বিশের বিষ
আজ বৃহস্পতিবার, রিফাত ক্লাসে আসেনি। স্বভাবত ‘class bunk’ জিনিসটা রিফাতের সঙ্গে যায় না। বিষয়টা রীতিমতো অবাক করার মতো।
আগামীকাল শুক্রবার, সেই কারণে ভার্সিটিও বন্ধ। সবার যেমন বন্ধের দিনে মনে ঈদের আনন্দ নেমে আসে তেমনটা রিফাত নয়। রিফাতের কাছে এক দিন ভার্সিটি বন্ধ মানে এক দিন বটতলার আড্ডাটা বন্ধ। এটাকে আড্ডা না বলে ‘group study’ বলা বেটার। দিন শেষে সারা দিন ক্লাসে কে কী বুঝেছে, কে কী বোঝেনি সবই বটতলাতে আলোচনা করা হয়। শেখা হয় অপাঠ্য অনেক কিছু। জ্ঞান অর্জন ওর একটা নেশা। আমরা বা ক্লাসের টিচার সবাই ওকে ‘বই পোকা’ বলেই ডাকতাম। আর ক্লাসের কিছু মেয়ে ওকে ডাকত ‘টিউবলাইট’ বলে। রিফাত সেদিকে কর্ণপাত করত না।
রিফাতের অনুপস্থিতিতে কেমন খটকা লাগল মনে, কেন এল না? এর উত্তর পেতে হলে আমাকে আগামী রোববার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অত ধৈর্য আমার নেই, তাই ভাবছি আগামীকালই ওর বাসায় যাব।
সকাল নয়টা। আমি সোজা ঘুম থেকে উঠে চলে যাই ওর বাসায়। রিফাত ব্যালকনিতে রাখা কাঠের চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছে। পরনে নীল শার্ট, পাঞ্জাবি আর সাদা ধুতি। আর হাতে পুরোনো একটা ডায়েরি। ডায়েরিটা পুরোনো হলেও দূর থেকে দেখতে বেশ লাগছিল। বোঝা যাচ্ছিল নিয়মিত সে এটাকে যত্ন করে রাখে। আমাকে দেখেই সে বলে উঠল,
‘কি তারু, ঘুম থেকে উঠে খুব তাড়াহুড়ো করে চলে এলি? তা–ও এত সাকালে? খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছে!’
ওর কথা শুনে অবাক হয়ে যাই! উত্তেজিত আর সদ্য ঘুম ভাঙা চেহারা সহজেই বোঝার কথা বাট তাড়াহুড়ো করে আসার খবর ওকে কে দিল?
-এই তাড়াহুড়ো করে আসছি তোকে কে বলল?
-সহজ, তোর শার্টের নিচের বোতামটা লাগানো নেই। তোর মতো একটা ছেলে শার্টের বোতাম খুলে আসাটা রীতিমতো অকল্পনীয়। তাই বোঝাই যায় তুই কিছু জানার জন্য অনেক আগ্রহী, যা তোর মনে অস্থিরতার সৃষ্টি করেছে। am i right?
(ওর কথা শুনে পুরা ‘থ’ হয়ে গেলাম, ছেলেটা মেধাবী সঙ্গে ভালো বুদ্ধিমানও বটে)
শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বললাম, পড়াশোনার পাশাপাশি ‘Detective’ও বনে যাচ্ছিস দিন দিন।
- এগুলো common subject, যা বুঝতে detective হওয়ার প্রয়োজন হয় না
(বলে সে হাসতে লাগল)
তো বল, কী জানতে চাস?
- তুই গতকাল ক্লাসে যাসনি কেন?
-এমনিই। আর ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ আমি কখনো ক্লাসে attended করি না।
-মানে?
-তোর সঙ্গে আমার পরিচয় আজ প্রায় দুই বছর।
-হুম, তো?
-গত বছর ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ বুধবার ছিল। তখন আমাদের সেমিস্টার চলছিল। অবশ্য বুধবারে পরীক্ষা ছিল না, বন্ধ ছিল। আর পরীক্ষা থাকলেও আমি দিতাম না।
(এটা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম, যে ছেলে পড়াশোনা ছাড়া কিছু বোঝে না তার মুখে এসব)
- কিহ! কাছে আয় তো তোর জ্বর কত উঠছে, মেপে দেখি তো! ‘করোনা’ হয়নি তো আবার?
-আরে বাদ দে তো।
-না বল না...
-ওকে, বলছি। দাঁড়া, চা বানিয়ে নিয়ে আসি।
(ও চা বানাতে চলে যায়, আর আমি ওর ডায়েরিটা হাতে নিই)
খুলতেই যে পেজটা সামনে এল সেটার শিরোনামটা
‘বিশের বিষ’
(লোভনীয় আর বিষের রহস্য দেখে পড়া শুরু করলাম)
২০১৬ সাল।
ইংরেজি ফেব্রুয়ারি মাসের ২০ তারিখ, শনিবার।
শীতের বন্ধ চলছে, তবুও সানজিদার সঙ্গে দেখা করতে বাহির হতে হবে।
তাই তার প্রিয় নীল কালারের পাঞ্জাবি পরেই বের হই।
আজ সকালে আমি স্কুলের দিকে যাই। যেতেই সানজিদা বলল,
-দাঁড়াও।
(রাস্তার সবাই তাকিয়ে আছে)
-হুম।
-ভেতরে আসো।
(আমরা স্কুলের ভেতরে গেলাম)
-১৪ তারিখ কি দিয়েছিলে আমাকে?
-ইয়ে মানে আ আ আ
-আংটি কিনেছ কোথা থেকে?
-ব্যাংক ভাঙছি আর টিফিন খরচ সেভ করছি।
(সেদিন সানজিদা আমাকে কান টেনে দিয়ে বলেছিল, পাগল কোথাকার।)
-আর শোনো, আমাকে এখন আবার কুমিল্লা যেতে হবে। সময় বেশি নেই।
(বলে রাখা ভালো, সানজিদা ছুটিতে পরিবারের সঙ্গে কুমিল্লায় যায় মামার বাড়িতে, সেখান থেকে শুধু মিট করার জন্য মেয়েটা আবার ঢাকায় আসে আজ)।
-ওকে, lunch করে নিই আগে।
lunch করার পর ওকে আমি বাসস্ট্যান্ডে drop করে দিয়ে আসি।
বাসায় এসে ঘুম দিই। ঘুম ভাঙে রাত নয়টায় ফেসবুকে লগইন করতেই, সময় টিভির পেজে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বাস ও ট্রাকের মুখোমুখিতে ৭ জনের মৃত্যু।
আমি একটা স্যাড রি–অ্যাক্ট দিয়ে মুখ ধুতে চলে যাই।
সানজিদার সঙ্গে আজ আর কথা হবে না। দুটো কারণ:
১. ওর পরিবারের সবাই পাশে থাকে।
২. গ্রামে ওর বাংলালিংকের নেটওয়ার্ক থাকে না।
পরদিন বিকেল পর্যন্ত যখন কোনো text এল না তখন একটু কেমন কেমন লাগল। তাই ভাবলাম ওর বাসায় যাই। ওর বড় ভাই বাসায় ছিল আর উনি আমাদের relationship–এর কথা জানত। (যদিও সাত মাসের নতুন, বাট deep ছিল অনেক।)
বিকেল ৪টা।
বাসায় গিয়ে দেখি বাসা তালা (রোববার। অফিস তো সাপ্তাহিক ছুটি। ভাই কোথায়?)
এসব যখন ভাবছি তখনই পাশের পাশের ফ্ল্যাট থেকে একজন অপরিচিত ভদ্রমহিলা বের হলেন
-বাবা, কে তুমি?
-সাইফ ভাইয়া (সানজিদার বড় ভাই) কোথায়?
-ওহ! গতকাল ওর বোন সানজিদা রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়, তাই সে তো গতকাল রাতেই কুমিল্লায় চলে যায়।
তখন আমার পুরো শরীর কাঁপতে শুরু করে কয়েক মিনিটের মধ্যে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
চোখ খুলে দেখি মা পাশে বসে চোখের পানি ফেলছেন, কোনো কথা বলছেন না। মা জানতেন আমাদের কথা।
তখন আমি বলেছিলাম,
‘মা, ও তো আমার সাথে দেখা করতেই গতকাল....।’
এতটুকু বলতেই মা আমার মুখে চাপ দিয়ে ধরেন।
তখনই সাইফ ভাই বাসায় আসে। মা ভীত মুখে কিছু বলতে গিয়েও থমকে যান। আমি ভাবলাম, হয়তো ওয়ারেন্ট নিয়ে এসেছে আমার নামে। কিন্তু হলো উল্টোটা, ভাইয়া ক্লান্ত চেহারায় বলল,
‘যাকে এত ভালোবাসতা তাকে শেষ দেখাটা দেখবা না!’
তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিই, এই বিষ যখন বিষময় হলো, তখন আর আমি কোথাও যাব না, নিজের জন্য নয় সানজিদার জন্য হলেও।’
পড়তে পড়তে নিজের অজান্তেই কাঁদতে ছিলাম। বুঝেছি যখন ডায়েরির পাতায় আমার চোখের পানি পড়েছিল।
ততক্ষণে রিফাত আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, কী করছিস। আমি চোখ মুছতে মুছতে বললাম, না,
-কিছু না, আজ আমি আসি।
-ওমা ‘বিষের’ কাহিনি শুনবি না?
আমি ওর কথার উত্তর না দিয়ে সোজা বাসার দিকে হাঁটা শুরু করি।