একটি ডিপ্রেশন জয়ের গল্প

সোনিয়ার জন্ম নিউইয়র্কে। তিন বোনের মধ্যে সে সবার বড়। বাবা ছোটখাটো ব্যবসা করেন। মা গৃহবধূ। সোনিয়া বরাবরই পড়ালেখায় খুব ভালো, বিশেষ করে গণিত আর বিজ্ঞানে। ওদের পরিবারে কারোরই তেমন পড়ালেখা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। আমেরিকান সাদা পরিবারে এটা খুব সাধারণ ব্যাপার। তা ছাড়া যে সময়ের ঘটনা, সে সময়ে মেয়েরা গণিত, বিজ্ঞান—এসব বিষয়ে কম পড়ত। হাইস্কুলে পড়ার সময় কেমন করে যেন ওর শখ চাপল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে। ওর বন্ধুবান্ধবও খুব হাতে গোনা। স্কুলের মেয়েরা বেশির ভাগ সে সময় সাজগোজ, কনসার্ট, পার্টি নিয়ে ব্যস্ত। বয় ফ্রেন্ড আর ডেট খুঁজতেও ব্যস্ত। সোনিয়ার সঙ্গে ওরা খুব একটা ভাব জমায় না। এমন না যে সোনিয়ার ইচ্ছে করে না, কিন্তু তার ধরনটাই অন্য রকম। ছেলেরাও তার প্রতি তেমন বেশি আগ্রহ দেখায় না। তা–ও যে দু–একজনের সঙ্গে একটু ভাবসাব হয়েছিল, খুব একটা বেশি এগোয়নি। শেষ পর্যন্ত নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে সে। তা ছাড়া ভালো ইউনিভার্সিটিতে পড়বে এ উত্তেজনায় সে তখন অনেক বেশি স্বপ্নে বিভোর।

ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে সে কিছুটা ঘাবড়ে গেল। তার ক্লাসে সে একা মেয়ে। অনেকটাই একা হয়ে গেল সে। তাছাড়া হাইস্কুলে রেজাল্ট যত ভালো হতো, এখানে পড়ালেখা অনেক বেশি কঠিন। সে হয়ে গেল একজন মাঝারি মানের ছাত্রী। সব মিলিয়ে তখন থেকেই অল্পস্বল্প ডিপ্রেশনের শুরু। তবে অন্য একটি ঘটনা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। ক্লাসে একমাত্র মেয়ে বলে সব ছেলেই তার কাছে ঘেঁষতে চাইত। সে–ও ব্যাপারটা উপভোগ করতো না তা নয়। তবে ভাবেনি ক্লাসের সবচেয়ে তুখোড় ছেলে কাইলের সঙ্গে তার প্রেম হবে। কাইল শুধু পড়ালেখাতেই দুর্দান্ত নয়, মানুষ হিসেবে চমৎকার, প্রবল রসবোধ আর সুদর্শন। সেই তুলনায় সোনিয়াই বরং খুব সাধারণ। তাদের গভীর প্রেম হয়েছিল, বিয়েও হয়ে গেল যথা সময়ে। কাইলের মতো অত ভালো রেজাল্ট না হলেও দুজনেরই নামকরা কোম্পানিতে চাকরি হয়ে গেল। বিয়ের পর কয়েক বছর বেশ ফুরফুরা গেল।

এরপর কোথা থেকে যেন দুষ্টু এক টুকরো মেঘের মতো সোনিয়ার অসুখটার শুরু। প্রথম প্রথম এটা যে কোনো অসুখ, সেটাই তো কেউ বোঝেনি। ও নিজেও না। খালি কী যেন শূন্যতা। কোনো কাজে আগ্রহ পাচ্ছিল না। বাচ্চা নেওয়ার আলোচনা এলেই ও ঘাবড়ে যেত। কাইলের কাছে সময় চাইত। আপাতদৃষ্টিতে জীবনের কোথাও কোনো অপূর্ণতা নেই। অথচ কী গভীর বিষাদ ঘিরে ধরত ওকে। কাইল খুব বাস্তববাদী মানুষ। জীবনে নানা ঘাত–প্রতিঘাত খাওয়া। প্রথম প্রথম সোনিয়ার সমস্যাই ও বুঝতে পারছিল না। এরপরও ডাক্তারের কাছে গেছে ওর অনুরোধে। অনেক ডাক্তার দেখিয়ে অনেক ওষুধ বদলে, বিভিন্ন থেরাপিস্ট বদলেও কাজ হচ্ছিল না। সোনিয়ার এক সময় কাইলকেও অসহ্য লাগতে শুরু করে। ও জড়িয়ে পড়ে অফিসের এক কলিগের সঙ্গে। নতুন সম্পর্কের উত্তেজনায় প্রথম কিছুদিন মনটা একটু হালকা লাগছিল। অবৈধ শারীরিক সম্পর্কেও জড়িয়ে যায়। আর তারপরই একধরনের অবসাদ ঘিরে ধরে। বিষণ্ণতার সঙ্গে যোগ হয় অপরাধ বোধ। কিছুদিন নিজেকে শাসন করে চলে সে। কিন্তু না। আনন্দের সন্ধানে আবার জড়িয়ে পড়ে আরেক সম্পর্কে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কোনো স্বস্তি পাচ্ছিল না সে। বরং অপরাধ বোধ, বিষণ্ণতা সব তখন চরম পর্যায়ে। জীবনের উদ্দেশ্য কী, এই চিন্তা দিনরাত তখন তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। জীবনের কোনো উদ্দেশ্য না পেয়ে শেষ পর্যন্ত সে আত্মহত্যার চিন্তা করে। ডাক্তার তার এই চিন্তা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেন। সেই ভয়ঙ্কর দুঃসময়ে দেবদূতের মতো তার জীবনে এসেছিল এক নার্স। যে তার পাশে বসে প্রার্থনা করত। সেই তাকে জীবনের অর্থের সন্ধান দিয়েছিল। ঈশ্বরের প্রেম, জীবে প্রেম আর তার মাধ্যমে ঈশ্বরের সন্তুষ্টি অর্জন। সে এত দিন চারপাশের মানুষের মাপকাঠিতে নির্ধারিত সংজ্ঞায় জীবনকে সাজাতে চেয়েছিল। আর সেই সংজ্ঞাটা তার কাছে অর্থহীন মনে হতো। যখনই কোনো ব্যর্থতা আসত, সে আতঙ্কিত হতো। মনে হতো তাকে কেউ সম্মান করবে না, ভালোবাসবে না। কিন্তু ঈশ্বরের প্রেম শর্ত সাপেক্ষ না। কোনো প্রতিযোগিতা নেই, ব্যর্থতা নেই। বরং তার দুশ্চিন্তার ভার দিয়ে দেওয়া যাবে ঈশ্বরের ওপর। আর ঈশ্বরের সৃষ্টি যে মানুষ, তার সেবা করলে ঈশ্বরের সন্তুষ্টি আর সেটাই মানুষের জীবনের লক্ষ্য। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে থেরাপিস্টের সঙ্গে গিয়ে সে নতুন করে আলোচনা শুরু করে। এত দিন থেরাপিস্ট এসব বললেও সে ঠিক অনুধাবন করতে পারেনি। তার একদমই বিশ্বাস ছিল না। এখনো অনেক বিশ্বাস তা নয়, তবে সে বিশ্বাস করতে চায়। এই পথটা সে খুঁজে দেখতে চায়।

তারপর থেকে সোনিয়ার জীবন বদলাতে শুরু করে। প্রথম কাজটা ছিল সব চেয়ে কঠিন। কাইলের কাছে সব স্বীকার করা। তার সমস্ত ভুলের কথা। সে প্রায় নিশ্চিত ছিল কাইল তাকে ছেড়ে চলে যাবে। তবুও সব সাহস সঞ্চয় করে সে বলল এবং অবাক হয়ে দেখল আরেক দেবদূতকে। অনেক ভেঙে পড়েও নিজেকে সামলে নিয়েছিল যে সোনিয়ার কাছে ঈশ্বরের দ্বিতীয় রূপ হয়ে যেন এসেছিল কাইল। সোনিয়া বিভিন্ন সেবামূলক সংগঠনের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলল। নিয়মিত চার্চে যাওয়া শুরু করল। বাইবেল পাঠ আর ঈশ্বরের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলা, নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দেওয়া। চার্চের নতুন বন্ধুরা অনেক সাহায্য করল। কাইল ঈশ্বরে অতটা বিশ্বাসী না হলেও সোনিয়ার বিশ্বাসের কোনো অমর্যাদা করেনি। ওষুধ ছাড়তে পারেনি সোনিয়া। থেরাপিস্টের কাছেও যেতে হচ্ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে নিজের ভেতরে একধরনের স্থিরতা সে অনুভব করছিল। জীবনের প্রতি অনীহা কমে গেল, যদিও জীবনের মূল লক্ষ্য গেল বদলে।