের বায়না মেটানো অসম্ভব হয়ে যায়। প্রেম-ভালোবাসায় গুরুত্ব কমে যায়। স্বপ্ন ছোঁয়ার আশা মরে যায়।

আমার সেকশন ম্যানেজার এনজি ওয়াই সিং এবং উই সান উইনের নির্দেশনায়, সুদীপ কুমার নাথের তত্ত্বাবধানে কয়েকজন কর্মী বাগানে কাজ করতেন। কোভিড-১৯–এর ভয়ংকর আঘাতের কারণে তাঁরা এখন যাঁর যাঁর ডরমিটরিতে অবস্থান করছেন। এই সুযোগে মাটির উর্বরতা নিয়ে গাছগুলো বেড়ে উঠেছে প্রকৃতির নিয়মে। মালিবিহীন পড়ে আছে বাগান। আগাছাও বাড়তে শুরু করেছে। প্রকৃতি আমাদের অভিশাপ দিয়েছে। কোভিড-১৯ আমাদের নিয়ে যেমন খুশি খেলা করছে। এই খেলা মৃত্যু মৃত্যু খেলা। স্বজন কেড়ে নেওয়ার খেলা। জানি না এই খেলার শেষ কোথায়। মানবজাতি না থাকলে ফুলের বাগানের সৌন্দর্য দেখে কোন জাতির হৃদয় পুলোকিত হবে? বাগানে ফুল ফুটুক। ফুলের ঘ্রাণে মানুষের হৃদয় রোমাঞ্চিত হোক। পৃথিবী আবার ফিরে আসুক আপন ব্যস্ততায়। মানবজাতি ফিরে যাক তাদের কর্মক্ষেত্রে। শুদ্ধ হওয়ার শপথ নিয়ে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে বাঁচার মতো সবাই আমরা বাঁচতে চাই।