অবশেষে স্কুলের আঙিনায় আরিশা

আরিশা। ছবি: লেখক
আরিশা। ছবি: লেখক

 আরিয়ানা স্কুলে যাওয়ার সময় মাঝেমধ্যে ওর একমাত্র ছোট বোন আরিশাও স্কুলে যাওয়ার বায়না ধরত। স্কুলে যাওয়ার বয়স না হওয়ায় বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে ওকে বাসায় রাখতে হতো। বড় বোন আরিয়ানার স্কুলের বিভিন্ন ফাংশনে মায়ের সঙ্গে যাওয়ার সুযোগ পেলে খুবই খুশি হতো। এভাবেই একটা সময় ও পৌঁছায় স্কুল ভর্তির সন্ধিক্ষণে। কিন্তু বাদ সাধল ওর বয়স।

জাপানে শো গাক্কুতে (প্রাথমিক বিদ্যালয়) প্রবেশে ন্যূনতম বয়স ছয় বৎসর, এর কম হলে পরবর্তী সেশনের জন্য অপেক্ষা ছাড়া গত্যন্তর নেই। ছয় বৎসর পূর্ণ হতে মাত্র দুই মাস কম থাকায় দীর্ঘ একটি বছর ওকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমাদের দেশের মামা, খালু, টাকা-পয়সা বা রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা রাখার সুযোগ এ দেশে কল্পনাতীত বিষয়। নিয়মের কাছে সব ক্ষমতাই অকার্যকর। তাই যথারীতি এক বছর অপেক্ষার পর এই এপ্রিল সেশন ছিল ওর স্কুলে যাওয়ার সময়। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির মধ্যে স্কুল ভর্তির সব আনুষঙ্গিকতাও সম্পন্ন করা হয়, আবারও বাধা, এবারের বাধা বয়সের নয়, বৈশ্বিক মহামারি করোনার।

স্কুলে যেতে না পেরে আরিশার মন খারাপ হলেও আমার মনের মধ্যে ভর করে আনলাকি থার্টিনের কুসংস্কার। কারণ ওর জন্ম তারিখটি ছিল ১৩। যদিও আধুনিক সমাজে এই আনলাকি থার্টিন অন্য দিন-তারিখের মতোই একটি সাধারণ দিনক্ষণ। যা হোক, এই করোনাকালে বাধ্য হয়েই দুই বোনের অবস্থান বাধ্যতামূলক গৃহবাস। করোনার সতর্কতার কারণে ঘরের বাইরের খেলাধুলা এবং মা-বাবার সঙ্গে মার্কেটে যাওয়াও ছিল প্রায় বন্ধ। আর ওদের এই দীর্ঘদিনের গৃহবাসে কম্পিউটারে বসে কার্টুন, গেম এবং নিয়মমাফিক সকাল-সন্ধ্যায় পড়তে বসা ছিল নিত্যদিনকার রুটিন।

শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে না পারলেও শিক্ষকেরা স্কুলে এসে নির্দিষ্ট বিরতি দিয়ে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে ফোন করে ওদের সঙ্গে কথা বলে স্বাস্থ্যের খবরাদি নিতেন এবং করোনাকালের সতর্কতা সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দিতেন। অভিভাবকদের প্রতি ১০ দিন পরপর স্কুলে গিয়ে সন্তানের পূর্ববর্তী হোমওয়ার্কের ফাইল জমা দিয়ে নতুন হোমওয়ার্কের ফাইল নিয়ে আসতে হতো।

হোমওয়ার্কের লেনদেনের মাধ্যমে পড়াশোনা চালু থাকলেও সরাসরি স্কুলে যেতে না পারা এবং বাসার বাইরে খেলতে না পারায় আমার মেয়েদের মধ্যে অসহিষ্ণুতা এবং হাঁসফাঁস ছিল লক্ষণীয়। আমাদের স্কুলবেলায় স্কুল বন্ধ থাকলে আমাদের আনন্দের সীমা থাকত না, তা ছাড়া স্কুল ফাঁকিতে আমরা তৈরি করতাম পেটব্যথা, মাথাব্যথার মতো বিভিন্ন অজুহাত। প্রবাসে বাচ্চাদের মধ্যে স্কুলে যাওয়ার উচ্ছ্বাস দেখার মতো, আর স্কুল ফাঁকির জন্য অজুহাত তৈরি ওদের কাছে চিন্তাতীত বিষয়। এর কারণ এখানকার ভয়-ভীতিহীন, চাপমুক্ত, আনন্দময় পাঠদানপদ্ধতি এবং বন্ধুসুলভ শিক্ষক।

বোনের সঙ্গে আরিশা। ছবি: লেখক
বোনের সঙ্গে আরিশা। ছবি: লেখক

শৈশবে আমরা স্কুল ফাঁকি দিতে যে মিথ্যা অজুহাত তৈরি করি এবং সেই অজুহাতকে সত্যতা দিতে যে অভিনয় করি, তা মা-বাবা বুঝেও না বোঝার ভান করতেন। শিশুকালের এই ফাঁকিবাজির বিজয়কে আমাদের কাছে বড় সফলতা বলে মনে হতো। শিশুকালের এই ফাঁকিবাজি শিশুকালেই শেষ হয় না। বরং জীবনের প্রতিটি স্তরে প্র্যাকটিসের মাধ্যমে আমরা একেকজন দক্ষ মেধাবী ফাঁকিবাজে পরিণত হই। এর প্রভাবে বন্ধু মহলে, স্বামী-স্ত্রীর সংসার জীবনে, চাকরিকাল এমনকি অবসরজীবনেও চলে ক্রমাগত মিথ্যা আর ফাঁকিবাজির বেসাতি। তাই জীবনের প্রতিটি স্তরই প্রকৃত সত্যের সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হয়। জীবনের প্রতিটি স্তরই হয় কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত।

এখানকার স্কুলে শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের সত্য বলার জন্য ‘সদা সত্য কথা বলিব’, ‘মিথ্যা বলা পাপ’ তা পড়ান না। মূলত মিথ্যা বলার ক্ষেত্র তৈরি করেন না। তাই শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিথ্যা বলা বা মিথ্যা অজুহাতের জন্য অভিনয়ের প্রয়োজন পড়ে না। শিশুমনে সত্য বলার এই দৃঢ় গাঁথুনির কারণে জাপানিদের মধ্যে মিথ্যা বলার চর্চাটা চোখে পড়ে না। তবে এখানকার শিক্ষার প্রতিটি স্তরে শিক্ষার্থীদের নিয়মশৃঙ্খলা রপ্ত করাতে শিক্ষকেরা যত্নশীল। প্রবাসী অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানের চেয়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সাধারণ নিয়মকানুন সম্পর্কে অধিকতর জানা থাকলেও শুধু পালনের ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম। প্রায়ই দেখা যায়, অভিভাবকদের তাঁদের বাচ্চাদের মুখে শুনতে হয়, ‘বাবা সবুজ বাতি জ্বলেনি, তুমি রাস্তা পাড়ি দিচ্ছ কেন?’ ফলে বাধ্য হয়ে বাবাকে মাঝ রাস্তা থেকে ফিরে আসতে হয় বা রাস্তায় গাড়ি না থাকলেও বাচ্চার সঙ্গে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় সবুজ বাতি জ্বলার অপেক্ষায়।

এ দেশের শিশুশিক্ষার্থীদের স্কুলে আসা-যাওয়ার সময় সুশৃঙ্খল সারিবদ্ধভাবে লাইন ধরে রাস্তার পাশ ধরে হেঁটে চলার সৌন্দর্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর। দেখলে মনে হয়, একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর এগিয়ে চলার দৃশ্য। এভাবেই জাপানিরা তৈরি করে তাদের আগামীর জীবনযুদ্ধের সৈনিকদের। করোনার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে এলে সরকার ১ জুন থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এতে আরিশার সুযোগ আসে স্কুলে যাওয়ার। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও করোনা কেড়ে নেয় আড়ম্বরপূর্ণ নিওগাকুশিকি (ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠান)। করোনাভাইরাসের সতর্কতার কারণে অনুষ্ঠিত হয় সাদামাটা নিওগাকুশিকি। নিওগাকুশিকির বহুল আকাঙ্ক্ষিত দিনটিকে স্মৃতিতে ধরে রাখতে ছবি তোলার সময় ও ভি-চিহ্ন দেখিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। দেখে মনে হচ্ছিল, অবশেষে আরিশা জয় করেছে বয়স এবং করোনাকে, পৌঁছাবে আজ স্কুল আঙিনায়।