হুজুগের সেকাল-একাল

হুজুগ আর গুজব শব্দ দুটিরই ইংরেজি হচ্ছে রিউমার। যদিও বাংলায় এর ব্যবহার আলাদা আলাদা কারণে। হুজুগের বশবর্তী হয়ে মানুষ গুজব ছড়ায়, আবার গুজব শুনে হুজুগের বশবর্তী হয়ে এমন সব কর্মকাণ্ড করে, যেগুলোকে সোজা বাংলায় বলে কাণ্ডজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ড। সে যা–ই হোক, আমরা অভিধানিক অর্থের দিকে না গিয়ে এগুলোর প্রয়োগের দিকে নজর দেব, বিশেষ করে করোনার এ ক্রান্তিকালে শব্দ দুটি নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা হচ্ছে।

প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের হুজুগ বা গুজবের প্রবণতা দিন দিন কমে আসার কথা থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে, মানুষ দিন দিন আরও বেশি হুজুগ বা গুজবনির্ভর হয়ে পড়ছে। একসময় মনে করা হতো অশিক্ষার ফলে মানুষ হুজুগে বা গুজবে বেশি কান দেয়, কিন্তু বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তাকালে দেখা যায়, আসলে এগুলো শিক্ষার সঙ্গে নয়, এগুলো মানসিকতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

গ্রামবাংলায় খেতের বেড়া দেওয়ার জন্য কলমির ব্যবহার বহুদিনের ঐতিহ্য। কোনো খরচ ছাড়াই সবাই খেতের ধারে কলমি লাগিয়ে দেয়, সেটা দিন দিন বড় হয়ে বেড়ার কাজ করে, বিশেষত বাসাবাড়ির পাশে খেতের ধারে কলমির বেড়া এখনো দেওয়া হয়। কলমির শুকনা পাতা আবার মাটির চুলার অন্যতম জ্বালানি। এ ছাড়া কলমির কাণ্ড শুকিয়েও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আমরা ছোটরা কলমির ফুল আর পাতা দিয়ে বালুর মধ্যে খেলনা বাড়িঘর তৈরি করতাম। এ ছাড়া কলমির কষ পাটকাঠির মাথায় লাগিয়ে ফড়িং ধরার কাজে ব্যবহার করতাম। ছোটবেলায় সেই আশির দশকে বাংলাদেশে হঠাৎ করে গুজব রটে গেল, এই কলমি গাছে একধরনের পোকা আছে, কামড়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। গ্রামে ঘর থেকে বের হলেই কলমির বেড়া, তাই মানুষ কলমি কেটে ফেলতে শুরু করল। আমরা ছোটরাও আর ভয়ে কলমির ধারেকাছে ঘেঁষি না। গুজবটা কোথা থেকে কীভাবে আমাদের গ্রামে এসেছিল, জানা নেই; কিন্তু এরপর হুজুগে মানুষ গ্রামের সব কলমি কেটে সবাড় করে দিয়েছিল।

গ্রামীণ জীবনধারায় অনেক কুসংস্কার ছিল। কয়েকটার উদাহরণ দেওয়া যাক। কেউ যদি প্রস্রাব বা পায়খানা মাড়াত, তাকে অবধারিতভাবে গোসল করতে হতো। আমরা কজন ডানপিটে ছেলে রাস্তার ধারে খেলাধুলা করতাম। আবার সেই রাস্তার ধারেই মানুষ প্রস্রাব করত। তাই আমাদের প্রস্রাব মাড়াতেই হতো। দিনের যে সময়েই আপনি প্রসাব মাড়ান না কেন, আপনাকে গোসল না করে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হবে না। এ ছাড়া ছিল যেকোনো রোগের চিকিৎসায় ফকিরের শরণাপন্ন হওয়া। বাতের ব্যথা, পেটের ব্যথা থেকে শুরু করে কুকুরের কামড়, সাপের কামড় সবকিছুর চিকিৎসার জন্য ফকিরই ছিল প্রথম ভরসা। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার ছিল ভূতে ধরা রোগীর গা থেকে ভূত নামানো। আসলে ভূতে ধরা বলে তো কোনো রোগ নেই। বড় হয়ে জেনেছি সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হলে মানুষ এমন করে এবং তার শরীরে অনেক শক্তি এসে ভর করে। ছোটবেলায় এগুলো দেখতাম আর ভাবতাম, একসময় এই অন্ধকার কেটে যাবে আর মানুষ তখন সব রোগের জন্য ডাক্তারের কাছে যাবে।

শহুরে জীবনেও গুজবের ক্ষমতা দেখার সুযোগ হলো বুয়েটে ভর্তি হওয়ার পর। প্রতিটি টার্ম ফাইনাল পরীক্ষার আগে ক্যাম্পাসে গুজব রটে যায়, এইবারও পরীক্ষা পেছানো হবে, তাই ছাত্ররা ঢিমেতালে পড়াশোনা করে। সারা টার্ম কোনোমতে চালিয়ে নিয়ে সবাই প্রিপারেটরি লিভের অপেক্ষায় থাকে পড়াশোনা করে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য, কিন্তু গুজবের কারণে কেউই তেমন মনোযোগ দিয়ে পড়ত না। পরীক্ষার সপ্তাহখানেক আগে সবাই উপলব্ধি করত যে পড়াশোনা করা হয়নি, তখন সবাই মিলে শুরু হয়ে যেত পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন এবং অবশেষে স্যারেরা পরীক্ষা পেছাতে বাধ্য হতেন। আমার মনে পড়ে না আমাদের চার বছরের পড়াশোনা শেষ করতে এমন কোনো টার্মের কথা, যেটাতে আমরা প্রথম রুটিনে পরীক্ষা দিয়েছি। তাই চার বছরের কোর্স শেষ করতে আমাদের লেগে যেত পাঁচ–ছয় বছর, এমনকি কখনো সাত বছর। পরবর্তীতে চাকরিজীবনে এসে সেই গুজবের অপকারিতা টের পেয়েছিলাম। আমাদের সহপাঠীরা অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তত দিনে পাস করে দুই বছর চাকরির অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলেছে।

গুজব ভয়ংকর, যখন সেটা মানুষের প্রাণসংহারী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে অহেতুক গুজবের অনেক মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে অত্যন্ত নির্মমভাবে। সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার ছিল গত বছর একজন মাকে ছেলেধরা সন্দেহে যখন পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। সেই মানুষ আসলে তাঁর নিজের মেয়েকে খুঁজতে গিয়ে গুজবের বলি হন এবং তাঁর মেয়ে দুটি এতিম হয়ে যায়। জানি না এখন তারা কোথায় আছে, কেমন আছে। আর করোনার এই দুঃসময়ে গুজব এখন মোটামুটি শিল্পে রূপ নিয়েছে। করোনা অন্যান্য আর দশটা ফ্লুর মতো হলেও এটা ছড়িয়ে পড়ে খুবই দ্রুত। এমনকি এটা মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর এটা যেহেতু সরাসরি ফুসফুসকে আক্রমণ করে, তাই বয়স্ক মানুষের জন্য বেঁচে থাকা অনেক কঠিন। তবু তাঁরা যে সেরে উঠছেন না, ব্যাপারটা এমন নয়। প্রথম আলোর সূত্রমতে, জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির তথ্য অনুযায়ী, করোনায় আক্রান্তের মৃতের হার মাত্র ৫ দশমিক ১৫ শতাংশ, কিন্তু যেহেতু পৃথিবীর প্রায় সমগ্র জনগোষ্ঠী এর দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে, তাই মৃতের সংখ্যাটা অনেক বেশি। স্বাস্থ্যকর্মীরা ছাড়া আর সবাই এই ক্রান্তিকালে গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করছে।

এরপর শুরু হলো করোনার চিকিৎসা নিয়ে গুজব। দেশ–কাল–পাত্রভেদে সব দেশেই কমবেশি গুজব দেখা দিল। বাংলাদেশে এখনকার ডিজিটাল যুগেও মানুষ যেহেতু ফকির, পানিপড়া এগুলোর ওপরেই প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য নির্ভর করে। তাই ফকিরদের ব্যবসা মোটামুটি রমরমা হয়ে গেল। কেউ একজন স্বপ্নে দেখেছে থানকুনিপাতা খেলে করোনা নির্মূল হয়ে যাবে। তখন সবাই দিন–রাত এক করে থানকুনিপাতা খোঁজা এবং খাওয়া শুরু করল। এ ছাড়া যেহেতু জীবাণুনাশক হিসেবে অ্যালকোহল, ভিনেগার, গরম পানি ব্যবহার করা হয়, তাই অনেকেই সেগুলো গিলে ফেলে বিপদ ডেকে আনল। আর এর সবই করা হলো হুজুগের বশে গুজবে কান দিয়ে। পাশের দেশ ভারতে শুরু হয়ে গেল গোমূত্র চিকিৎসা। একেবারে চায়ের কাপে করে গোমূত্র খাওয়া শুরু হলো এবং সেগুলো ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারও করা হলো। নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, আমাদের আশপাশের অনেকেই ভেতরে–ভেতরে এসব পদ্ধতি প্রয়োগও করেছেন।

আমি একসময় ভাবতাম, হুজুগের ব্যাপারটা শুধু বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের নাগরিকদের দখলে, কিন্তু এখন জানি হুজুগ আসলে হুজুগই। দেশ–কাল–পাত্রভেদে এটার কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াতে বছরে একটা দিন আছে, যার নাম ‘বক্সিং ডে’। সাধারণত বড়দিনের পরদিন এটা পালন করা হয়। এদিন সব দোকানে ছাড়ে সব পণ্য বিক্রি হয়। ছাড়ের সেই সব পণ্য কিনতে গিয়ে, হুড়োহুড়ি, লাথালাথি, চুলোচুলি সবই করে থাকেন উন্নত বিশ্বের নাগরিকেরাও। এগুলো যদি তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশের ঘটনা হতো, তাহলে চোখে লাগত না। কারণ, আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তাই সস্তায় একটা দরকারি পণ্য কিনতে পারলে সেটা হয় একটা সংসারের সারা জীবনের অর্জন, কিন্তু উন্নত দেশগুলোতে কাড়াকাড়ি মারামারি করে কেনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিলাসী সামগ্রী, যেগুলো বছর ঘুরতেই মডেল বদলে ফেলে। তাই বছর ঘুরতেই সেটা অকেজো হয়ে যায় এবং তখন আবার নতুন করে বক্সিং ডের দিন যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়।

উন্নত বিশ্বের মানুষ ঠিক কতটা হুজুগে, সেটার আবার প্রমাণ পাওয়া গেল করোনার প্রাদুর্ভাবের পর। অস্ট্রেলিয়ার সব দোকান থেকে টয়লেট টিস্যু আর স্যানিটাইজার রাতারাতি গায়েব হয়ে গেল। কী কারণে এখানকার মানুষ এই দুটি বস্তুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিল, তার নির্দিষ্ট কারণ কেউই বলতে পারেনি। আমার স্কুলপড়ুয়া মেয়ে আমাকে বলেছিল, বাবা চীনে যেহেতু করোনার প্রাদুর্ভাব চলছে, তাই চীন থেকে পণ্য আমদানি বন্ধ হয়ে যাবে। তাই মানুষ আগে থেকেই এগুলো কিনে স্টক করে রাখছে। জানি না এটা কতখানি সত্যি, কিন্তু বয়স্ক মানুষ যাঁরা দৌড়াদৌড়ি করে এগুলো কিনতে পারেননি, তাঁদের জন্য মুশকিল হয়ে গিয়েছিল। এরপর দোকানগুলো প্রতি কাস্টমারের জন্য পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল। এভাবে ভালোই চলছিল, কিন্তু কয়েক দিন ধরে আবার যখন করোনার দ্বিতীয় ধাক্কাটা এসে লেগেছে, তখন আবার নতুন করে টয়লেট টিস্যুর তাকগুলো ফাঁকা হতে শুরু করেছে। তার মানে হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ার লোকেরা আগেরবার থেকে শিক্ষা না নিয়ে আবার হুজুগে গা ভাসাচ্ছে। এমনকি এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য অস্ট্রেলিয়ার একটা রাজ্যে সেনাবাহিনীকে তলব করা হয়েছে।

আমার কেন জানি মনে হয়, হুজুগ সৃষ্টির আদি থেকে মানুষের মধ্যে ছিল না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সংখ্যা বেড়েছে আর সেই সঙ্গে বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদা। আর আধুনিকতা আমাদের একান্নবর্তী সমাজব্যবস্থাকে ভেঙে টুকরা টুকরা করে দিয়েছে। ফলে মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বার্থপর। এখন পরিবারগুলো শুধু নিজের এবং নিজের ছেলেমেয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর তাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে গিয়ে সবাই ছুঁচোর দৌড়ে শামিল, হোক সেটা বাড়ি–গাড়ি, লেখাপড়া, ভালো ফলাফল, ভালো চাকরি বা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য। সবকিছুই আমরা নিজের করে পেতে চাইছি সবার আগে। আমরা আমাদের প্রতিবেশী বা বয়স্ক বা যাঁরা শারীরিকভাবে অক্ষম, তাঁদের কথা ভাবছি না। জানি না এর শেষ কোথায়। তবে করোনা এসে মানবজাতির খুঁতগুলো একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল। এখন দেখার বিষয় আমরা এর থেকে কতটা শিক্ষা নিলাম?