বার্সেলোনায় মৃতদের নগরীতে একদিন

বার্সেলোনার সমাধি নগর। ছবি: লেখক
বার্সেলোনার সমাধি নগর। ছবি: লেখক

বছরে দুই ঈদের প্রতিটিতেই ঈদের নামাজ শেষে কিংবা জুমাবারে, না হয় ধর্মীয় বিশেষ আচার-অনুষ্ঠানে সবাইকে দেখতাম কবরস্থানে যাঁর যাঁর প্রিয়জনের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে অথবা দূর থেকে কবর জিয়ারত করছেন। আমিও যখন বাবার সঙ্গে কবর জিয়ারতে যেতাম, তখন ছোট ছিলাম বলে বাবা তাঁর হাতের আঙুলের ইশারায় বলতেন, ‘ওই যে বাঁশঝাড়ের নিচে কবরটি দেখছো, ওটা তোমার দাদার কবর, আর ওদিকে উঁচু বৃক্ষটির নিচে যে কবরটি দেখছো, ওটা তোমার দাদির।’ নির্জন কবরস্থানের ওই বাঁশঝাড় অথবা উঁচু বৃক্ষটির নিচেই আমার প্রিয় দাদা-দাদি শুয়ে আছেন, এটাই জেনে এসেছি সারা জীবন। আমার বাবাও জীবনভর ওই নির্দিষ্ট জায়গাটিকেই তাঁর প্রিয় মা-বাবার কবর জেনে এসেছেন। যদিও দাদার মৃত্যুর সময় আমার বাবার বয়স ছিল মাত্র ২১ দিন। ২১ দিনের শিশু বড় হয়ে পরিবারের কারও কাছ থেকে মৃত বাবার কবরের অবস্থান জেনে প্রিয় মা-বাবার কবরস্থান হিসেবে চিহ্নিত করে আসছেন। আজকাল হয়তো অনেকেই কবরে নামফলক লাগিয়ে রাখেন। একসময় তা সচরাচর কম দেখা যেত। কারণ হিসেবে দেখা গেছে, তাতেও ধর্মীয় বিধিনিষেধ রয়েছে।

অনেক আগে মিসরীয়দের মধ্যে কেউ মৃত্যুবরণ করলে তারা নির্দিষ্ট জায়গায় লাশ দাফন করে লাশের ব্যবহৃত অলংকার-গয়না, টাকাপয়সা সবকিছু লাশের পাশেই রেখে আসত এবং এর জন্য একজন পাহারাদার স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া হতো। কালের পরিক্রমায় তাঁদের এ সংস্কৃতিতে তারা পরিবর্তন আনল। মৃত ব্যক্তির ব্যবহৃত অলংকার-গয়নাগাঁটি, টাকাপয়সা ও মূল্যবান জিনিসপত্র পাহারাদার দিয়ে সার্বক্ষণিক নজরদারি, আর্থিক ব্যয় ও ঝুঁকির পরিবর্তে কেউ মারা গেলে তখন তারা মৃতদেহ নিজ বসতঘরেই সমাধিস্থ করা শুরু করল। এখনো কায়রোতে অনেক বসতঘরের কক্ষের সঙ্গে মৃতদের অনেক কবর বা সমাধি রয়েছে দেখা যায়। আমাদের দেশেও পরিবারের কেউ মারা গেলে অনেকেই নিজ বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে কবর দিয়ে থাকেন।

আমাদের এ চিরায়ত লাশ দাফনপদ্ধতি ছাড়াও ভিন্ন উপায়ে লাশ সুবিন্যস্ত ও পরিপাটি করে সাজিয়ে নাম/ঠিকানাসহ নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় কীভাবে রাখা যায় তারই নিদর্শন দেখে এলাম সে দিন।

দেড় লাখ সমাধি আছে বার্সেলোনা মন্টজুইক সিমেট্রিতে। ছবি: লেখক
দেড় লাখ সমাধি আছে বার্সেলোনা মন্টজুইক সিমেট্রিতে। ছবি: লেখক

আমার বন্ধু শাহ ইমরান ও আমি সেদিন ঘুরতে বেরিয়েছিলাম সিমেট্রি/সমাধি (কবর) দেখতে। ট্যাক্সি ক্যাবে করে গন্তব্যে পৌঁছার পর রিসেপশন থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য ও ম্যাপ নিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম সিমেট্রিতে। ভূমধ্য সাগরের কোল ঘেঁষা বার্সেলোনা মন্টজুইক সিমেট্রি (Cementerio de Montjuic) পুরো মন্টজুইক পাহাড়ের ৫৭ একর বা ২৩ হেক্টর জায়গাজুড়ে৷ পাহাড়ের একদম নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত ১০ তলাবিশিষ্ট সিমেট্রি এবং প্রত্যেক তলায় ছয়/সাত তলাবিশিষ্ট সমাধি রয়েছে। পুরো সিমেট্রি মিলে ১ লাখ ৫০ হাজার লাশ বা মৃতদেহের সমাধি রয়েছে সেখানে। বিমানবন্দরের আদলে তৈরি প্রত্যেক তলাতেই রয়েছে মৃতদের ফ্ল্যাট। প্রত্যেক ফ্ল্যাটেই রয়েছে আলাদা আলাদা কফিন সাইজের ছোট ছোট ঘর। এসব ঘরে মৃতদেহ রেখে বাইরে থেকে ইট-সিমেন্ট দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় জানালা। তারপর সেই জানালায় এঁটে দেওয়া হয় নামফলক। এখানেও রয়েছে রোড নম্বর, হাউস নম্বর, ব্লক ও ফ্ল্যাট নম্বর সব। নেই শুধু কলবেল!

বার্সেলোনা মন্টজুইক সিমেট্রিতে লেখক। ছবি: লেখক
বার্সেলোনা মন্টজুইক সিমেট্রিতে লেখক। ছবি: লেখক

এখানে যাঁরা আসেন একান্ত নিজ থেকেই আসেন। না হলে সচরাচর তেমন কাউকে আসতে দেখা যায় না। একজনকে দেখলাম, অনেকগুলো ফুল পরম যত্নে একটি সমাধির ওপর রেখে একাকী আনমনে দাঁড়িয়ে আছেন। হয়তো তাঁর প্রিয়জনের সঙ্গে না বলা অনেক কথাই শেয়ার করছিলেন। নয়তো প্রিয় মুখটির জন্য হৃদয়ের গহিন থেকে একরাশ শূন্যতা ও হাহাকার তাড়া করছিল তাঁকে। অনেকগুলো সমাধি দেখলাম অযত্নে আর অবহেলায় পড়ে থাকতে। হয়তো বছরের পর বছর কেটে গেলেও আপনজনের কেউ কোনো খোঁজ নিচ্ছে না৷ অধিকাংশ সমাধিই ফুল ছিটিয়ে পরিপাটি করে রাখা।

চারিদিক শূন্য, রাস্তাগুলোও ফাঁকা, মাঝেমধ্যে মৃতদের অ্যাপার্টমেন্টগুলোর সামনে দিয়ে হঠাৎ দু-একটা গাড়ি চলতে দেখা যায়। জনমানবহীন বিশাল নগরজুড়ে শুধু মৃতদের বসবাস। পাহাড়, সমুদ্র ও আকাশের মতো বিশালতার মাঝে মৃতদের নগরীর নির্জনতায় ক্ষণিকের তরে হারিয়ে গিয়েছিলাম। দেড় লাখ মৃতদেহের মাঝে কত শত জ্ঞানী, গুণী ও বিখ্যাত, যাঁরা সবাই আজ এই পৃথিবীর ঝঞ্ঝাট থেকে নিরাপদে বহুদূরে!