ইতালির ঘটনা থেকে শিক্ষা নিলাম কি

ছবি রয়টার্স
ছবি রয়টার্স

ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। তাদের অন্যান্য সৃষ্টি থেকে আলাদা করে তাদের বিবেক, যা সৃষ্টিকর্তার সুনির্দিষ্ট কিছু উদ্দেশ্যের কারণে মানুষকে প্রদান করা হয়েছে। আমি বিবেক বলতে সেই জিনিসকে বুঝি, যা দ্বারা ভালোকে মন্দ থেকে এবং মন্দকে ভালো থেকে আলাদা করা যায়। এটা এমন, একটি উপলব্ধির নাম, যা আমাদের মানুষ হিসাবে প্রমাণ করতে সাহায্য করে। আর এই বিবেক নামক জিনিসটার ওপরে আমাদের সমাজব্যবস্থা অনেকাংশে টিকে থাকে। বিবেকের উপস্থিতি আমাদেরকে সভ্য করে আর অপ্রতুলতা বন্য জানোয়ারদের কাতারে দাঁড় করায়।

এবার প্রসঙ্গে ফেরা যাক। জাতিগতভাবে আমরা দ্বিধাবিভক্ত সেই জন্মলগ্ন থেকেই। মতের বিভক্তি, পথের বিভক্তি, চিন্তার বিভক্তি, চেতনার বিভক্তি, সামাজিক বিভক্তি ও অসামাজিক বিভক্তি। এ রকম অনেক বিভক্তিকরণের মধ্য দিয়েই আমরা বড় হই। নিজেদের ভালো কীভাবে বুঝতে হয়, সেটা আমরা কৈশোরেই শিখে যাই বা আমাদের শেখানো হয়। অতি স্বল্প স্বার্থে নিজেদের নীতি বিকিয়ে দিতে আমরা সিদ্ধহস্ত।

আজকে যে আমার উপকারে আসছে, কাল প্রয়োজনে তার পশ্চাদ্দেশে লাথি প্রয়োগ করতেও আমাদের দ্বিতীয়বার চিন্তা করার প্রয়োজন হয় না। নীতির বিসর্জন বিষয়টাকে আমরা সোজা বাংলায় দুর্নীতি বলি। আমরা বরাবরই এই তথাকথিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে খুবই তৎপর থাকি। যদিও দুর্নীতি বিষয়টা সর্বজনীনভাবে আমাদের রক্তে মিশে আছে। ঘুষ লেনদেন, তেলবাজি, ক্ষমতার অপব্যবহার এসব হলো দুর্নীতির শাখা-প্রশাখা।

বাংলাদেশে খুব কম প্রতিষ্ঠানই আছে, যেখানে ঘুষ লেনদেন, তেলবাজি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয় না। মানে সোজা বাংলায় দুর্নীতি করা হয় না। আমার মনে আছে, যখন আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি আমার ক্লাসের ফার্স্টবয় ছিল আমাদের স্কুলের এক শিক্ষিকার ছেলে। আমি মোটামুটি ভালো ছাত্র ছিলাম এবং চেষ্টা করতাম; কীভাবে প্রথম সারির ছাত্র হওয়া যায়। সে জন্য আমার চোখ থাকত প্রথম বেঞ্চে। সুযোগ হলেই বসে পড়তাম। মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করতাম ক্লাসে শিক্ষকেরা কী বলছেন, তা বোঝার জন্য। একদিন সেই শিক্ষিকা তার সুসন্তানকে প্রথম বেঞ্চে বসানোর জন্য আমাকে উঠিয়ে দেন। আমি বিষয়টিকে খুব একটা ভালোভাবে নিইনি তখনো। আজ যখন বুঝতে শিখেছি, তখন আমি এই বৈষম্যের নাম দিয়েছি দুর্নীতি।

কিছুটা বড় হওয়ার পর গ্রামের এক সালিসে যাই। বহিরাগত কোন একটি মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে এলাকার কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তির সন্তানদেরকে অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে ওই মেয়েকে এবং তার পরিবারকে নানা কটু কথা শুনিয়ে কিছু আর্থিক সহায়তা দিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয়। আজ আমি সেই ঘটনার নাম দিয়েছি দুর্নীতি।

বিদেশ আসব বলে পাসপোর্ট করতে যাই। ফরম নেওয়া থেকে শুরু করে পূর্ণাঙ্গ অনুমোদন পেতে দালাল এবং একজন অফিসারকে কিছু টাকা দিতেই হবে। তা না হলে নাকি পাসপোর্ট দেরিতে মিলবে। কিছুটা নিরুপায় এবং বাধ্য হয়েই টাকাটা দিই। ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। এক মাস পরে পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন করার জন্য থানার একজন পুলিশ আসে আমার বাসায়। সব তথ্য–উপাত্ত সঠিক থাকা সত্ত্বেও তিনি ইনিয়ে-বিনিয়ে চা-পানি খাওয়ার জন্য কিছু চাইলেন। আমার মামা তার হাতে ৫০০ টাকার একটি নোট গুঁজে দেওয়ার পরই আমার পাসপোর্ট ভেরিফায়েড হলো। তখন বিষয়টা স্বাভাবিক মনে হলেও এখন আমি বলতে পারি সেটা দুর্নীতি ছিল।

বিদেশ আসার প্রক্রিয়ার কথা বলতে গেলে অনেক লম্বা ইতিহাসের জন্ম হয়ে যাবে। এড়িয়ে গিয়ে আপাতত বর্তমানে ফেরা যাক। বেশ কিছুদিন যাবৎ গণমাধ্যমে কিছু নিউজ দেখে নিজেকে আবারও ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হয়। করোনাকালীন এই সময়ে মানুষ যেখানে জীবন বাঁচাতে হিমশিম খাচ্ছে, তখনো আমাদের দেশের কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। চিকিৎসার মতো মানবসেবার উঁচু স্তরের একটি প্রতিষ্ঠানকেও ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত কলঙ্কিত করে রেখেছে এরা। বহির্বিশ্বে যেখানে সরকারি খরচে করোনা টেস্ট করানো হচ্ছে, সেখানে আমাদের সরকার চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বাস্থ্য খাতকে অকার্যকর করে ফেলা হয়েছে। যখন শুনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাও হাজার কোটি টাকার মালিক তখন নিজের মাথা লুকানোর মতো জায়গা পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে যায়। এত হাজার হাজার কোটি টাকার মতো কঠিন হিসাব আমরা সাধারণ জনগণ বুঝি না। তবে এতটুকু বুঝি স্বাস্থ্য খাতটা কে ঢেলে সাজাতে অনেক টাকার প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন কিছু নিবেদিতপ্রাণ মানুষ এবং প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মনীতির প্রতিপালন। সরকার তো টাকা দিচ্ছেই, সেটার যথাযোগ্য ব্যবহার সুনিশ্চিত করতে পারলে আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাত পৃথিবীর অন্যতম সেরা স্বাস্থ্যব্যবস্থার একটি হতে পারে। কিন্তু যারা টাকার লোভে মানুষের টেস্টের ফলাফল নিজেদের ইচ্ছামতো নেগেটিভ–পজিটিভ বানিয়ে দিচ্ছেন, তাদের দ্বারা স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি তো দূরে থাক, পুরো ব্যবস্থাকেই অকার্যকর করে দেবে এটা সুনিশ্চিত।

আজকাল যারা বিদেশ ভ্রমণ করছেন, তাদের অন্যান্য ডকুমেন্টসের সঙ্গে করোনা টেস্টের ফলাফলও প্রয়োজন হয়। একবার চিন্তা করে দেখুন এরা টাকার বিনিময় তাদেরকে নেগেটিভ রেজাল্ট দিয়ে দিল এবং সেই লোকগুলো প্রবাসে গিয়ে নিজেদেরকে করোনা বোমা উপাধিতে ভূষিত করল। ইতালির ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন আছে। যেহেতু আমাদের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর একটা বৃহৎ অংশ প্রবাসে থাকেন, সে ক্ষেত্রে সরকারের উচিত এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে জরুরিভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। শাস্তি স্বরূপ তাদের সব জনবলকে ছয় মাসের জন্য সরকারি স্বাস্থ্যসেবার কাজে ব্যবহার করুন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানসম্পন্ন লোক নিয়োগ অত্যাবশ্যকীয়।

দুর্নীতি বিষয়টাকে একদিনে মিটিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে পারিবারিকভাবে দুর্নীতিবিরোধী শিক্ষা দিতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষকেরাই পারেন একজন মানুষকে ভবিষ্যতের দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তুলতে। দেশের অর্থনৈতিক বিভাজনটা কমিয়ে আনতে পারলে দুর্নীতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিশ্চিহ্ন হতে থাকবে। একটি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ দেখার আশায় রইলাম।