মা আমার জমানো টাকা দিয়েছিল বড় ভাইকে

মায়ের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
মায়ের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

ছোট সময় আমাদের গ্রামে ৫ পয়সা দামের রঙিন কাঠি আইসক্রিম পাওয়া যেত। পরবর্তী সময়ে ১০ পয়সা হয়েছিল সেই আইসক্রিমের দাম। একসময় সেই আইসক্রিমে ভিন্ন স্বাদ এবং রং বদলে ৪ আনা বা ২৫ পয়সায় বিক্রি করা হতো।

স্কুলের কাছে রাস্তায় এই আইসক্রিমওয়ালা প্রতিদিন বসে আইসক্রিম বিক্রি করত। ছোট ছেলেমেয়েরা এই আইসক্রিম খেতে তাদের মা-বাবার কাছে আবদার করত। আমিও তা-ই করতাম। যে কারণে মা আমাকে প্রায় ৫-১০ পয়সা দিত স্কুল থেকে ফেরার সময় আইসক্রিম কিনে খেতে।

সময়-সময় বড় ভাই ঢাকা থেকে সপ্তাহান্তে গ্রামের বাড়ি গিয়ে পরের দিন ভোরবেলা আবার যখন ঢাকা ফিরে আসত, আসার সময় আমাকে তার পকেট ঝেড়ে ৫-১০ পয়সা, কখনো এর কম-বেশিও দিত। তাদের দেওয়া পয়সাতেই আমার চাহিদা পূরণ হতো না তখন। বাবার পকেট বা মায়ের আঁচল থেকে কিংবা ঘরের কোথাও মায়ের লুকিয়ে রাখা টাকা-পয়সাতেও আমি গোপনে হাত দিয়েছি। যাকে সহজ বাংলায় চুরি বলে, সেই চুরিও করেছি। তবে খুব বেশি কখনো চুরি করিনি। বেশি হলে ১০-২০ পয়সা চুরি করতাম। এসব দিয়ে আইসক্রিম, ভাজা বুট, চিনাবাদাম, কাঠি লজেন্স কিনে খেতাম। তবে চুরি করা সব পয়সা কখনো নষ্ট করিনি।

আমার বড় ভাইবোন সবাই আমার সম্পর্কে বেশ জানত, আমি খুব কিপটে ছিলাম। যে কারণে মা কিংবা বড় ভাইয়ের দেওয়া সেই পয়সা একটি লাল মাটির ব্যাংক টোপা বা টিনের কৌটায় জমাতাম। এমনও দিন যেত যে একবার কোনো পয়সার মুদ্রা সেখানে ভরে পুরো পয়সা বের করে দশবার গুনেছি। মাটির ব্যাংক টোপা খোলা না গেলেও বোনদের কাছে চুলের ক্লিপ চেয়ে নিয়ে তা দিয়ে খুঁচিয়ে সব পয়সা বের করে গুনে আবার ভরে রাখতাম। এভাবে সময়-সময় গুনে দেখেছি, যখন ১০০ পয়সা হতো, তখন মায়ের কাছে তা দিয়ে বিনিময়ে এক টাকার নোট চেয়ে নিতাম। ছোট আমি টাকা-পয়সার ব্যাপারে খুব হিসেবি ছিলাম আর এ জন্যই মনে হয় বড় হয়ে টাকা-পয়সার ব্যাপারে আমি বেশ উদাসীন হয়েছি। অর্থাৎ টাকার লোভ আমাকে মোটেও টানেনি।

বিষয়টি বলছি এ জন্য যে একসময় দেশে যুদ্ধ যখন পুরোদমে বেধে গেল, তখন বড় ভাই ঢাকা থেকে অনেকটা নিরাপত্তার কথা ভেবে চলে এল গ্রামে। গ্রামে এসে সে তখন তাদের হাইকমান্ডের নির্দেশে তার সমবয়সীদের সংগঠিত করেছে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য। তত দিনে বড় ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করে বিদেশি কোন সংস্থায় চাকরি নিয়েছে (বড় ভাইবোনের কাছে শোনা গল্প)। গ্রামে এসে তার সমবয়সীদের নিয়ে ভারতে যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে যাওয়ার সবকিছু পাকা হলে মা-বাবা বড় ভাইকে সেই সময় যা সামর্থ্য তা-ই তার সঙ্গে দিয়েছিল, ভারত যাওয়ার পথে এবং যাওয়ার পর যেন কোনো সমস্যা না হয়, তাই।

অজানা অচেনা জায়গায় যাওয়ার কালে তাকে বেশি টাকা খরচ হিসেবে দিতে চাইলেও সামর্থ্যের বাইরে কিছু করতে পারছিল না তারা। তখন আমার কাছে মা বলল, দাদাকে যেন আমার জমানো টাকা-পয়সাগুলো দিয়ে সাহায্য করি। পরে আবার আমাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে।

আমার সেই সময়কার ভেতরের অবস্থা কাউকে বলে বোঝানো তো দূরের কথা, বিশ্বাস করানোর মতো ভাষাও আমার নেই। তবে আমি এটুকু বলতে পারি, দেশের জন্য মা তার বড় সন্তানকে এভাবে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য সমূহ বিপদের কথা জেনেও যখন বাড়ি থেকে বিদায় দিচ্ছিল, তখন আমি আমার জমানো টাকা না দিয়ে থাকতে পারিনি। সঙ্গে সঙ্গে আমি হাসি মুখে আমার জমানো খুচরো টাকা-পয়সার পুরোটা মায়ের হাতে তুলে দিলে মা সেগুলো ব্যাংক টোপা থেকে বের করে গুনে পুরো টাকা-পয়সা বড় ভাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স কম ছিল। তবে আমি যে সরাসরি সেই যুদ্ধ দেখেছি এবং পরোক্ষভাবে যোদ্ধাদের সেবা করেছি, সেটাই যেন মনে শান্তি। সেটা দেখেছি এবং করেছি বলেই আজ মায়ের কথা লিখতে গিয়ে যুদ্ধকালীন সেই ঘটনার কথা লিখতে পারছি।

সত্যি আমাদের মাতৃভূমিকে পাকিস্তানি শত্রুসেনাদের হাত থেকে মুক্ত করতে আমার মায়ের ভূমিকার মতো হাজার মা তাদের সন্তানদের যুদ্ধে পাঠিয়েছিল। যে কারণে বিজয় ছিনিয়ে আনাটা হয়েছিল ত্বরান্বিত। আর এ জন্যই সেসব মায়ের প্রতি আমার শ্রদ্ধা নিরন্তর। চলবে...