দেখতে চাই না এমন দেশ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ঢাকা শহরে এসেছিলাম ২০০৭ সালে। একটি শিশুর বেড়ে ওঠার কোনো পরিবেশ এই শহর দিতে পারেনি, আজও পারে না। তবু জীবনমানের পরিবর্তন কিংবা মাস গেলে কটা টাকা বেশি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে একেবারেই অগ্রাহ্য করা যায় না। মানুষ বড় হতে চায়, সুখী হতে চায়। সুখী না হোক, অন্যকে অন্তত দেখাতে চায় সে সুখে আছে। ফেসবুকের কল্যাণে অন্যকে দেখানো এখন আগের চেয়ে অনেক সোজা, যেটা কঠিন, সেটা হলো সত্যিকারের সুখে থাকা।

‘মানুষ ভালোবাসতে ভুলে গেছে’, দেয়ালে সুবোধের ছবির পাশে এই লেখা দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। সত্যিই কি মানুষ আর ভালোবাসতে পারছে না? খবরের কাগজ আর আশপাশের মানুষের কথপোকথনের এমন পরিবর্তন দেখে আমিও বুঝলাম, আমরা শিক্ষিত হওয়ার আগে বড়লোক হয়ে গেছি। বড়লোক শব্দটা এখানে নেগেটিভ অর্থে ব্যবহৃত এই কারণে যে তারা নিজেদের ড্রয়িংরুম থেকে বাথরুম—সবই অন্যদের ঘুরে ঘুরে দেখায়। টাকার বিনিময়ে পাওয়া জিনিস নিয়ে এমন গর্ব দেখে আমি সত্যিই বড়লোক আর ছোটলোক শব্দের দূরত্ব ক্রমে কমে যেতে দেখি।

একটা সময় জ্ঞানী মানুষদের কদর ছিল। মানুষ সম্মান দিত। ছেলেমেয়েকে ম্যাট্রিকের আগে নিয়ে গিয়ে বলত, ‘দোয়া চেয়ে নে, উনি অনেক জ্ঞানী মানুষ।’ আজকাল জ্ঞানীরা ১৩ হাজার টাকা দিয়ে ঢাকার গরিব এলাকাগুলোয় বাসা ভাড়া করে থাকে। কোনো একটা কলেজে মাস্টারি করে, টিউশনি করে৷ দুটো দিন বাড়িভাড়া দিতে দেরি হলে অশিক্ষিত বাড়িওয়ালা খোঁচা দিয়ে কথা শোনায়। সন্তানকে ভালো শিক্ষা দিতে গিয়ে ভালো স্কুলে ভর্তি করে। সন্তান দেখে, তার বন্ধুরা গাড়িতে করে আসে, তাদের কাছে জীবনের প্রবলেম বলতে বিপরীত লিঙ্গের এটেনশন না পাওয়া আর সময়মতো ইয়াবা কিংবা গাঁজার সাপ্লাই না আসা।

এই অপরিকল্পিত নগরায়ণ আর ক্ষয়ে যাওয়া সামাজিক কাঠামোর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তবু খারাপ লাগে, যখন দেখি মানুষ একের পর এক ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে উপায় না পেয়ে। এটা তো সত্যি, আমরা পারিনি গ্রামগুলোকে উন্নত করতে। নাহলে এত মানুষ শহরে আসতই না। তবু একটা সংসার, একটা স্বপ্ন, একটা বহুকাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যৎকে বিদায় জানিয়ে ফিরে যাওয়ার নামই বোধ হয় বেঁচে থাকা।

লোকদেখানো সুখে থাকা দিয়ে মানুষের ঘুম আসে না। ডিপ্রেশন, ইনসোমেনিয়ার মতো নতুন আমদানিকৃত শব্দ আমাদের পিষে খায় রাত ১২টার পর থেকে। আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়া কিংবা ক্লাস টুর বাচ্চার ওপর ১০টা বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার সামঞ্জস্যতা না দেখে আমরা মুখ লুকাই ফেসবুকে। বাবা–মাকে জড়িয়ে ধরতে না পারার মতো দূরত্ব রেখেই আমরা কাছে টেনে নিই কত দূরের অচেনা ফেসবুকের বন্ধুদের।

সব বদলে গেছে। দেশে পর্যাপ্ত আইসিইউ নেই। গবেষণা করার মতো আন্তর্জাতিক মানের একটা বিশ্ববিদ্যালয় নেই। অলিতে-গলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে কিন্ডারগার্টেন আর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি। করোনার মতো মহামারি মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা। আর সামাজিকভাবে মানুষ সরে যাচ্ছে দূর থেকে দূরে। কাউকে দোষ না দিয়ে আমরাই যদি নিজেদের হাত না ধরি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যতের দায় আমরা কোনো ঈশ্বরের ওপরই চাপাতে পারব না।

নির্মলেন্দু গুণ বলেছিলেন—
এমন বাংলাদেশ কখনও দেখোনি তুমি
আমি সত্যিই দেখিনি, দেখতে চাই না এমন বাংলাদেশ।


*শিক্ষার্থী: তালিন ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, তালিন, এস্তোনিয়া