শৈশবের সেকাল-একাল

বো বোয়িং ক্রিকের ওপর রেলসেতু। ছবি: লেখক
বো বোয়িং ক্রিকের ওপর রেলসেতু। ছবি: লেখক

কুষ্টিয়ায় হাসানদের বাড়ি থেকে রেলগাড়ি যাওয়ার শব্দ শোনা যায়। অনেক সময় নিয়ে কু ঝিকঝিক শব্দ করে রেলগাড়ি যায়। তারা দুই ভাই আর প্রতিবেশী আজাদ ও মিনারুলদের সঙ্গে খেলাধুলা করে দিনভর। যেহেতু তারা তখন বাড়াদীতে সবে নতুন বসতি স্থাপন করেছে, তাই তাদের সবকিছুই আজাদেরা দুই ভাই দেখিয়ে দেয়, শিখিয়ে দেয়। একদিন রেলগাড়ির শব্দ শোনামাত্রই আজাদ বলল, চল, আমরা রেলগাড়ি দিয়ে পয়সা বড় করে আনি। হাসানেরা দুই ভাই তত দিনে রেলগাড়ি দেখে এসেছে। দুটো সমান্তরাল লোহার পাতের ওপর দিয়ে রেলগাড়িটা দ্রুত ছুটে যায়। আবার সামনাসামনি রেলগাড়ি দেখার উত্তেজনায় তারা সানন্দে রাজি হয়ে গেল। আজাদ তার হাফ প্যান্টের পকেট হাতড়ে কয়েকটা খুচরা পয়সা বের করল। তার মধ্যে একটা আট আনা, একটা চার আনা, দুটো দশ পয়সা আর একটা পাঁচ পয়সা। আজাদ বলল, আমরা দশ পয়সা দুটোকে বড় করব, কারণ দশ পয়সা আকারে সবচেয়ে বড় আর রেলগাড়ির চাকার চাপে সেটা আরও বড় হয়ে যাবে।

চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া কয়েন হাতে তাহিয়া। ছবি: লেখক
চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া কয়েন হাতে তাহিয়া। ছবি: লেখক

হাসানেরা তত দিনে অঙ্ক খাতার পাতায় পয়সা দিয়ে পয়সা আঁকা শিখে ফেলেছে। খাতার পাতার নিচে একটা পয়সা রেখে ওপর থেকে খাতার ওপর ঘষতে থাকলে খাতার পাতায় নিচের পয়সার অবয়ব ফুটে ওঠে। এভাবে যে কত খাতার পাতা নষ্ট করেছে, তার হিসাব নেই। এ ছাড়া খাতায় ছবি আঁকার আরও একটা উপায় ছিল। খাতার পাতাকে তেল চুপচুপে মাথার সঙ্গে কিছুক্ষণ ঘষলে খাতার পাতাটা মোটামুটি স্বচ্ছ হয়ে যেত। তারপর সেটা বইয়ের যেকোনো ছবির ওপর রাখলে ওপর থেকে স্পষ্ট দেখা যেত। তারপর নিচের ছবি অনুসরণ করে পেনসিল ঘোরালেই খাতার পাতায় নিচের ছবিটার অবয়ব তৈরি হতো, কিন্তু কলম দিয়ে কোনোভাবেই কেন জানি আঁকা যেত না। এ ছাড়া দোকান থেকে ময়ূরের পেখম কিনে এনে তারা বইয়ের পাতায় রেখে দেয় এই বিশ্বাসে যে সেগুলো দিনে দিনে সংখ্যায় বাড়বে। প্রতিদিন কয়েকবার করে তারা পরীক্ষা করে দেখে একটা পালক থেকে দুটো–তিনটে হলো কি না।

এ ছাড়া বই নিয়ে সবচেয়ে মজার খেলা হলো বইয়ের পাতার মানুষ গুনে অন্যকে কিল মারা। একজন বইটা হাতে নিয়ে অন্যজনকে জিজ্ঞেস করে, ওপর না নিচ মানে ওপরের পাতা নাকি নিচের পাতা। এরপর সেই পাতার মানুষের সংখ্যা গুনে অন্যজনকে কিল মারতে হবে। এভাবে খেলতে যেয়ে অনেক সময়ই একে অন্যকে জোরে কিল মারার অপরাধে তাদের মধ্যে মারামারি লেগে যায়। অবশ্য তারা মোটেও তাদের মারামারির খবর তাদের অভিভাবকদের বলে না। কারণ, তাহলে পিঠে আরও কিছু বাড়তি মার জুটে অকারণে মারামারি করার জন্য। আর সকালে মারামারি লাগলে দুপুর হতে হতেই সেটা তারা ভুলে যায়। কারণ, সারা দিন তাদের ব্যস্ততার সীমা নেই। বিভিন্ন কাজ তাদের দল বেঁধে করতে হয়। গাদন খেলার কোর্ট কাটা থেকে শুরু করে, পুকুরে লাফালাফি করে গোসল করা, গোসল করতে যেয়ে শাপলা, ঢ্যাপর তুলে আনা আরও কত কী!

চার বছরের দুরন্ত রায়ান। ছবি: লেখক
চার বছরের দুরন্ত রায়ান। ছবি: লেখক

পরিকল্পনা মোতাবেক তারা রেললাইনের দিকে যাত্রা শুরু করল। দুই দিক দিয়ে রেললাইনের কাছে যাওয়া যায়। মতি মিয়ার রেলগেটের কাছে অনেক মানুষ থাকে, তাই ওখানে গেলে এই কাজ করা যাবে না। আজাদ বলল, আমরা কালীঘরের ওই দিকে যাব। বাড়াদী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে রাস্তাটা এঁকেবেঁকে চলে গেছে। স্কুলের মাঠটা পার হলেই ছোট একটা খাল। খালের ওপর বাঁশের সাঁকো। সাঁকো আসলে বাঁশের তৈরি সেতু। খালের মধ্যে উঁচু বাঁশের খুঁটি পুঁতে তার ওপর বাঁশের একটা পাটাতন বসানো। কিন্তু সেতুর মতো কোনো রেলিং নেই। শুরুতে হাসানের খুব ভয় করত। সে সাঁকোটার ওপর বসে এক পা এক পা করে এগিয়ে সাঁকো পার হতো। এখন আর ভয় করে না। এক দৌড়ে সাঁকো পার হয়ে যায়। সাঁকোর পরেই একটা বিশাল বাঁশের বন। এরপর নাপিত দাদুর বাড়ি, তারপরেই রাস্তা। আর রাস্তাটা পার হলেই কালীমন্দির। আর কালীমন্দিরের সামনে দিয়ে সামান্য গেলেই রেললাইন। এখানে আলাদা করে কোনো গেটম্যান নেই। তাই খুব সহজেই রেললাইনের কাছে যাওয়া যায়।

রেললাইনের কাছে পৌঁছেই আজাদ তার অভিজ্ঞ দৃষ্টি রেললাইন বরাবর নিবদ্ধ করে বলল, এখনো রেলগাড়ি আসার দেরি আছে। ততক্ষণ আমরা চল কালীমন্দিরটা দেখি। কালীমন্দিরটা বেশ পুরোনো। গায়ে শেওলার মতো পড়েছে কোথাও কোথাও। এখানে দুর্গাপূজাও করা হয়। কিন্তু বছরের অন্যান্য সময় শুধু দেবী কালীর মূর্তিই থাকে, তাই সবাই কালীমন্দির নামেই এটাকে চেনে বেশি। হাসানেরাও এর আগে বেশ কয়বার এসেছে দুর্গাপ্রতিমা দেখতে। পূজা দেখতে এলেই পুরুত মশাই আতপ চাল আর কলা একসঙ্গে মাখানো একটা প্রসাদ খেতে দেন। হাসানদের এটা খুবই প্রিয় খাবার। ভেতরে তখন কালীর মূর্তিটাই শুধু রয়েছে। আজাদ সেটাকে দেখিয়ে দেখিয়ে দলনেতার ভঙ্গিমায় বলে চলল, কালীর পায়ের নিচে ওইটা হচ্ছে শিব। কালীর এতই বেশি রাগ হয়েছিল যে সব অসুর মারতে মারতে একসময় শিবকেও মারতে উদ্যত হয়। তখন শিবকে চিনতে পেরে জিবে কামড় দিয়েছে। এগুলোর কতখানি সত্য, হাসানেরা জানে না, তবে আজাদের বলার ভঙ্গিমার কারণেই তারা সেগুলো অবলীলায় বিশ্বাস করে।

এরপর আবার তারা রেললাইনের কাছে ফিরে এল। আজাদ দূরের খুঁটিটার পাখার দিকে তাকিয়ে বলল, রেলগাড়ি আসার সময় হয়েছে। তারপর পকেট থেকে দুটো দশ পয়সা বের করে রেললাইনের দুটো পাতের ওপর রাখল। তারপর সবাইকে বলল, চল আমরা রেললাইনের পাশের ওই বড় দেবদারুগাছের কাণ্ডের আড়ালে দাঁড়াই, কারণ রেলগাড়ির চাকার চাপে পয়সাটা অনেক দূর ছুটে আসবে। তখন সেটা গায়ে লাগলে কেটে যেতে পারে। এরপর তারা দেবদারুগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে রেলগাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করল। সময় যেন আর শেষ হতে চায় না। এরপর একসময় দূরে রেলগাড়ির শব্দ শোনা গেল। তারপর কু ঝিকঝিক করে রেলগাড়িটা একসময় জগতি স্টেশনের দিকে চলে গেল। আজাদ সবাইকে নিয়ে তাড়াতাড়ি গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে বলল, পয়সা দুটো খুঁজে বের কর তাড়াতাড়ি, কারণ অনেক সময় অনেক দূর চলে যায়, আর খুঁজে পাওয়া যায় না। আজাদ আরও বলল, পয়সা হাত দিয়ে ধরবি না, কারণ অনেক গরম হয়ে যায়। পাশের ভাটগাছের পাতা দিয়ে ধরবি। সবাই মিলে খুঁজে পয়সা দুটো পেয়ে গেল। একটাকে পাওয়া গেল রেললাইনের পাশের পাথরের খোয়ার মধ্যে, অন্যটাকে পাওয়া গেল পাশের ছোট ছোট গাছের মধ্যে। পয়সাটা হাতে নিয়ে হাসানের বিস্ময় আর কাটে না। পয়সা দুটো অনেক লম্বা হয়ে গেছে। গোল পয়সা দুটো লম্বা হয়ে অনেকটা বেলনাকৃতি নিয়েছে। আজাদ একটা পয়সা হাসানদের দিয়ে দিল। এরপর থেকে হাসান সেই পয়সাটা সব সময় তার সঙ্গে রাখে। ঘুমাতে গেলেও সেটাকে বালিশের নিচে রেখে ঘুমায়।

বো বোয়িং ক্রিকের সেতুর ওপর তাহিয়া ও মেহরাব। ছবি: লেখক
বো বোয়িং ক্রিকের সেতুর ওপর তাহিয়া ও মেহরাব। ছবি: লেখক

সময় ও নদীর স্রোত নাকি কারও জন্য অপেক্ষা করে না। ৩০ বছর পরের ঘটনা। হাসান তার পরিবার নিয়ে সিডনির দক্ষিণ–পশ্চিমের মিন্টোতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছে বছর পাঁচেক আগে। পরিবার বলতে হাসান, তার গিন্নি, মেয়ে তাহিয়া আর ছেলে রায়ান। প্রবাসজীবনে হাঁপিয়ে উঠলেই হাসান ডুব দেয় নিজের ফেলে আসা শৈশব–কৈশোরের রঙিন দিনগুলোতে। আর ভাবে, যদি তাদের শৈশবের পাগলামির সামান্যতমও তার ছেলেমেয়ের জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে, তাহলেই বড়বেলায় ওদের আর নিজের জীবনটাকে অর্থহীন মনে হবে না। কারণ, উন্নত বিশ্বে মানুষের জীবনযাপন একেবারে ছকে বাঁধা। মানুষ তাই দ্রুতই হাঁপিয়ে ওঠে, আর কথায় কথায় বলে, আই অ্যাম বোরড। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, এই কথাটা বড়দের চেয়ে ছোটদের মুখে বেশি শোনা যায়। হাসানদের শৈশবে যখন তাদের নিশ্বাস নেওয়ার সময় ছিল না বিভিন্ন দুষ্টুমির ফাঁকে, আর এখন বাচ্চাদের দুষ্টুমি করার সুযোগ নেই বললেই চলে। যেসব অভিভাবক নিজেরাই তাদের শৈশবে মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে, পুকুরে লাফালাফি করে বড় হয়েছে, তারাই এই প্রবাসে রাতারাতি ভদ্র হয়ে গেছে। নিজের ছেলেমেয়েরা কীভাবে লেখাপড়ায় ভালো করবে, সেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। হাসানের মতো দু–একজন আধপাগল অভিভাবক এখনো এই সব নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাচ্চাদের একটা সুন্দর শৈশব–কৈশোর উপহার দিতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। কারণ, হাসান তার অভিজ্ঞতায় দেখেছে, যার জীবনে সুন্দর কোনো স্মৃতি নেই, তার জীবন বয়ে নিয়ে বেড়ানো ততটাই কঠিন।

মিন্টোতে এসে হাসান তাই খুঁজে খুঁজে বাসার কাছাকাছি একটা নদী বের করেছে, যদিও সেটা আসলে কোনো নদী নয়। বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি বয়ে যাওয়ার একটা ড্রেন, যেটাকে স্থানীয় ভাষায় বলে ক্রিক। এই ক্রিকটার বিশেষত্ব হচ্ছে, এর ওপর দিয়ে রেললাইন চলে গেছে। সব সময় দুই দিক দিয়ে রেলগাড়ি আসা–যাওয়া করে। তার পাশেই একটা সেতু, যেটাকে জরুরি অবস্থায় ব্যবহার করা হয়। অন্য সময় সেতুর পাশেই ক্রিকের ওপর বানানো স্লুইস গেটের মতো জায়গা দিয়ে অপর পাশে গাড়ি নিয়ে আসা–যাওয়া করা যায়। সেতুর দুই পাশেই খোলা মাঠ আর অপর পাশে বিদ্যুতের একটা সাবস্টেশন, তাই এই বাড়তি সেতুটা বানিয়ে রাখা। যদি কখনো নিচের জায়গাটা পানি দিয়ে ভরাট হয়ে যায়, আর তখন অপর পাড়ে যাওয়া লাগে, তখন সেতুটা ব্যবহার করা হয়। হাসান তার ছেলেমেয়েকে নিয়ে প্রায় সপ্তাহান্তেই সেখানে বেড়াতে যায়। কারণ, সেখানে গেলেই হাসান তার শৈশবের দিনগুলোতে ফিরে যেতে পারে, যখন সে দাদির আঁচল ধরে পদ্মার পাড়ে হেঁটে বেড়াত। হাসানের জীবনে আজ দাদি নেই, কিন্তু রয়ে গেছে দাদির স্মৃতি।

গত সপ্তাহান্তে টানা বৃষ্টি হচ্ছিল, তাই হাসান মনে মনে সুযোগ খুঁজছিল কখন ক্রিকটার কাছে যেতে পারবে। কারণ, বৃষ্টির পর ক্রিকটা একেবারে ফুলেফেঁপে উঠে বাংলাদেশের বর্ষাকালের নদীর আকার পায়। রোববার দুপুরে বৃষ্টি থেমে যাওয়াতে হাসান, তার ছেলে রায়ান, মেয়ে তাহিয়া, মেয়ের বন্ধু মেহরাবসহ চলে গেল ক্রিকটার কাছে। সেখানে গিয়ে রায়ান যথারীতি পানিতে ঢিল ছুড়তে শুরু করল। তাহিয়া আর মেহরাব সেতুটার ওপর উঠে ক্রিকের দৃশ্য দেখতে শুরু করল। হাসান রায়ানের দিকে চোখ রাখছিল। হঠাৎ দেখে একটা অজি ছেলে তাদের দিকে হাসিমুখে এগিয়ে আসছে। তাকে দেখে মনে হলো তার বয়স আট থেকে দশের মধ্যে হবে। অজিরা তাদের বাচ্চাদের ছেড়ে দিয়ে মানুষ করে, তাই একটু বয়স হলেই তারা সবাই মোটামুটি হেঁটে স্কুলে বা খেলার মাঠে যায়। ছেলেটা হাসানের কাছে এসে বলল, দেখেছ কী সুন্দর লাগছে পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায়! তার এই কথা শুনে হাসান মনে মনে খুবই খুশি হলো। এত দিনে হাসান তার একজন দোসর খুঁজে পেল। কথা বলে জানা গেল তার নাম কনার, থাকে মিন্টোতেই। সে এসেছে একটা সাইকেল চালিয়ে।

হাসান তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঠিক করে ফেলল তারা রেললাইন পার করে নদীটা যেদিক থেকে এসেছে, সেদিকে যাবে। কিন্তু অন্য পাশে যেতে হলে রেললাইনের নিচে দিয়ে যেতে হবে। রেললাইনের নিচে লম্বা থামগুলোর ফাঁকে হাঁটার জায়গা, তবে সেখান দিয়ে যেতে হলে বসে বসে যেতে হবে, না–হলে ওপরের ছাদে মাথা ঠুকে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তারা সবাই কুঁজো হয়ে অন্য পাড়ে চলে গেল। সেখানে একটা খোলা জায়গা, তারপর আবার একটা রেললাইন। আবারও একইভাবে রেললাইন পার করে অপর পাড়ে গিয়ে দেখে সেখানে বড় বড় ঘাস। অন্য সময় হলে হাসান নিজেই সাহস করত না, কারণ এসব জায়গায় সাপ থাকার সমূহ সম্ভাবনা আছে। কিন্তু শীতকাল বলে হাসান তার মধ্য দিয়ে নদীর দিকে চলে গেল। তাহিয়া আর মেহরাব একটু ইতস্তত করাতে হাসান বলল, এখন শীতকাল, সাপেরা সব হাইবারনেশনে গেছে। তখন মেহরাব আর তাহিয়াও তার পিছু নিল। ইতিমধ্যে কনার চলে এসেছে। সে এসেই নদীর পানির মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল। পানির প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় তার স্রোতও বৃদ্ধি পেয়েছে। স্রোত কনারকে টেনে নিয়ে ফেলে দিল। তখন কনারের হাসি দেখে কে। আসলেই শৈশব–কৈশোরে মানুষ অনেক দুঃসাহসিক এবং অনর্থক বিষয়ে আনন্দ পায়।

হাসান নিজে পানির মধ্যে নেমে বুঝল পানি একেবারে বরফের মতো ঠান্ডা, কিন্ত কনারের খুশি দেখে মনে হচ্ছিল যেন সে বাংলাদেশের গরমকালের বৃষ্টির পানিতে হেঁটে বেড়াচ্ছে। এইবার ফিরে আসার পালা। মেয়েরা পাড় দিয়ে হেঁটে ফিরে এসে দুই রেললাইনের মাঝে দাঁড়াল। হাসান আর কনার ক্রিকের পানির মধ্য দিয়ে হেঁটে এসে পাড় বেয়ে সেখানে এসে দাঁড়াল। অবশ্য এর মধ্যেই হাসান আর কনার পাড়ের একটা গোল ড্রেনের মধ্যে বসে একে অপরের ছবি তুলে দিয়েছে। দুই রেললাইনের মধ্যে দাঁড়িয়ে হাসানের মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। সে তার মানিব্যাগ হাতড়ে দেখে সেখানে একটা বিশ সেন্টের কয়েন আর দুটো দুই ডলারের কয়েন। সাধারণত তার মানিব্যাগে কোনো কয়েন থাকে না, কারণ অফিস শেষ করে বাসায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তাহিয়া সেগুলো নিয়ে নেয়। গত কয়েক দিন তাহিয়া না নেওয়ায় এই কয়েনগুলো জমেছে।

হাসান তাহিয়াকে বলল, আমরা এই বিশ সেন্টের কয়েনটাকে লম্বা করব। শুনে তাহিয়া উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু কীভাবে? হাসান বলল, রেললাইনের ওপর বসিয়ে রেলগাড়ির চাকার চাপে। তাহিয়া বলল, কিন্তু কীভাবে রেললাইনের ওপর রাখবে, কারণ রেললাইন তাদের মাথার ওপরে এবং দুই পাশে তারের বেড়া দেওয়া। তাহিয়ার প্রশ্ন শুনে হাসান হাসল মনে মনে। তারপর একটা জায়গা খুঁজে নিয়ে একটা পাইপ বেয়ে রেললাইনের ওপর উঠে গেল, তারপর কয়েনটা রেললাইনের ওপর রেখে নেমে এল। এরপর মুঠোফোনে ট্রেনের অ্যাপ দেখে বের করল ট্রেন আসতে এখনো পাঁচ মিনিট দেরি। ততক্ষণ হাসান তাদের নিজের শৈশবের কয়েন লম্বা করার গল্প করে শোনাল। এরপর একসময় ট্রেন এল এবং চলেও গেল। হাসান আবার তাড়াতাড়ি রেললাইনের ওপর চলে গিয়ে কয়েনটা খুঁজতে শুরু করল। কিন্তু কোথাও পেল না। হতাশ মন নিয়ে নেমে আসছিল তখন নিচে থেকে তাহিয়া বলল, বাবা আমি কয়েনটা পেয়েছি। ট্রেনের চাকার ধাক্কায় কয়েনটা নিচে এসে পড়েছে এবং নিশ্চিতভাবেই লম্বা হয়ে বেলনাকৃতি নিয়েছে। সেটা দেখে সবাই খুবই অবাক হলো। মেহরাব বলল, আজ অনেক মজা হলো। তারপর তারা বাসায় ফেরার পথ ধরল।

বাসায় ফেরা পথে তাহিয়া বলল, বাবা আমি কি কয়েনটা স্কুলে নিয়ে যেতে পারি। হাসান বলল, অবশ্যই। হাসান তখন বুঝল তাহিয়া এই কয়েনটা স্কুলে নিয়ে তার বন্ধুদের দেখাতে চায়। এরপর থেকে কয়েনটা তাহিয়ার কাছে আছে। সে এটা কাউকে দেয় না। হাসানের কেন জানি মনে হয় তাহিয়া প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে অন্ততপক্ষে একবার হলেও কয়েনটা দেখে। এটা ভেবেই হাসানের মনটা খুশিতে ভরে উঠল। কারণ, এ দেশের প্রবাসী বাচ্চারা সব সময় বলে, আই অ্যাম বোরড। তাহিয়া অন্ততপক্ষে এটা বলবে না। আর ও যখন বড় হবে, তখন শৈশবের এই সব স্মৃতি তাকে দুঃসময়ে সঙ্গ দেবে।