অর্ধেকটা মানুষ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সদ্য অস্ট্রেলিয়ায় আসা শুভ প্রতিদিন বিকেলে প্রায় ঘণ্টাখানেক আমাদের বাসায় এসে গল্প করে যায়। তার সব গল্পই বাংলাদেশে ফেলে আসা জীবনটাকে নিয়ে। করোনা লকডাউনের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ার স্কট মরিসন সরকার ইন্টারন্যশনাল স্টুডেন্টদের দেশে চলে যেতে বললে, তার সঙ্গে পড়ুয়া সবাই নিজ নিজ দেশে চলে যায়। শুভ কিছুতেই গেলে না। সে বলে, হাসান ভাই, আপনার বাসায়ই তো দেশের স্বাদ পাই। দেশে গিয়ে আর কী হবে। খুব ভয় লাগে যে।

ভয় লাগে! বলো কী? সারাক্ষণ দেশের গল্প করো। দেশের প্রতি তোমার এত মায়া। এখন বলো ভয় লাগে। বিষয়টা বুঝলাম না।

ভাবি কই?
নীপা শপিংয়ে গেছে। কেন?
না। এমনি। ভাবি শুনলে আবার কি–না–কি মনে করে। ঘটনাটা বলি।

হাতে–পায়ে বেশ বড় কয়েকটা ক্ষতের দাগ দেখিয়ে শুভ বলে,

বাস অ্যাক্সিডেন্ট! বুঝলেন ভাই। ঢাকা চট্টগ্রাম ‘নীল পদ্ম’ সার্ভিস চালু হলে হঠাৎ ইচ্ছে হলো ঢাকার মাদারটেকে আপার বাসায় বেড়ায়ে আসি। অনার্স ফাইন্যাল পরীক্ষাও সবেমাত্র শেষ হলো। তাই আরকি।

চট্টগ্রাম থেকে রাত ১০টায় বাস ছেড়ে দেয়। জোছনা রাত। এসি বাস। জানালার পাশে সিট। হেলান দিয়ে বসে আছি। আহা কী আরাম! এক দৃষ্টে বাইরে চেয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, খেয়াল নেই।

হঠাৎ বিকট শব্দ! আহাজারি! চিৎকার! পা দুটো আটকে গেছে। বের করতে পারছি না। ভাঙা গ্লাসের আঘাতে মাথা–ঘাড়ের সামান্য ওপরে কেটে গেছে, কেটে গেছে আমার দুটো হাত। একটু পরেই টের পাচ্ছি চার–পাঁচজন লোক, কারা যেন ওরা, খুব মোলায়েম ব্যবহারে আমাকে টেনে বের করছে, পা থেকে খুলে নিচ্ছে নতুন ক্যাডস–জোড়া, আর খুব আস্তে করে মানিব্যাগ আর মোবাইলটা সরিয়ে নিচ্ছে। বাসের আহত যাত্রীদের ওরা দরদি আপনজনের মতো সান্ত্বনা দিচ্ছে। আর যা করার তো করছেই। যাত্রীদের আহাজারি চিৎকার। জীবন–মরণের এই সময়ে তাদের ভদ্র ব্যবহারে বোঝার উপায় নেই কী হতে কী হয়ে যাচ্ছে।

রাস্তার মাঝখানে বিকল হওয়া এটা ট্রাকের পেছনে ধাক্কা খেয়ে সামনের অংশ ধুমড়েমুচড়ে আমাদের বাসটা রাস্তার পাশে একটা গাছে আটকে যায়।

আমাকে ওরা বাস থেকে বের করে ছেড়ে দিতেই পাশে গাছের মতো কী একটা দেখে বসে পড়ি। নরম নরম লাগে, তাই হাত দিয়ে ধরতেই দেখি, এ কী! এ তো দেখি একটা মানুষের অর্ধেকটা শরীর!

তারপর আর জানি না। চোখ খুলে দেখি আমি কুমিল্লা সদর হাসপাতালে। একজন অনডিউটি চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, ওই বাসের যাত্রীদের ব্যাগগুলো নিকটস্থ থানা হেফাজতে আছে। পরের দিন দুপুরের দিকে ব্যথা কমে এলে হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে রিসিপশনের একজনের সঙ্গে কথা বলি। তিনি একটা অটোরিকশা ডেকে দেন। বাঁ হাতের কবজি কেটে গেছে। চিকিৎসক স্কেলের মতো একটা কাঠির সঙ্গে জড়িয়ে ব্যান্ডেজ করে, গলার সঙ্গে বেঁধে বুকের ওপর ঝুলিয়ে দেন হাতটা। ডান হাতে আর মাথায় ব্যান্ডেজ। পকেটে একটি টাকাও নেই। এ অবস্থায় একটাই ভরসা, ব্যাগটা যদি পাই, ওই ব্যাগের তলায় একটা গোপন পকেটে কয়েক হাজার টাকা আছে। ওই পকেটটা এমনভাবেই করে রেখেছি যে কারও বোঝার উপায় নেই। অটোর ভাড়া মিটিয়ে ভালো একটা রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাব। তারপর ভেবে দেখব, চট্টগ্রামে বাড়ি ফিরে যাব, নাকি মাদারটেকে আপার বাসায় যাব। কারণ খিদায় পেট পুড়ে যাচ্ছে।

থানায় এসে দেখি একটা রুমে যাত্রীদের ব্যাগগুলো রাখা আছে। কর্তব্যরত পুলিশের কাছে বর্ণনা দিতেই তিনি আমার ব্যাগটা নিয়ে এলেন। বুকের ভেতর যেন প্রাণ ফিরে এল। ভেতরে হাত দিয়ে দেখি ব্যাগের ওই গোপন পকেটটাই নেই। কে যেন কাঁচি দিয়ে খুব সুন্দর করে কেটে নিয়ে গেছে।

অটোরিকশা চালক বলেন, ভাই, আমার ভাড়াটা দিয়ে দেন। যাই গা।

পরক্ষণেই পুলিশ সাহেব বলেন, ভাই, রাতের বেলা এলাকার লোকজনের সহায়তায় লাশ সরানো, আহতদের হাসপাতালে পাঠানো, মালামাল সব থানায় আনানো। আমাদের বেশ খরচ হয়েছে। ব্যাগ নিবেন ভালো কথা, কিছু টাকা দেন। কোন ধরাধাপ্টি নাই। যা মনে চায় তা–ই দেন।

এ পর্যন্ত বলে শুভ দু–একবার এদিক–ওদিক তাকিয়ে বলে,
ভাই। বাস অ্যাক্সিডেন্টে আর কীই–বা আহত হইছি। পুলিশ আর অটোড্রাইভারের সামনে তখন আমার যে আহত অবস্থা! তা আর কারে বোঝাই। দেশের মানুষের মতো এত বুদ্ধি কি আর আমার আছে? দেশকে ভালোবাসি, কথা সত্য। তবে দেশ আমাকে কতটুকু ভালোবাসে? এ কথাটা ভাবতেই শরীরটা শিহরে ওঠে। তার ওপর আবার চলছে করোনা ক্রাইসিস। এখন বলেন আমি কী করব।

শুভর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। এ প্রশ্নের জবাব তো আমার কাছে নেই। তার মতো বাস অ্যাক্সিডেন্টে জীবনে না পড়লেও, দেশে থাকা জীবনে এমন অনেক ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছে, যা কোনো দিন কারও কাছে বলতেও পারব না।