কফিবালিকা

বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে হাত ক্রমশ জমে আসছিল। গ্রীষ্মের শেষে বসন্তের আমেজে সেজেছে প্রকৃতি। গাছের পাতাগুলোয় এই সময় তিন রকমের রং চোখে পড়ে—সবুজ, হলুদ আর লাল। প্রকৃতির সৌন্দর্যকে হয়তো কখনো কোনো সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যাবে না। সিডনি শহরের স্নিগ্ধতার কোনো তুলনাই হয় না। এটা অস্ট্রেলিয়ার অপেরা হাউসের সিডনি নয়, কানাডা, নোভা স্কসিয়ার সিডনি। নয়টা প্রদেশের মধ্যে নোভা স্কসিয়া দ্বিতীয় কনিষ্ঠ। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, শুধু সিডনিই নয়, প্যারিস, লন্ডন, ইয়র্ক সবই আছে এ দেশের ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে।

পাহাড়ঘেরা, আটলান্টিক সমুদ্রের কোল ঘেঁষে অপরূপ সৌন্দর্যের লহর তোলা এই কেপ ব্রেটন দ্বীপকে বলা হয় মৃত্যুর আগে অবশ্যই দর্শনীয় দশটা জায়গার মধ্যে একটা।

বাস এসে গেছে। ১ নম্বর বাস। এই বাসে চেপে আমাকে ডরচেস্টার মানে মেইন বাসস্টপ থেকে ৫ নম্বর বাসে উঠতে হবে। গন্তব্যস্থল নর্থ সিডনি। ডেভেনপোর্ট রোড আসতেই চোখের দৃষ্টি তাকে না খুঁজলেও মনের অনুরণন যাকে স্মরণ করছে, সে-ই চড়ে বসল বাসে—হারপ্রিত।

আজকে দুপাশে চুলের ছোট বেণী করেছে। মেসেজ করে বললাম, 'আমি তোমার পেছনে!' মেসেজ পড়ে কিছুটা অবাক হয়ে এদিক–ওদিক তাকিয়ে দেখে। আমি হাত নেড়ে ইশারা জানালাম পেছন থেকে। নিজের জায়গা থেকে খানিকটা সরে গিয়ে পাশে বসতে বলল। আজ ধূসর বর্ণের জ্যাকেট পরেছে, আর মাথায় নীল রঙের টুপি। ঠোঁটে ডিপ রেড লিপস্টিক। পায়ে সিলভার কালারের জুতো জোড়া মনে হয় হাডসন বে থেকে কেনা। আমরা ইউনিভার্সিটিতে ক্লাসমেট আর ওয়ালমার্টে কলিগও।

ডরচেস্টার পৌঁছে ৫ নম্বর বাসে উঠে বসলাম দুজনেই। ওর গতরাতের গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে, আর আমি শ্রোতা। আমাদের গল্প শুরু হয়, কিন্তু শেষ হওয়ার আগেই গন্তব্যে পৌঁছে যাই।

ওর বাসে চড়তে ভয় লাগে। বলে, যখন বাস ওপর থেকে নিচের দিকে নেমে যায়, তখন মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরতে থাকে। এখানকার রাস্তাগুলো কিছু কিছু জায়গায় বেশ ঢালু আবার কিছু জায়গায় সমতল। আমার কেমন লাগে জিজ্ঞেস করাতে বললাম, আমার তো বেশ মজাই লাগে। মনে হয় উড়ছি। কখনো খুব উঁচুতে আবার কখনো নিচের দিকে নেমে যাচ্ছি। দারুণ লাগে!

পৌঁছে যে যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমাদের ডিপার্টমেন্ট আলাদা। ও ক্যাশিয়ার আর আমি সেলসফ্লোর অ্যাসোসিয়েট।

ওর ডিউটি পড়েছে ১১ নম্বর রেজিস্ট্রারে। ওখানে কাস্টমারের ভিড় সব সময়ই কম থাকে। ওয়ালমার্টে প্রবেশপথ দুটো—১১ নম্বর রেজিস্ট্রারের দিকে দুই নম্বর প্রবেশদ্বার হওয়ায় ওদিকে খুব একটা ভিড় হয় না। ও অধিকাংশ সময়ই ওখানে একা দাঁড়িয়ে বোর হয়ে যায়, তাই আমাকে আশপাশে দেখলেই ডাকে। আমি টুকটাক কিছু বলেই চলে যাই নিজের কাজে। কখনোসখনো ওর পানির ক্যান, পেপসির বোতল অন্য কোথাও রেখে চলে আসি। আর ও খুঁজতে থাকে হন্যে হয়ে, দূর থেকে তাকিয়ে কাণ্ডকারখানা দেখি! অবশ্য এমন জায়গায় রাখি যেন কিছুক্ষণ খোঁজার পর পেয়ে যায়। তখন চেহারায় যে ভাবখানা ফুটে উঠে, তাতে স্পষ্টত দেখতে পাই আমাকে ওই সময় সামনে পেলে ও কী করত?

আজ কাজ শেষে ফেরার পথে বাস সময়ের আগেই পৌঁছে গেল। সময় আছে দেখে নামার পরই ওকে বললাম, চলো টিম যাই। টিম হর্টনস। কফি চেইন সুপারশপ। কানাডাজুড়েই এক নামেই পরিচিত ও দারুণ  জনপ্রিয় এ কফিশপ।

রাস্তা পার হওয়ার সময় বাসটা আমাদের অপেক্ষায় রইল। তো ওটা দেখে যাওয়ার পথে মজা করে ওকে বললাম, 'আমি তো ইউনিভার্সিটির ভবিষ্যৎ এমপ্লয়ি। সম্মান করে কথা বলো। দেখো, ড্রাইভারও জানে কাকে সম্মান করতে হবে। এ জন্যই আমাদের রাস্তা ছেড়ে দিল।'

ও হেসে বলল, 'ওটা সবার জন্যই করবে। তোমাকে দেখে অপেক্ষা করতে ওর বয়েই গেছে!' এরপর মুখ ভেংচি কেটে বলল, 'দেখ লুঙ্গি! কিতনা পোটেনশিয়ালস হ্যায় আপ মে?' (দেখে নেব, তোমার কতটা পোটেনশিয়ালস আছে?) আমি ইউনিভার্সিটিতেও জব করি। তাই ইতিমধ্যেই অনেকের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছি। ব্যাপারটা বেশ মজার লাগছে আমার!

পাঞ্জাবি মেয়ে হলেও ওর বাবার চাকরির সুবাদে ভারতবর্ষের অনেক শহর ঘোরা হয়েছে। ভদ্রলোক পেশায় ছিলেন আর্মি ইঞ্জিনিয়ার। পশ্চিমবঙ্গ, গুজরাট, রাজস্তান, জম্মু-কাশ্মীর আর ওর বাবার আর্মি ইউনিটে বেশ কিছু পরিবার ছিল তামিল ভাষাভাষী। কাজেই ও নিজেকে ঠিক পাঞ্জাবি বলে পরিচয় দেয় না। আমাদের কথোপকথন হয় হিন্দিতে। আর মাঝেমধ্যে আমি বাংলায় অনেক কিছু বকে ফেলি, যা শুনে ও বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে। আর আমি ওকে শুধরে দিই। ইতিমধ্যে একটা কথা ভালোভাবেই রপ্ত করেছে—'উল্টোপাল্টা বকবে না!' সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, আমার ভারতীয় বন্ধুরা মানে সে পাঞ্জাবি হোক বা গুজরাটি বা মালায়ালি হোক, নির্ভুলভাবে বাংলায় একটা কথাই বলতে জানে—'আমি তোমাকে ভালোবাসি!" এটা বলতে ওদের কোনো ভুল হয় না!

 আমরা ১০ মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেলাম টিম হর্টনসে। এইটুকু পথ হাঁটতেই দুজনেই ঠান্ডায় জমে ক্ষীর। কাজেই এখন গরম কফির অর্ডার দেওয়ার পালা।

টিম হর্টনস, জর্জ স্ট্রিট।

ঢুকেই বাঁ পাশের টেবিলে চারজনের বসার জায়গা হলেও সঙ্গে থাকা ব্যাগ আর জ্যাকেট পাশের চেয়ারে রেখে যে যার মত বসে পড়লাম। তেমন একটা ভিড়ভাট্টা না থাকায় বসতে কোনো অসুবিধাই হলো না। বাঁ পাশের সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্টে দুই ধরনের বসার ব্যবস্থা রয়েছে—প্রথম দিকের চারটা টেবিল বাদে বাকিগুলো দুইজনের জন্য। সামনের দিকে এবং ডান দিকের কিছুটা অংশজুড়ে আছে ফ্যামিলি সিটিংয়ের ব্যবস্থা। আমরা মূলত প্রবেশপথের বাঁ দিকটায় বসে আছি, তার অপর পাশেও বসার ব্যবস্থা রয়েছে। ডান দিকের ওপাশের ওয়াল এলইডিতে কাস্টমাররা টিভি দেখছে। পুরো সেটিংসটা মূল প্রবেশ ফটকের অপর পাশের ছোট্ট একটা জায়গাজুড়ে। মেইন ডোর হয়ে ঢুকে একটু এগোতেই অর্ডার দেওয়ার ফ্রন্ট ডেস্ক। ওখানে লাইনে দাঁড়িয়ে অর্ডার দিতে হয়। বসে লক্ষ করছিলাম কিছুটা সময় লেগে যাবে ওই লাইন ছোট হতে। আজকে দিন কার কেমন কেটেছে, এসব নিয়েই টুকটাক কথা চলছিল। হারপ্রিতের আজকের মেনু—ফ্রেঞ্চ ভ্যানিলা উইথ এক্সপ্রেসো শট সঙ্গে স্ট্রবেরি মাফিন। আর আমি নিলাম হট চকলেট। ও বলছিল—বেশ ক্ষিদে পেয়েছে! কিন্তু পরে আর কিছু নিতে চাইল না। দুজনে একসঙ্গেই অর্ডার নিয়ে ফেরত এলাম।

খাওয়া শুরু করার আগেই বলে নিল আজকে শেয়ার করতে পারবে না ও। আমি কিছুটা হতবাক হয়ে তাকাতেই বলে, 'নাও, আমি তো এমনিতেই মজা করছিলাম!'

ছোটবেলার কথা বলছিল—এক রাতে তিন বোন মিলে হাঙ্গামা বাধিয়েছে। ফ্যানের বাতাসের কাছে কে শোবে, এ নিয়ে চলছিল তর্ক। খাটের বাঁ পাশের দিকে ফ্যানের হাওয়া সব সময় বেশি, আর ওই জায়গা নিয়েই কাড়াকাড়ি। বেশ হট্টগোল করার একপর্যায়ে ওর বাবা পাশের রুম থেকে বেরিয়ে এসে  প্রথম থেকেই যাকে পেলেন, তাকে বেশ কয়েকটি  সজোরে চপেটাঘাত করে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় ওর ছোট্ট বোন আমতা আমতা করে বলল, 'পাপা, মোটি তো ইধার হ্যায়!' ওর বাবা মারতে এসেছিলেন হারপ্রিতকেই, কিন্তু অন্ধকার ঘরে যাচ্ছেতাই মারলেন আদরের বড় মেয়েকে। কারণ, ও বাবার উপস্থিতি টের পেয়ে আগে থেকেই বিছানা থেকে সটকে খাটের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। একে তো রাতের অন্ধকার! রুমের লাইট নেভানো। আর ওরা তিন বোন সব সময় শুত পালাক্রমে প্রথমে হারপ্রিত, ছোট, এরপর বড় বোন। কাজেই ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের অনুমান ঠিক থাকলেও এ যাত্রায় তার ভুল করার মাশুল দিতে হলো বড় মেয়েকে। বেচারি! মার খেয়ে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে লাগল।

ফ্রেঞ্চ ভ্যানিলায় চুমুক দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলার একপর্যায়ে বলে, 'মুখ থেকে হাত সরাও, দেখতে পাই না। কথা বলার সময় চোখাচোখি না হলে কথোপকথনের আগ্রহ চলে যায় আমার!'

আমি ওর কথায় কিছুটা অবাক হলেও ত্বরিতকর্মা হলাম। বাইরে তাকিয়ে আমি দেখছিলাম বাইক রাইডাররা সবাই টিম হর্টনসের সামনে জটলা পাকিয়েছে। এরা মূলত একদল বাইকচালক, যারা দল বেঁধে একসঙ্গে ঘুরে বেড়ায় গ্রীষ্মকালজুড়ে। প্রথমবারের গ্রীষ্মের ছুটিতে যখন ক্লাস শেষে (গ্রীষ্মকালীন কোর্সের)   ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরছিলাম, তখন বাস থেকে এই বিশাল গ্রুপকে দেখি আর ভাবছিলাম এই গুন্ডাগুলোকে পুলিশ অ্যারেস্ট করছে না কেন? পরে কানাডিয়ানদের সঙ্গে গল্প করার সুবাধে জানলাম এরা শখের বশে ঘুরে বেড়ায় আর কোথাও এক জোট হয়ে আড্ডা দেয়। যেমন—শখের বাইসাইকেলচালকরা যে রকমভাবে আমাদের দেশের এক জেলা থেকে আরেক জেলায় ঘুরে বেড়ায়।

ওদিকে গল্পের ঝাঁপি খুলে বসেছিল হারপ্রিত—স্কুটি চালিয়েই যেত কলেজে। আরেক দিন নাকি এক ছোট্ট কুকুরের বাচ্চাকে মেরে দিয়েছিল। না, সে রকম কিছু হয়নি। ধাক্কাটা লেগেছিল বেশ সজোরেই, কিন্তু দৈব বলে বেঁচে যাওয়া পাপীটি শুধু কাউ কাউ করতে করতে সরে গেল। আর ও একরকম হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

ক্লাসের পরে প্র্যাকটিক্যাল নিয়ে পড়েছিলাম সমস্যায়। গণিতের মারপ্যাঁচ কখনোই মাথায় ঢুকল না। ওকে বললাম দেখিয়ে দিতে। বিকেল পাঁচটা। যথাসময়ে এল। হলদে রঙের সোয়েটারের সঙ্গে ব্লু জিন্স। আজকে চুল খোলা রেখেছে। জিজ্ঞেস করায় জানাল, আধা ঘণ্টা আগেই স্নান সেরেছে, তাই চুল পুরোপুরি শুকায়নি। ওকে না জানিয়েই ক্যানটিনে গিয়ে নিয়ে এলাম কফি—এটা অবশ্য নরমাল কফি, দুধ আর চিনি দিয়ে। কে জানে পছন্দ হবে কি না? লাইব্রেরিতে বসে আছি। আর প্র্যাকটিক্যালের টুকটাক অঙ্ক দেখিয়ে দিচ্ছে। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে কফিতে  চুমুক দিচ্ছে। ওর মোটা মোটা ঠোঁট একবার ভিজছে আর কফির কাপে ওর লিপস্টিকের দাগ রেখে যাচ্ছে। পুরোটা শেষ করে আমায় বলে, 'আমার রেড লিপস্টিক আছে না পুরোটাই গেছে?' পড়ার পাট চুকিয়ে গেলে বললাম, 'চলো, বাজার করতে হবে। ওয়ালমার্টে যাই।' হারপ্রিত  বলল, ওরও কেনাকাটা আছে। ইউনিভার্সিটি থেকেই বাসে চেপে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে।

এত বিশাল ওয়ালমার্টে  জিনিসপত্র খুঁজে পাওয়াটাই তো একটা ধাঁধা। সঙ্গে কেউ থাকলে সময়টা কেটে যায় বেশ। শপিং শেষে বাইরে এসে হিম শীতে জমে যেতে লাগলাম। বাসের তো দেখা নেই। ও বলল, হেঁটেই যাওয়া যাক! ঠিক করলাম হেঁটেই যাব। কিন্তু মাঝপথে এসে বলতে লাগল, আর হাঁটতে পারবে না। দেখলাম আসলেই দুধের অত বড় ক্যান নিয়ে কষ্টই হচ্ছে বেচারির। ট্যাক্সি কল করলাম। সাত মিনিটের ব্যবধানে হাজির ড্রাইভার। হারপ্রিত দূর থেকেই এক পলক দেখেই বলে দিল—'আরে, এটা তো অমর!' আমি আর অমর একসঙ্গেই জয়েন করি ওয়ালমার্টে। ওর ব্যবহার বরাবরই খটমটে আর আজকে আমাকে দেখল এক মেয়ের সঙ্গে। রাগ গেল আরও বেড়ে, কিন্তু ভদ্রতার গ্যাঁড়াকলে পড়ে বেচারা কিছুই করা তো দূরে থাক, আমাদের দুজনকেই সসম্মানে বাসায় পৌঁছে দিল।

নর্থ সিডনি যাওয়ার পথে একটা লেক পড়ে, পোটল লেক। ওই দিন রৌদ্রস্নাত দিন ছিল না মোটেই, আর আকাশের মেঘের সঙ্গে দূরের পোটল লেকের দিগন্তের রেখা লিন হয়ে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে। এসব আমার দৃষ্টিগোচর না হলেও হারপ্রিতের কৌতূহলী চোখ ঠিকই খুঁজে নিল। দূরের বাড়িগুলোকে ছবির মতো মনে হয়। অধিকাংশ বাড়ির সামনে চেয়ার সাজানো রয়েছে। আরাম কেদারায় বসে বাইরে লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে কফির গ্লাসে একটা হালকা চুমুক দেওয়ার অভিজ্ঞতাকে এক বাক্যে বলে বোঝানো যাবে না। অনেক বাড়ির সামনে পোষা কুকুর খেলছে আপন মনে। দূরের মুনরো পার্কে ছেলেমেয়েরা ফুটবল খেলায় মেতে উঠেছে। যেন লাইভ ম্যাচ চলছে! তার পাশে সারিবদ্ধভাবে নোঙর করা জেলেদের জাহাজ। কোনোটা  নীল, কোনোটা কমলা, বা হলুদ, আবার কোনোটা সবুজ রঙের। হরেক রকমের রঙের পসরা সাজানো রয়েছে।

আমরা বেশ খোশগল্পে মজে ছিলাম। ও বলল, পারলে একটা ছবি তুলে দাও। আমি তেমন কোনো আগ্রহ না দেখালেও ও বারবার বলতে লাগল, 'কিতনা সুন্দর হ্যায়!' তারপর জায়গা ছেড়ে একটু উঠতেই বলে, 'রেহনে দোও।' (লাগবে না)

যাওয়ার পথে যে রাস্তাটা পড়ে, সেটা একদম লেকের কোল ঘেঁষে। যদি একটু এদিক–ওদিক হয়, তাহলে সোজা সাগরে সলিল সমাধি! হ্যাপির সাগরের দিকে তাকিয়ে বলে ওই খাদের কিনারা ওর মনের কোণে লুকিয়ে থাকা অজানা ভয়কে ইশারায় ডাকে। ওর কেমন জানি ভয় ভয় করে! আমি ওকে এই বলে আশ্বস্ত করলাম, বাসে থাকতে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। বরং বাসের সঙ্গে ধাক্কা লেগে অন্য যেকোনো গাড়ি  অথই সাগরে হারিয়ে যেতেই পারে! আমাদের কিচ্ছু হবে না!

সুমন অ্যাপ্লাই করেছে পাসপোর্ট রিনিউয়ের। আমরা একসঙ্গেই থাকি। তাই যেতে হবে পোস্ট অফিসে। কাগজপত্র জমা দেব। দুজনেই গাড়িতে চেপে ডাউনটাউন সিডনির পথে রওনা হয়েছি। মাঝে হারপ্রিতের কল, ফোন রিসিভ করে শুনলাম একদম শুদ্ধ বাংলায় জিজ্ঞেস করে—'কোথায় আছ তুমি?'

বললাম, আমি তো ডাউনটাউনে যাই। কেন? কী হয়েছে?

হারপ্রিত—না, এমনি! শিফট আছে?

আমি—না, আজ তো নেই। তোমার?

হ—না, নেই! কী করছ?

আ—সুমনের একটা দরকারে এসেছি। ওর কানাডা পোস্টে কাজ আছে।

হ—মুঝে সামাঝ নেহি আ রাহি হ্যায়! ( আমি বুঝতে পারছি না)

বুঝলাম ওর বাংলা ভাষার স্বল্প ভান্ডার শেষ হয়েছে!

আ—ওকে! সুমন কা কাম হ্যায়, ইস লিয়ে কানাডা পোস্ট মে আয়ে হ্যায়।

হ—সাম কো ফ্রি হো?

আ—হম... ক্যায়া হো গ্যায়া?

হ—কফি পে চ্যালে?

আ—ওকে! চলতে হ্যায়।

সময় ঠিক হলো সন্ধ্যা সাতটায়। আমার একটা কাজে ইউনিভার্সিটিতে যেতে হয়েছে। বাসের লাইনে দাঁড়িয়ে শীতের শুভ্রতার পরশে রোমাঞ্চিত আমি! সারিবদ্ধভাবে অসংখ্য বুটের ছাপের দাগ পড়ে আছে বরফের চাদরে ঢাকা রাস্তায়। আগের ছাত্রছাত্রীরা লাইনে দাঁড়ানো দেখে স্কুলজীবনের পিটি ক্লাসের কথা মনে যাচ্ছে। পার্থক্য এই যে ওখানে দাঁড়াতে হতো কাঠফাটা রোদের নিচে, আর এখানে ঠিক তার বিপরীত! সূর্যদেবের অপার আশীর্বাদে কড়া রোদে পুড়ে মাথা চুয়ে ঘামের ফোঁটা মাটিতে পড়ত টপ টপ করে আর এখানে মহেশ্বরের কৃপায় হিমালয়ের আভাস পেতে পেতে হিম ঠান্ডায় জমে বরফ হয়ে যাচ্ছি! ফেরার পথে বাসে উঠে বসে ভাবছি, ও কোথায়?  ফোন দেওয়ার কথা ভাবতে ভাবতেই জ্যাকেটের পকেটে হাত রাখা মাত্রই মুঠোফোন বেজে উঠল। ওর ট্যালিপ্যাথির জোর আছে। কেন এমন বলছি?  যখনই ভাবছি কল করব, তখনই যদি সেই ব্যক্তির কল চলে আসে, এটাকে বলে ট্যালিপ্যাথি! আজ এ নিয়ে নয়বার এমন হলো। এত স্বল্প সময়ে অন্য কারও সঙ্গে এমন হয়েছে বলে মনে হয় না।

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। টিম হর্টনস, গ্র্যান্ড লেক রোড।

আজকে পৌঁছে যে টেবিলে বসলাম, ওখানে গুঁড়ি গুঁড়ি খাবারের দানা পড়ে আছে। টিস্যু ন্যাপকিন খুঁজতে লাগলাম। ও এসবের ধার ধারে না, পাশের চেয়ারে ব্যাগ রেখে বসে পড়ল। টেবিল পরিষ্কার করে জ্যাকেট খুলে চেয়ারে বসতেই আমার নীল টি–শার্টের দিকে চোখ ওর। বেশ আবদার করে বলল, অমন টি–শার্ট  চাই! এটা ইউনিভার্সিটি থেকে দিয়েছে। অফিশিয়াল টি–শার্ট। বিভিন্ন দিনে ভিন্ন ভিন্ন উপলক্ষকে সামনে রেখে টি–শার্টের প্রচলনটা তেমন নতুন কিছু  না! তাই আরেকটা জোগাড় করা প্রায় অসম্ভবের পর্যায়েই পড়ে। যারা অফিসে কাজ করে এগুলো শুধু তাদের জন্যই। যার সোজাসাপ্টা মানে হলো এমন আরেকটা টি–শার্টের দেখা পেতে অপেক্ষা করতে হবে আগামী বছর পর্যন্ত। কথা বলার একপর্যায়ে চোখে পড়ল ওর ফোনের কার্ড হোল্ডারের অবস্থা শোচনীয়। যে জায়গায় চারটার বেশি কার্ড রাখা যাবে না, সেখানে ও রেখেছে আটটা! বললাম, কিছু কার্ড কমিয়ে ফেল। না হলে আমও যাবে, ছালাও যাবে!

সামনের টেবিলে বুড়ো-বুড়ির কথা–কাটাকাটি চলছে। দেখে বললাম, 'দেখো, তোমার দাম্পত্যজীবন কেমন যাবে!'

ও বলল, 'এমন কাউকে বিয়ে করব, যে আমার সম্পর্কে তেমন কিছু জানবেই না। ঝগড়ার প্রশ্ন আসছেই না।'

আজকের মেনুতে ছিল—ক্রিসপি চিকেন র‍্যাপ্ট, স্ট্রবেরি মাফিন আর যথারীতি ওর ফ্রেঞ্চ ভ্যানিলা উইথ অ্যাক্সপ্রেসো শট। আমি ফ্রেঞ্চ ভ্যানিলা, চকলেট মাফিন, চকলেট কুকিস।

খেতে বসে যখন কফিতে বিস্কুট ডুবিয়ে খাচ্ছি, তখন জিজ্ঞেস করল, 'তুমি কি মিষ্টি খেতে বেশি পছন্দ করো?'

আমি—কই? না তো! আজকের মেনুটাই এমন নিয়েছি। কী ভাবছ? গ্র্যাজুয়েশনের পর কোথায় যাবে?

হা—না, তেমন কিছুই ভাবিনি। ওয়ালমার্টের পর যেকোনো কল সেন্টারে ট্রাই করব। বাকি বিষয় নিয়ে কিছু ভাবছি না এখন, পিআর (পারমানেন্ট রেসিডেন্সশিপ)। আমার তেমন কোনো টেনশন নেই। আর তুমি কী ভাবছ?

আ—দেখি, কী হয়? একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবেই! হ্যালিফ্যাক্সের দিকে চলে যাব ভাবছি। আর এরপর? বিয়ে? বয়ফ্রেড? কেউ আছে?

হা - না, নেই! বাবা যা বলবেন, তাই করবো।

আ - মানে? তোমার বড় বোনের বিয়ে কি এভাবেই হয়েছে?

হা - না, ওর বয়ফ্রেন্ড আছে। বিয়ে এখনও হয়েছে কই? সাত বছর প্রেম করার পর ও প্রথমবারের মতো আমার জামাইবাবুর বাড়িতে গেল সবার সঙ্গে পরিচিত হতে। আর ওর অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর ছিল না।

আ—কেন?

হা—দিদি ক্যাজুয়াল ড্রেসে চলে গিয়েছিল। ওর হবু শাশুড়ি জিজ্ঞেস করে বসল, 'তুমি কি এভাবেই চলাফেরা করো?'

ওকে চাকরি থেকেই যেতে হয়েছিল, তাই সম্ভব হয়নি। কিন্তু তাঁরা বিষয়টা ভালোভাবে নেননি। প্রথমে ওদের বিয়ে হয়ে যাক। তারপর বাবা নিশ্চয়ই আমার জন্য পাত্র দেখবেন। আমি সময় নেব বছরখানেক। তারপর বিয়ে হবে।

আ—আচ্ছা, বুঝলাম। মানে বাবার কথাই শেষ কথা। নিজের কোনো পছন্দ নেই? তোমার পছন্দের ছেলেকে কি উনি মেনে নেবেন?

হা—হ্যাঁ, নেবেন। তবে উনি সব সময়ই একটা কথা বলেন,

'জীবনের প্রতি পদক্ষেপ নেওয়ার আগে অন্তত একবার আমার মাথার পাগড়ির কথা মনে রাখবে!' তাই তাঁর কথার অবাধ্য হয়ে আমি কোনো কাজ করতে পারব না।

শিখ সম্প্রদায়ের পুরুষ অনুগামীরা নিজেদের পাগড়িকে জীবনের এক আবশ্যিক অনুষঙ্গ করে আজীবন চলেন। একজন শিখকে চেনার উপায় হলো—পাঁচটি 'ক', কেশ, কারা (ডান হাতে পরার বিশেষ বন্ধনী), কৃপাণ (ছোট তরবারি), কাশেরা (বিশেষ ধরনের অন্তর্বাস) এবং কঙ্গ (পাগড়ির সঙ্গে থাকা চিরুনি)। শিখরা সাধারণত চুল কাটেন না। শুধু তা–ই নয়, তাঁরা দাড়ি বা চুলের ওপর কাঁচি চালান না এবং এটাকে তাঁরা সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস বলে মনে করেন। পাগড়ি তাঁদের দীর্ঘ কেশরাশিকে ধুলাবালি থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রেবিশেষ সুবিধা দেয়। প্রধানত তাঁরা সাদা, কাল ও নীল রংকে প্রাধান্য দেন। লাল রঙের পাগড়ি পরা হয় শিখদের বিয়েতে। এখানে আসার পর আমার প্রথম রুমমেট ছিল জগদ্বীপ, ও মাথায় পাগড়ি পরতে পাক্কা আধা ঘণ্টা সময় নিত। তা যা-ই হোক, পরীক্ষা হোক, পার্টি হোক আর ক্লাসেই যাওয়া হোক! পাগড়ি পরায় ওর আনুগত্যতা ছিল সত্যিই মনে দাগ কাটার মতো একটি বিষয়!

এখন কফিবালিকার কথোপকথনে ফেরত আসি।

আমি—আর ধরো কেউ যদি তোমাকে ভালোবেসে ফেলে, তখন কী করবে?

হা—তাকে বুঝিয়ে বলব, কেন এটা সম্ভব না।

আমি—কিন্তু ওই ছেলে যদি তোমার প্রতি কমিটেড থাকে, তাহলে কী হবে?

হা—এ ক্ষেত্রেও ওকে ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলতে হবে। আর কিছু করার নেই।

আ—মানে তোমার কাছে সত্যিকারের ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই?

হা—ও মা! এমন আমি কখন বললাম? আছে, অবশ্যই আছে। আমি অবশ্যই তাকে মনে কষ্ট দিয়ে বা সে দুঃখ পাবে, এমন কিছু কখনো করব না। যদি সেই ব্যক্তি সত্যি আমাকে মনেপ্রাণে ভালোবেসে থাকে তাহলে আশা করি, সে আমার অবস্থাটা বুঝতে পারবে। 

এরপর আরও অনেক বিষয় নিয়ে কথা হলেও ওর এই কথাগুলোই মনে গেঁথে রইল।

পরের দিনে আমার ডিউটি পড়ল পেটসে। মানে যে ডিপার্টমেন্টে গৃহপালিত পশুপাখির খাবার ও যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যায়। আমি যথারীতি কাজে ব্যস্ত সময় পার করছি। দেখলাম আমার অধ্যাপক ম্যালিসা কোনো কাজে ওখানে এসে হাজির। হঠাৎ ম্যালিসাকে এত কাছ থেকে শপিং করতে দেখার অভিজ্ঞতা এই প্রথম! তাই কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদিকে কোনো জিনিস খুঁজতে  এল রুচি আর হারপ্রিত। আমাদের দুজনকে কথা বলতে দেখে ওরাও শেষ গল্পে যোগ দিল। বেশ জমে উঠল আমাদের কথাবার্তা। তবে এভাবে ডিউটি করার সময় গল্প করাটা খুব একটা সমীচীন নয়। তাই ম্যালিসা অন্য কাজের কথা বলে চলে গেল। রুচিও চলে যাচ্ছিল। ওদিকে কফিবালিকা আমার কাছে এসে বলল, 'এসেছ কখন? কিছু জানালে না যে?' আমি বললাম, ব্যস্ত ছিলাম। তাই সময় পাইনি। ও চলে গেল তখনই, কিন্তু মনে হচ্ছিল ওকে কিছু কথা বলার ছিল। যাক, কী আর করা? এই ভেবে যখন কাজে মন দিয়েছি, তখনই মেসেজ এসেছে—'রেজিস্ট্রার নম্বর ছয়ে আসো আর হাই বলে যাও!'

কিছু মুহূর্ত মনে অকারণে স্থায়ী হয়, এখন এমনই একটা মুহূর্তের কথাই বললাম। জীবনে কারও উপস্থিতির প্রত্যাশা ছিল তখন আর তাই হয়ে এসেছিল হারপ্রিত। ওর জীবনে আমার উপস্থিতিও তেমনই কিছু। এখনকার কঠিন বাস্তবতার সময়ে কারও কাছে বিশ্বাস অর্জন এবং তা রক্ষা করা দুটোই বেশ কঠিন কাজ। আবার এটাও ভাবা ঠিক নয়, যার প্রতি আমার অগাধ বিশ্বাস, সে তার মূল্যায়ন সেভাবেই করবে। জীবন অনেক বিচিত্র ঘটনাচক্রের আবর্তে থাকার জায়গা, আর প্রতি পরতেই জড়িয়ে আছে মায়ার রহস্যময়তা! কাজ থেকে ফিরে রাতে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই রাজ্যের যত চিন্তা এসে ভিড় করছিল মনের জানালায়। আর ওটা খুলে দিতেই মনে হলো প্রতিটা মুহূর্ত আমার সঙ্গে খোশগল্পে মজে উঠেছে।

সাউথবার। উইটনিপিয়ারের এ জায়গা থেকে সিডনি পোর্ট আর নর্থ সিডনি পোর্ট দেখার দৃশ্য অসাধারণ। ছোট্ট এ শহরের আর কোনো জায়গা থেকে দুই প্রান্তের দৃশ্য দেখা যায় কি না, জানা নেই। এর পরেরবার এলে হারপ্রিতকে অবশ্যই বলব। আজকে কি ওর জব আছে? ফোন দিয়েও ওকে পাওয়া গেল না। হয়তো ব্যস্ত। খুব একটা ভাবলাম না এ নিয়ে আর। সোজা চলে গেলাম সাউথবারে সূর্যাস্তের সময়টায়।

কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে ওকে ফোন করলাম, কিন্তু ফোনে রিং বেজেই চলল। কেউ রিসিভ করছে না। কেন রিসিভ করছে না, তা চিন্তা করতেই দেখি ওই ফোন দিয়েছে, কিন্তু ফোনের কণ্ঠস্বরটা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

ওপাশ থেকে বেশ দরাজ কণ্ঠের এক পুরুষ বলে উঠলেন, 'আই অ্যাম পুলিশ ইন্সপেক্টর রেইলি ম্যাকনিল। মে আই নো হু আর ইউ?'

সেকেন্ডের মধ্যেই আমার কাছে সম্পূর্ণ পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে গেল।

তারপরও যতটা সম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, 'আই অ্যাম হারপ্রিতস ফেন্ড'

পুলিশ ইন্সপেক্টর—মে আই নো হাউ ডু ইউ নো হার?

আ—ও আমার ক্লাসমেট আর আমরা একসঙ্গেই ওয়ালমার্টে কাজ করি।

পু—তুমি কি পুলিশ স্টেশনে আসতে পারবে? তোমার সঙ্গে কথা ছিল।

আ—হ্যাঁ, অবশ্যই কিন্তু কী হয়েছে জানতে পারি?

পু—আজ দুপুর তিনটে নাগাদ নর্থ সিডনি যাওয়ার পথে পোটল লেকের পাশে একটা গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটেছে। সাদা রঙের হুনডাই কার অপর দিক আসা আরেকটা গাড়িকে সাইড দিতে গিয়ে খাদে পড়ে যায়।

আ—মানে? ও এখন কোথায়? 

পু—আমাকে দুঃখের সঙ্গে জানাতে হচ্ছে যে ওই গাড়ির কোনো যাত্রীই জীবিত নেই!

আমি আর কোনো কথা বলতে পারলাম না। শুধু স্যরি বলার পর দেখা করব বলে ফোনটা রেখে দিলাম!

মুহূর্তের মধ্যেই সূর্যাস্তের লালাভ রেখাগুলো যেমন মিলিয়ে যেতে যেতে ক্রমশ চারদিকে আঁধার ঘনিয়ে আসছিল, তেমনি আমিও স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললাম। মনে হল কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দেওয়া মুহূর্ত আমায় সবেগে গ্রাস করছে!

ওর কথাগুলো কানে ভেসে আসছিল, 'ডান দিকের ওই গভীর খাদটা না আমার খুব ভয় করে। মনে হয় এই বুঝি পড়ে গেলাম!' বাঁ চোখের কোণে ক্রমশ জমতে থাকা লোনাজলের বিন্দু গড়িয়ে পড়ল!

কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। গলা শুষ্ক হয়ে আসছে আর পানির পিপাসার তীব্রতা অনুভূত হচ্ছে। আমাদের স্বল্প সময়ের বর্ণিল স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে আসতে লাগল। হারপ্রিতের সেই অমলিন হাসি আর কফিতে চুমুক দেওয়ার ফাঁকে কাপে রেখে লিপস্টিকের গাঢ় দাগ আরও প্রগাঢ় হতে লাগল চোখের সামনে। কেন এমন হয়? কেন প্রিয় মানুষগুলো নিমেষেই হারিয়ে যায়?

'সময় তুমি বড় নিষ্ঠুর! আমার স্বল্প সময়ের সুখের নীড়ে হানা দিয়ে সব দুমড়েমুচড়ে দিয়েছ!'

ভাবতে ভাবতে ঘামে ভিজে আসছে আমার টি–শার্ট। আর তখনই মুঠোফোনটা আচমকা বেজে উঠল!

ওপাশ থেকে পরিচিত কণ্ঠস্বর বলল, 'গুড মর্নিং, কোথায় আছে তুমি?' (আছকে ওরা আছে বলে)

বললাম, 'এই তো বাসায়, কী হয়েছে?'

'আমার শিফট আছে। ১১টা থেকে। মুঝে ছোড় দো গে? (আমায় একটু নামিয়ে দিয়ে আসবে?)।'

বললাম, 'হ্যাঁ, ঠিক আছে! আসছি।'

ফোনটা রাখার পর দেখলাম আমার পুরো গেঞ্জি ঘামে ভিজে চুপসে গেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্নানটা সেরে নিলেই ভালো হয়। ওদিকে কেউ অধীর আগ্রহে আমার ড্রাইভের অপেক্ষায় আছে!