আমেরিকার অদ্ভুত কিছু ব্যাপার-স্যাপার

লেখক
লেখক

ভৌগোলিকভাবে আমেরিকা বাংলাদেশের ঠিক উল্টো দিকে অবস্থিত। এ কারণে আবহাওয়া ও প্রকৃতির তারতম্যের পাশাপাশি সংস্কৃতি, প্রথা বা রীতিরও রয়েছে অনেক পার্থক্য। আমেরিকায় আসার পর এসব দেখে একটু অদ্ভুত লাগলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব গা সয়ে যায়। এ রকম কিছু আপাত অদ্ভুত কিন্তু স্বাভাবিক হয়ে যাওয়া বিষয় নিয়ে আজকের লেখা।

১.
আমেরিকানরা শূন্য বা জিরোকে উচ্চারণ করে ইংরেজি বর্ণ ‘ও’। যেমন এক শ পাঁচকে ওরা বলবে ‘ওয়ান ও ফাইভ’। এটার কারণ কী, কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেও সদুত্তর পাইনি। একজন বলল, সম্ভবত ‘জিরো’তে দুটি সিলেবল, ‘ও’–তে একটা সিলেবল; উচ্চারণ করতে মিলি সেকেন্ড বেঁচে গেল আরকি। একইভাবে ইংরেজি বর্ণমালার শেষ অক্ষর আমরা জেড বলি, ওরা বলে ঝি।

২.
সবার নাম তিন শব্দের হলেও কাগজে–কলমে সব সময় দুটি শব্দই থাকবে, ফার্স্ট নেম এবং লাস্ট নেম। মিডিল নেম শুধু কাছের মানুষরাই জানে ক্ষেত্রবিশেষে। ডাকার ক্ষেত্রে একদম নিয়ম করেই ফার্স্ট নেম ধরে ডাকা হয় সর্বত্র। মজার ব্যাপার হলো প্রায় সবার নামই আবার ছোট করে ডাকা হয়। যেমন এডওয়ার্ড >এড, ডেভিড>ডেভ, জনসন>জন, মাইকেল>মাইক। এসব নাহয় বুঝলাম। কিন্তু রবার্ট>বব, রিচার্ড>ডিক, উইলিয়াম>বিল—এসব কীভাবে হয় এখনো বুঝি না।

৩.
কেনাকাটার ক্ষেত্রে যেকোনো কিছুর দাম বাংলাদেশের মোবাইলে কল রেটের মতো, সবকিছু ভগ্নাংশে থাকবে। আবার দামের কোনো সরলরৈখিক সম্পর্ক নেই। যেমন কোথাও একটা বার্গার কিনবেন ৩ দশমিক ৯৯ ডলারে, আবার কোথাও কিনবেন ৯ দশমিক ৯৯ ডলারে। যদিও স্বাদে তেমন কোনো পার্থক্য পাবেন না। একটা কোকের দাম দেখবেন ১ দশমিক ৯৯ ডলার, আবার এক কেস ১২টা কোকের দাম দেখতে পারেন ৩ দশমিক ৮৭ ডলার। সবজি আর মাংসের দাম প্রায় একই, ক্ষেত্রবিশেষে সবজির দাম বরং বেশি। গরুর মাংস যদি এক পাউন্ড কিনেন ৪ দশমিক ৫৭ ডলারে, পালংশাক এক বাক্সের দাম দেখতে পারেন ৪ দশমিক ৯৯ ডলার।

৪.
পানির চেয়ে কোকের দাম কম, পুরোনো কথা। কোকসহ সব ধরনের সফট ড্রিংকসের কমন নাম সোডা। রেস্টুরেন্টগুলোতে সোডার জন্য সাধারণত গ্লাস দিয়ে দেয়, নিজে ভর্তি করে নিতে হয় ভেন্ডিং মেশিন থেকে। আপনি চাইলে রিফিল করে নিতে পারেন ইচ্ছেমতো। মজার ব্যাপার হলো রিফিল করার সুযোগ থাকলেও একেক সাইজের গ্লাসের একেক দাম। যদি রিফিল করাই যায়, তাহলে কম দামে ছোট সাইজেরটি কিনে বারবার রিফিল করলেই তো হয়। আবার একটা ম্যাকডোনাল্ডে দেখলাম ছোট, মাঝারি আর বড়—সব সাইজের গ্লাসেরই দাম ১ দশমিক ২ ডলার। সব সাইজের গ্লাসের যদি একই দাম হয়, তাহলে আবার বিভিন্ন সাইজের দরকারই বা কী! আর যেসব রেস্টুরেন্টে কর্মীরা সার্ভ করে সেখানে কোকের গ্লাসের প্রায় ৯০ শতাংশ বরফ দিয়ে পূরণ করে দেয়, যদিও চাইলে রিফিল করে দেবে যত খুশি। আমেরিকানরা শীতকালেও সোডা পানের সময় বরফ যোগ করে। বুফে রেস্টুরেন্টগুলোয় একটা মেনুর যে দাম, পুরো বুফের দামই প্রায় একই। কোথাও হয়তো ১২ ডলারে একটা খাবার নেবেন, আবার বুফে রেস্টুরেন্টে ১১ ডলারে পুরো লাঞ্চ বাফে পাবেন।

৫.
পুরো বিশ্ব আন্তর্জাতিক একক বা এসআই একক ব্যবহার করলেও এরা করে এফপিএস (ফুট-পাউন্ড-সেকেন্ড) একক। পাউন্ড, ইঞ্চি, ফারেনহাইট নিয়ে শুরুতে একটু বিভ্রান্তিতেই থাকতে হতো আমাদের। দূরত্বের হিসাব মাইলে হলেও এরা বলে মিনিট বা ঘণ্টা হিসেবে। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা কত দূর জিজ্ঞেস করলে বলবে এই তো চল্লিশ মিনিট ড্রাইভ।

৬.
টয়লেটকে এখানে বলে রেস্টরুম। মাঝেমধ্যে ভাবি, মানুষ জরুরি কর্ম সম্পাদন করতে এখানে যায়, নাকি রেস্ট নিতে যায়। অবশ্য স্মার্টফোন হাতে আসার পর আক্ষরিক অর্থেই মানুষ বসে বসে রেস্ট নেয় বলা যায়। রেস্টরুমে পানি ব্যবহার করে না আমেরিকানরা, শুধু টিস্যু পেপার ব্যবহার করে। এমনকি হ্যান্ড শাওয়ারও থাকে না কোথাও। রেস্টরুমের ফ্লোরে পানি ফেলা রীতিমতো অপরাধ, পানির কোনো নির্গমন নেই।

৭.
যদি ৭০০ বর্গফুটের এক বেডের বাসা নেন, দেখবেন মাত্র ১৫০ বর্গফুট বেডরুম। বিশাল একটা লিভিং রুম (গেস্ট রুম) পুরো ফ্ল্যাট দখল করে থাকে আর তার সঙ্গে ছোট একটা বেডরুম।

৮.
রেস্টুরেন্টে কাউকে ট্রিট দিতে গেলে যাবে, কিন্তু যে যার বিল দিয়ে দেবে। আমরা যেটাকে বলি হিজ হিজ হুজ হুজ। একবার আমার রুমমেট দেশি–বিদেশি সবাইকে ট্রিট দিল। আমেরিকান বন্ধু আর তার বউ খেয়ে আমাদের আগেই উঠে গেল। খাওয়া শেষে সবার বিল একসঙ্গে দিতে গিয়ে শোনে তারা দুজন তাদের বিল দিয়ে চলে গেছে। আহা, দেশের বন্ধুরাও যদি এমন হতো!

৯.
কথায় কথায় থ্যাঙ্ক ইউ বলা এদের জন্মগত অভ্যাস। আমার বস যেকোনো কাজ করার পর এমনভাবে থ্যাঙ্ক ইউ বলে মাঝেমধ্যে ভাবি ফ্রি ফ্রি কাজ করছি নাকি আবার, পরের সপ্তাহে বেতন পাব তো! আবার কাউকে থ্যাঙ্ক ইউ বললে একেকজন একেক রকম উত্তর দেয়, যা শুনে বেশ মজা পেতাম শুরুতে। থ্যাঙ্ক ইউয়ের জবাবে নো প্রব্লেম, টেক ইট ইজি, ইউ বেট, উম হুম কেমন অদ্ভুত লাগত। বিদায় দেওয়ার সময় কেউ কেউ বলে হ্যাভ আ গুড ওয়ান, যা সম্ভবত হ্যাভ আ গুড ওয়ান ডে–এর সংক্ষিপ্ত রূপ।

১০.
জিমের (ব্যায়ামাগার) বাথরুমে গেলে লজ্জাশরমের মাথা আগেই খেয়ে ফেলা উচিত। একদিন অফিস জিমের বাথরুমের চেঞ্জিং রুমে গিয়ে দেখি বস শ্রেণির ইঞ্জিনিয়াররা শুধু অন্তর্বাস পরে বসে আছে। আরেকবার ভার্সিটির জিমে তো দেখলাম এক ভদ্রলোক বাথরুম থেকে বের হয়ে দিগম্বর হয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে লকার রুমে এসে কাপড় পরছে।

১১.
কমলার জুস খেতে তিতা লাগে এখানে। শুনেছি আসল কমলা থেকে বানায় বলেই এমন তিতা হয়। কারণ মেশিনে খোসাসহ ব্লেন্ড করে ফেলে একসঙ্গে। অবশ্য খারাপ লাগে না ভেবে যে কমলার নামে মিষ্টিকুমড়া দিয়ে তৈরি জুস না।

১২.
কোনো ডকুমেন্টে নাম লিখতে বললে নির্দেশনা থাকবে প্রিন্ট ইয়োর নেম। আমি তো শুরুতে প্রিন্টার কই পাব ভেবে দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। পরে জানলাম আসলে কলমেই লিখতে হয়।

১৩.
শূকরের মাংসের অন্য নাম হ্যাম হলেও হ্যাম বার্গার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হয় গরুর মাংসের। পরে জানলাম জার্মানির হ্যামবার্গ শহরের নামে এই বার্গারের নাম। আবার এগ রোলে ডিম ছাড়াও মাংস পেলে অবাক হবেন না। অনেক রেস্টুরেন্টে বার্গার বা স্যান্ডুচ অর্ডার করতে গেলে কেমন ব্রেড, কেমন সালাদ, কেমন সস, কেমন কিমা, কেমন বেক এ—রকম শত শত প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে জান রফাদফা হয়ে যাবে।

১৪.
আপনার গাড়ি তেলে চললেও রিফিল করতে যাবেন গ্যাস স্টেশনে, আর তেল ভরে ফিরে আসবেন। গ্যাস স্টেশনে গেলে কোন গ্যাসের ট্যাঙ্ক দেখবেন না, এই দেশে তেলের স্টেশনকেই গ্যাস স্টেশন বলে। পেট্রোল, গ্যাস, তেল—সবকিছুর সাধারণ নাম গ্যাসোলিনকে ওরা সংক্ষেপে গ্যাস বলে।

১৫.
আমাদের দেশে সুইচ নিচের দিকে চাপলে লাইট–ফ্যান চালু হয় আর এখানে উলটো। ওপরের দিক মানে অন, নিচের দিক অফ। প্রতিটা রুম, লিভিং রুম, কিচেনের কোনায় কানায় অনেকগুলো পোর্ট থাকে পাওয়ার লাইনের। আমার রুমের চার ওয়ালেই পোর্ট আছে।

১৬.
আমাদের দেশে মেয়েদের পারলার ছাড়া সাধারণ সেলুনে মেয়ে কর্মী দেখা যায় না। কিন্তু এখানে সেলুন মানেই মেয়েরা চুল কাটবে। আমি এখন পর্যন্ত কোনো ছেলে কর্মী দেখিনি সেলুনে।

১৭.
বাসা ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে দশ মাস, এক বছর এভাবে চুক্তিতে যেতে হয়। মাসিক চুক্তিতেও যাওয়া যায় কিন্তু ভাড়া পড়ে যায় প্রায় দেড় গুণ। অ্যাপার্টমেন্টের বাসাগুলোয় আবার অদ্ভুত ব্যাপার দেখা যায়। সব বেডরুমে লক থাকে না, কোথাও কোথাও মাস্টার বেড রুমে থাকে। আমার বর্তমান বাসায় এক রুমে লাইট–ফ্যান থাকলেও অন্য রুমে এসে দেখি লাইট ফ্যানের কোনো অপশন নেই। অগত্যা স্ট্যান্ডিং লাইট আর ফ্যান কিনে আনতে হয়েছে। লিফটে ওঠার সময় এখানে লিফটের পাঁচ এভাবে বলার দরকার হয় না দেশের মতো, এখানে লিফটের পাঁচ মানে পাঁচতলাই। দেশের মতো এখানে গ্রাউন্ড ফ্লোর বলে না, একতলাকে ফার্স্ট ফ্লোরই বলে।

১৮.
যেকোনো লোকালয়ে হরিণের আনাগোনা খুবই সাধারণ ব্যাপার। অনেক রাস্তায় হরিণ যাতায়াতের সতর্ককারী পোস্ট থাকে। রাতে গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে হরিণের সঙ্গে সংঘর্ষ সাধারণ দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে একটা। আমার নিজেরই একবার অভিজ্ঞতা হয়েছে।

১৯.
খাতা কিনতে গেলে পুরো সাদা খাতা পাওয়া কঠিন। এখানে বেশির ভাগ খাতাই রোল করা, আমরা দেশে স্কুলে থাকতে বাংলা হাতের লেখা জমা দিতাম যেসব খাতা, ওই সব। আমার বেশ অস্বস্তি হতো ওই সব খাতায় লিখতে। দেশ থেকে কয়েকটা সাদা খাতা নিয়ে আসায় আমার পুরো গ্র্যাজুয়েট জীবন পার করা গেছে আরামে। ছাত্রছাত্রীরা কলমের পরিবর্তে পেনসিল বেশি ব্যবহার করে দেখেছি। দেশে পেনসিলের ব্যবহার আমরা শুধু জ্যামিতির কাজে বা গ্রাফ আঁকতে ব্যবহার করতাম। এরা ক্লাস নোট এবং পরীক্ষার খাতায়ও পেনসিল ব্যবহার করে। পরে অবশ্য আমিও পেনসিল ব্যবহারের অভ্যাস আয়ত্ত করে নিয়েছিলাম। পরীক্ষার খাতায় ভুল করলে কাজে দিত বেশ।

২০.
টিসিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হওয়ায় ছাত্রদের ক্লাস নেওয়া বা খাতা গ্রেডিংয়ের পাশাপাশি পরীক্ষার হলেও গার্ড দিতাম। ছাত্রছাত্রীরা একদম পাশাপাশি বসলেও কেউ কারও দিকে তাকায় না। কারও কাছ থেকে সাহায্য নেয় না পরীক্ষায়। যে যতটুকু পারে তাই পরীক্ষায় লিখে আসে। এ জন্য শিক্ষকেরাও গ্রেডিংয়ের ক্ষেত্রে অনেকটা উদার থাকেন। শুরুর দিকে এমন উদার গ্রেডিং করতে আমাকে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছিল, কিন্তু পরে মানিয়ে নিই।

২১.
বাঁ হাতে লেখার ব্যাপার দেশের চেয়ে অনেক বেশি চোখে পড়ে এখানে। দেশে এত বেশি বাঁহাতি দেখিনি ক্রিকেট খেলা ছাড়া। আমাদের দেশে সম্ভবত বাবা–মায়েরা ছোটবেলায় অনেক বাচ্চাকে প্রাকৃতকিভাবে বাঁ হাতে লিখতে দেখলে ডান হাতে অভ্যস্ত করিয়ে নেন। তার জন্য হয়তো সংখ্যাটা দেশে কম।


২২.
আমরা দেশে বসে ওদের অনেক অঙ্গরাজ্যের নাম জানলেও ওরা অনেকেই আমাদের দেশের নাম জানে না। বাংলাদেশ, ইন্ডিয়ার পাশের দেশ বলে পরিচয় দিতে হয় বেশির ভাগ সময়। এরপরও তারা ভাবে আমরা ইন্ডিয়ান। একটু পর জিজ্ঞেস করবে ইন্ডিয়ার আবহাওয়া কেমন!

এ রকম ভিন্ন রীতি দেখে মজার মজার বিনোদন পেলেও উপলব্ধি করেছি মানুষ হিসেবে আমেরিকানরা অসাধারণ, বিশেষ করে শিক্ষিত আমেরিকানরা।

হাশেম মোহাম্মদ
প্রসেস ইঞ্জিনিয়ার, ইনটেল করপোরেশন
পোর্টল্যান্ড, ওরেগন, যুক্তরাষ্ট্র