রয়্যাল জর্ডানিয়ান এয়ারলাইনসে একদিন

রোমান থিয়েটার, আম্মান
রোমান থিয়েটার, আম্মান

কানাডার ছোট্ট এক শহর উইন্ডসর। এটি কানাডার সর্ব দক্ষিণের এক শহর। এক পাশে কানাডা, আর অন্য পাশে অ্যামেরিকার বিখ্যাত শহর ডেট্রয়েট। এই ছোট্ট শহরের ইউনিভার্সিটি অব উইন্ডসর থেকে ২০০১ সালে আন্ডারগ্রাড আর ২০০৩ সালে মাস্টার্স করেছিলাম।

ছোট শহরে বাস করার মধ্যে অনেক মজা আছে। নেই বিশ্রী রকমের ট্রাফিক জ্যাম। মানুষজন মোটামুটি সবাই সবাইকে চিনে। আসলে সেই কোন আমলে এই শহরের প্রেমে পড়েছি, সেই মোহ আর কখনো কাটেনি। এই শহরেই আমার জীবনের দীর্ঘ একটা সময় কেটেছে,এখানেই বিয়ে করেছি, সন্তানদের জন্মও এই শহরে।

বেশ কয়েক বছর আগে, পৃথিবী দেখার আশায় চাকরি নিয়েছি পৃথিবীর অন্য প্রান্তের এক দেশ কাতারে। কর্মক্ষেত্র যেহেতু কাতার, তাই বছরের উল্লেখযোগ্য একটা সময় কাতারে থাকতে হয়। পরিবার–পরিজন সবাই আবার কানাডায়। তাই বছরে তিন-চারবার কানাডায় যাওয়া হয়। মাঝখানে বাচ্চারাও গ্রীষ্মের ছুটিতে কাতারে চলে আসে, জম্পেশ এক সামার কাটিয়ে কানাডায় ফিরে যায়।

জানুয়ারি মাসে আমার ছোট মেয়েটির জন্মদিন। তার বয়স ১১, তার জন্মদিনে আমার উপস্থিতি মাস্ট। না হলে জীবন চলে যেতে পারে যেকোনো সময়ে।

যেহেতু বছরে আমাদের অনেকবার ভ্রমণ করা হয়, তাই প্লেন ভাড়া নিয়ে গবেষণা করা আমার এক রকমের নেশা। উইন্ডসরে একটি ছোট বিমানবন্দর আছে, কাতার হতে ওখানে পৌঁছাতে ভাড়া বেশি পড়ে যায়। তাই আমরা অনেকেই আমেরিকার ডেট্রয়েট বিমানবন্দরটি ব্যবহার করে থাকি। ভাড়াও বেশ কম পড়ে। রেগুলার ভাড়া দোহা-ডেট্রয়েট-দোহা ১১০০-১২২০ ইউএস ডলার। জানুয়ারি মাসে মেয়ের জন্মদিনে যাওয়ার জন্য নানা ওয়েবসাইটে ভাড়া নিয়ে রিসার্চ করছিলাম। হঠাৎ দেখলাম আমি যদি রয়্যাল জর্ডানিয়ান এয়ারলাইনসে যাতায়াত করি, ভাড়া পড়বে মাত্র ৬৫০ ইউএস ডলার। নগদে টিকিট কেটে ফেললাম।

টিকিট কাটার পর দুশ্চিন্তা শুরু হলো—কোন মডেলের কী প্লেনে যাব, খাবার দেবে তো—এসব নিয়ে। দেখলাম দোহা–আম্মানে যাবে বোয়িং ৭৮৭ মডেলের এক প্লেন, যা এককথায় নতুন। তারপর আম্মান-মন্ট্রিয়াল-ডেট্রয়েটও যাবে বোয়িং ৭৮৭। আমার পারসোনাল পছন্দ বোয়িং ৭৭৭ অথবা এয়ারবাস ৩৮০। কিন্তু অর্ধেক ভাড়ায় গন্তব্যে পৌঁছাতে পারব, তাই মন থেকে ৭৭৭ অথবা ৩৮০–এর চিন্তা বাদ দিয়ে দিলাম।

যেহেতু এবারই প্রথম রয়্যাল জর্ডানিয়ান এয়ারলাইনসে ভ্রমণ করব, তাই সাবধানতাবশত একটা কলা, এক প্যাকেট বিস্কুট আর একটা আপেল সঙ্গে নিয়ে নিলাম, যদি পথে ক্ষুধা লাগে! কিন্তু সুপরিসর একটি ঝকঝকে প্লেন দেখে সঙ্গে সঙ্গেই সব টেনশন উবে গেল।

প্লেন প্রথমে যাবে দোহা হতে আম্মান, দুই–তিন ঘণ্টার যাত্রা। আম্মানে কয়েক ঘণ্টা বিরতি, তারপর আম্মান থেকে কানাডার মন্ট্রিয়াল। ওখানে ঘণ্টাখানেক টেকনিক্যাল বিরতি। এরপরে একই প্লেন যাবে মিশিগানের ডেট্রয়েটে।

আম্মানে পৌঁছালাম। বিশাল ইমিগ্রেশন লাইন। আমেরিকাগামী প্লেনে উঠলাম। প্রথমেই নজরেই পড়ল অনেক যাত্রীর মাথায় কালো টুপি/ হ্যাট। একটু পরে বুঝলাম আম্মান থেকে ইসরায়েল একেবারেই কাছে। এ কারণে অনেক ইসরায়েলি যাত্রীরা এই এয়ারপোর্টের মাধ্যমে অনেক জায়গায় যাতায়াত করে থাকেন। আম্মান থেকে ইসরায়েলের নানা শহরে শাটল (বাস) সার্ভিস আছে, ভাড়াও মাত্র ৬০ থেকে ৭০ ডলার। আমার অনেক বন্ধু এভাবে জর্ডান হয়ে ইসরায়েল/প্যালেস্টাইনে ভ্রমণ করেছে। ভাবলাম ভবিষ্যতে সাহস করে একবার ইসরায়েল-প্যালেস্টাইনও ভ্রমণ করব।

১২ থেকে ১৩ ঘণ্টার আম্মান-ডেট্রয়েটের যাত্রা শুরু করলাম। এয়ারপোর্টে তেমন ভালো কিছু খেতে পারিনি সময়ের অভাবে। প্লেনে দেওয়া নিজের খাবারটুকু খেয়ে অভ্যাসবশত একটু এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলাম। পাশের খালামণির (জর্ডানিয়ান) প্লেটের দিকে মনে হয় একটু বেশিক্ষণই তাকিয়ে ছিলাম।

খালামণি তাঁর অর্ধ খাওয়া চিকেন দেখিয়ে বললেন, ‘খাবে নাকি?’

পেটে ক্ষিধা থাকলে কারও পাতেরটা খেতে আমার দ্বিধা থাকে না। আমি বললাম, ‘আপনি দিলে আমি মানা করি কীভাবে?’

তিনি দু–টুকরো চিকেন আর এক টুকরো আলু আমার পাতে তুলে দিলেন।

খাওয়ার প্রতি আমার আগ্রহ দেখে তিনি তাঁর অর্ধ খাওয়া রুটি, আর এক চামচ কেকও সাধলেন। লোকলজ্জার ভয়ে মানা করে দিলাম।

আম্মান সিটাডেল
আম্মান সিটাডেল

খালামণি এবার আশপাশে দেখতে লাগলেন আর কারও প্লেটে অর্ধ খাওয়া চিকেন–টিকেন কিছু আছে কি না! এবার তিনি সাহস করে তাঁর স্বামী ভদ্রলোকটিকে আমাকে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘হ্যাঁ গো, তুমি চিকেনটা কি আর খাবে?’

খালুজান তাঁর পানীয়টিতে একটি দীর্ঘ চুমুক দিয়ে মোটামুটি হুংকার দিয়ে বললেন, ‘আরে খাওয়াটা তো এখনো শুরুই করলাম না!’

খালামণির অসহায় অবস্থা দেখে আমি মনে মনে বললাম, ‘নেক্সট টাইম, খালামণি!’

খালামণির চিকেন খেয়ে, রয়্যাল জর্ডানিয়ানের অসাধারণ আতিথেয়তা আর নেটফ্লিক্সে মুভি দেখতে দেখতে ফাইনালি এসে পৌঁছালাম ডেট্রয়েটে। প্লেন থেকে নামলাম। তাপমাত্রা মাত্র -১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। যাত্রার শুরুতে কাতারে ছিল ১৮ থেকে ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। ভাবলাম কোথায় এসে পড়লামরে বাবা! মাথার ভেতর হতে কেউ বলল, ‘ভাবাভাবি পরে করো, আগে ১০ কেজির একটা জ্যাকেটের ওজন সামলাও! গুড লাক।’


*লেখক: সফটওয়্যার প্রকৌশলী