বাবা এখন অচিন দেশে

লেখকের বাবা
লেখকের বাবা

বাবা দিবস আসে এবং যায়। বাবা আসে না। আসতে পারে না। অচিন দেশের এই হাল। আসা যায় না। আসতে দেওয়া হয় না। যার জন্য দিবস সে নেই। এ দিবস আমাকে বেদনা ছাড়া কী দেবে? বেদনার্তের নিগূঢ় স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন জামেলামুক্ত ও সম্ভাবনাময়। এখানে সবই চলে, চালানো যায়।

আমি কাঁদি। কেঁদে বিরহ মুছতে চাই, মোছে না। কারণ, বাবার মতো করে কাউকেই ভালোবাসি না, বাসতে পারি না। তার কথা মনে পড়লে চেতনার বশীভূত আমাকে খোকা বানিয়ে দেয়। আর খোকারা কোনো দিনই সবকিছু খুলে বলার ক্ষমতা রাখে না।

কারও বাবাই তো চিরদিন থাকে না। থাকতে পারে না। সবাই কি এমন করে কাঁদে? হয়তো কাঁদে, নয়তো না। তুলনার্থে কাউকে ছোট করা যাবে না, উচিত না। আপনজনদের মৃত্যর খবরগুলো ক্রমান্বয়ে ভুলে গেছি। কারও চলে যাওয়ার কথাই অকারণে মনে পড়ে না। শুধু বাবা চলে যাওয়ার কথা কেন জানি এক দিনের জন্যও ভুলতে পারি না। সবশেষে আর ভুলতেও চাই না।

বাবা এ কোন বন্ধনে আমাকে জড়াল? আমি জড়ানোর শুভেচ্ছায় উল্লসিত হলেও হারানোর অন্তরঙ্গ বেদনায় লেখালেখিকে স্বপ্নের মতো আঁকড়ে ধরতে চেয়েছি। চেয়ে থাকার বাসনা কভু ফোরায় না। অফুরন্ত এ বাসনার বেড়াজালে আটকা পড়ে আমারও জানা হলো না, ভালোবেসে লিখে যাওয়ার অভিপ্রায় কতটুকু স্বার্থক হতে পেরেছি। যতটুকু জানি, বাবার একটি কথাও আমার জীবনে বিফলে যায়নি।

বাবা থাকতে হারানোর এমন করুণ স্বর হৃদয়ে বাজেনি। হৃদয়ও কোনো দিন বুঝতে পারেনি বাবা হারনোর যন্ত্রণা। তার চলে যাওয়া চিরনির্বাসনের যাতনা দিয়ে গেছে। রেখে গেছে শোণিতের দাগ ও তীব্র বেদনা। এ বেদনা বোঝা যায়, বোঝানো যায় না...। এতগুলো বছর পার হয়ে গেল একবারও ফোন দিইনি, দিতে পারিনি। জিজ্ঞাসাও করতে পারিনি, বাবা তুমি কেমন আছ? জিজ্ঞাসা করতে না পারার আর্তনাদ কোথাও না কোথাও অতি মাত্রায় জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছে...। বাবা নেই। এ ব্যাথা নিবিড় আলিঙ্গন করে। না থাকার স্মরণে দেখা হয় বারবার। কবি বুঝি এ জন্যই প্রিয়জনের উদ্দেশে লিখেছিলেন, ‘তোমাকে যখন দেখি, তার চেয়েও বেশি দেখি যখন দেখি না।’

বাবা মৃত্যুর আগের দিনও আমাকে দেখার ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন। ইচ্ছেগুলো এখন আড়িতে পরিণত হয়েছে। সব ইচ্ছার অবসান ঘটেছে। ঘুমের ঘরেও শোনতে পাই না, বাবা কারও কাছে জানতে চেয়েছে, খোকা আজ কেমন আছে? যার ছায়াতলে এ জীবন বেড়ে উঠল, সে-ই আজ সবকিছু ভুলে থাকার দেশে। অচিন দেশে। সে এখন আমার জন্য কিছুই করে না। একবার দেখতেও আসে না।

না আসাই কি বাবাকে দূরে নিয়ে গেছে? না, পারেনি। আড়িও ধরতে পারিনি। কেননা, আমি আর আগের খোকা নেই। আমি এখন ৪০ বছরের বুড়ো। আবেগ আমাকে খোকা বানাতে চাইলেও আসলে বড় হয়ে গেছি। এত বড় হয়েছি, আরও বড় হওয়ার সম্ভাবনাটাই দুস্কর। সান্ত্বনা শুধু এটুকুই, প্রতিদিনই বলতে পারছি, ‘রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বা ইয়ানি ছাগিরা।’

জীবননদীর স্রোত অবিরাম বইছে। ধারায় শুধু কান্না, নীরব কান্না। কান্না নীরব হয় কী করে? অন্যে শোনে না বলে? আমি তো শুনি। আমি কি অন্য কেউ নই? অন্যত্র থেকেই তো এসেছি। অন্যত্রে আছি। অন্যত্রেই যাব...। বাবার দশা আমার মতোই। সে পরের বাড়ির চাকরি শেষ করে চলে গেছে। আমাকে রেখে গেছে ঝড়-ঝাপটা পোহাতে। ঝড়-ঝাপটার বেগ ও গতি দূরান্তর...। সীমাহীন এ দূরত্বের বিক্রমী ক্ষমতা অজানা...।

আমি এই অজানা গতির বেগ ও আঘাত নীরবেই সহ্য করে যাচ্ছি...। শোকে শোকে ফুরিয়ে যাচ্ছি...। অতি শোক আমাকে পিষে পিষে খাচ্ছে...। শোক শিরোনাম লিখতে চাই। বাবা, তুমি নেই। চলে গেছ আর আসবে না। এ সংবাদ আমি চোখের জল দিয়ে নিজ আঙুলে কাবাঘরের দেয়ালে ও মদিনার প্রান্তরে লিখে দিয়ে এসেছি। আমি অধম তোমার জন্য এর বেশি কী করতে পারি?

বাবা তুমি সফল ও শ্রেষ্ঠ বাবাদের মধ্যেও শ্রেষ্ঠ একজন। অবুঝ মনে প্রশ্ন জাগে। তুমি কি শুনতে পাও আমার কান্না? বাবা কিছুই বলে না। সে আমাকেও পরের মতোই ছেড়ে গেছে। আমার ইচ্ছেগুলোও এখন আর আগের মতো পূরণ করতে চায় না। অচেনা বন্ধন এসে বাবাকে নিয়ে গেছে। আমি হয়েছি বন্ধনহারা। সবই তো ফেলে গেলে। কিছুই তো নিলে না। আমি তো চোখের জল ছাড়া আর কিছুই দিতে পারলাম না। প্রায়ই ভীষণ ইচ্ছে হয়, সবকিছু ছেড়ে দিয়ে তোমার কাছে চলে আসি। তোমাকে এক নজর দেখি। দেখে পরানটা জুড়াই। তোমার মুখের হাসি আমাকে বারংবার স্বপ্ন দেখায়। বাঁচতে শেখায়...। কত কী রঙের চেহারা দেখি আর দেখব...। ওই চান মুখ দেখার সাধ কোনো কিছুতেই মিটে না।

সন্তান বাবাকে দেখতে চায়...। পৃথিবীর কোনো নিষ্ঠুরতম আইন-আদালত তাকে দেখতে দেয় না, বল? ওহ হ, ভুলেই গেছি! তুমি এখন আইন–আদালতের ঊর্ধ্ব দেশে। অচিন দেশে। সত্যের ঠিকাদার তোমাকে বারজাখে থাকতে দিয়েছে। আসা–যাওয়া বন্ধ করে রেখেছে। এ রক্ষণাবেক্ষণ একের কানুনে চলে। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান তোমার অবস্থানের কথা উপলব্ধিও করতে পারে না। আমি চিরদিন অজ্ঞই রয়ে গেলাম। স্বার্থের তাড়নায় কোনো কানুনই মানি না। মানতে চাই না!

চারদিক থেকে পাওয়া নিষ্ঠুরতম আঘাতের বলিগুলো আমাকে পথেঘাটে ঘোরায়, দেখা দেয় না। অদৃষ্টের এ আঘাত আমাকে বারবার কাঁদায়। কাঁদিয়ে বাবার মমতা স্মরণ করায়। কভু নিবারিত হয় না। অনিবারিত এ করুণ আঘাতগুলোর সঙ্গে প্রাণপাখির ভালো দুস্তি হয়েছে। পাখিকে দেওয়া দুধকলা সেও মজা করে খায়। খেয়েদেয়ে বারংবার আঘাত চালিয়ে যায়। নিয়ম অনুসারী এ পাখি একদিন বেইমানি করবে। আঘাত সেদিন বুঝবে এর কোনো অস্তিত্ব নেই।

আমি ভালোবাসার মমত্বটানে কাউকেই ছাড়ি না। ছাড়তে পারি না। না ছাড়ি বাবাকে, না আঘাতকে। বরং বলি, হে আঘাত! তুমি আরও বলিষ্ঠ হয়ে স্পর্শকাতর এবং প্রাণবন্তের গল্প নিয়ে মোর পানে এসো। আমি একটি ভিন্ন স্বাদের গল্প জগৎবাসীকে উপহার দিয়ে যাই। যে গল্প শুধুই বাবার জন্য লেখা, অথচ সে কোনো দিনই পড়বে না। আঘাত তাও করে না। সে যে কী করে, আমার মাথায় কিছু আসে না।

‘এখন তুমি কোথায় আমি কোথায় কেউ তো কাউকে দেখি না,

তুমি এমন করে ছেড়ে যাইবা বাজান আগে জানি নাই।

আমি কার কাছে কই মনের ব্যাথা কেউ নাই আমার আপনার।’

অজানা সুরের অচেনা মাধবী নিজ বাবাকে হারানোর শোকে কেঁদে যে আঘাতের ভার আমার ওপর চাপিয়ে গেল, আমার আবেগের মরুভূমিতে জমে থাকা শত জনমের ব্যথার পাহাড় মিনিটেই গলে যেত বাবা তোমার দেখা পেলে। এ যেন তোমাকে পাওয়ার কারণে চাওয়ার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার গল্প। নয়তো পেয়ে হারানোর গল্প। আমি এই গল্পের কাতর দুঃখ প্রকাশের সঠিক মনোভাব কোনোমতেই নির্ধারণ করতে পারছি না। প্রিয় বাবা, তুমি-ই আমার ভালোবাসার সর্বোত্তম আদর্শ। দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো...।

বিরহে ঘেরা প্রগাঢ় রাত্রি যখন ঐক্যবোধ তত্ত্বের স্বাদ নিতে ডুবে থাকে। আমি যখন বেদনার অন্ধকারে ঢাকা পড়ে অজানা বিরহের অচেনা অরণ্যে বিলীন হয়ে ঘুরে বেড়াই। তোমার স্পর্শের গভীর ভালোবাসা এসে আমায় প্রশ্নবিদ্ধ করে, কে বলেছে তুমি নেই? তুমি আছ আমার অনুপম হৃদয়ের মাঝে। তুমি আছ এই মাটির বুকে। তুমি আছ এই পদ্মা, মেঘনা ও যমুনায়।

কল্পনাশক্তির অপলক ক্ষমতা আছে, থাকে। আমি ততদূরে পোছতে পারিনি। না পোছেই ইচ্ছে পূরণ করতে চাই। অনিয়ম আবেগে জড়াই। আবেগ এতে বাড়তি ক্ষমতা পেয়ে গেছে। আমাকে কষে কষে মারছে...। আমি মার খেয়েও ক্ষান্ত হইনি। বরং সান্ত্বনা নিই, নিতেই হয়। বাবা তুমি সত্য। সত্যের কাছেই আছ। ক্ষমতাধরের তত্ত্বাবধানে থেকেও ক্ষমতার কোনো লোভ আজ তোমার মাঝে নেই। আমারও পরের বাড়ির চাকরির মেয়াদ শেষের দিকে। নিকটেই ফুরিয়ে যাবে। ধীরে ধীরে সবই হারাচ্ছি। সবাই হারাচ্ছে...। আমিও হারিয়ে যাব।

সময় হলে আমাকেও তোমার কাছে নিয়ে যেও। নিতে না পারলে সত্যের পথচারীকে বলিও, আমি তাঁর এত বড় সত্যের প্রশংসা করার যোগ্য হইনি। হতে পারিনি। হে প্রভু! আমাকে শক্তি দাও। আমি শক্তিমানের গোলামি করেই বলিষ্ঠ হতে চাই...।