মা, সব বাবা হঠাৎ কোথায় যায়

যখন দেশ ছেড়েছি বুঝিনি সম্পর্কের আভিধানিক, বুঝিনি বাবা শব্দটির অনুভূতি কেমন শক্তিমান হতে পারে। আব্বাকে অতি বিরক্ত করে দেশ ছেড়েছি। আব্বা ছিলেন নীতিমান মানুষের উদাহরণ কিংবা তার চেয়েও বেশি কিছু সন্তানের কাছে।

বারান্দায় একটি চেয়ার ছিল ঠিক প্রধান ফটকের সম্মুখে। বসে থাকতেন ছোট একটি শিশুর মতন যাও অনিচ্ছাকৃতভাবে নজর পড়লে। কখনো আড্ডায় যেতেন না, শুধু সময় করে মসজিদে যেতেন। সকালে ঘুম ভাঙত বারান্দায় আব্বা কোরআন তিলাওয়াত করছেন তা শুনে। বাহারি ফলদ গাছ যেগুলো লাগিয়েছেন তার পরিচর্চায় ব্যস্ত হতে পড়তেন কোরআন শরিফ পড়ার পর। কোথাও যদি ঘুরতে যেতেন হয়তো সর্বোচ্চ নিজের পৈতৃক ভিটামাটিতে বিচরণ করতে যেতেন, এ ছাড়া আব্বাকে কখনই আড্ডায় দেখিনি। কোথাও ঘুরতে যেতে বললে বলতেন আমি সারা দেশ দেখেছি আর কী দেখব?

ওনার সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় ছিল তিনি আপনি দিয়ে সবাইকে সম্বোধন করতেন। পেশায় বাবা ছিলেন জেলার অতিরিক্ত বন পরিচালক। বদলি আর একই পোস্ট নিয়েই চাকরি থেকে অবসরে এসেছেন। অবসরে যোগ দিয়েছেন তাবলিগে। আমির ছিলেন তিনি।

খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব তৈরি করেছিলেন নিজের সঙ্গে নিজেকে বুঝে–শুনে। মা–বাবা ছাড়াই একা একা মানুষ হয়েছেন বড় বাবার কাছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে সার্ভিস দিয়েছিলেন ৩৩ বছর নিষ্ঠার সঙ্গে। চাইলেই কোটি টাকার গাড়ি দৌড়ানো কোনো ব্যাপারই ছিল না। কিন্তু ভদ্রলোকের জুতা খোদার বারো মাস ১৪ সেলাই করা থাকত।

এই মানুষটি থাকতেন বদলির ওপর। পাহাড় ও ভূমিখেকো মন্ত্রী–এমপিদের বিরুদ্ধে বাদী হয়ে মামলা ঠুকে দিতেন সরকারের পক্ষ থেকে। বিনিময়ে চাকরিচ্যুত ছিলেন ৯ বছর, এর সঙ্গে বদলি। ঢাকা জেলা ছাড়া সব বিভাগেই চাকরির পোস্টিং হয়েছিল আব্বার।

স্কুলে পড়ার সময়ে সাদা রঙের জুব্বা পরতেন আব্বা, ওই জুব্বার পকেটই ছিল আমার বাংলাদেশ ব্যাংক। পকেটে টাকা যা থাকত সব আমিই নিয়ে চলে যেতাম, কিছুই বলত না। কারণ বাবা ধূমপান তো দূরে থাক এক কাপ চাও খেতেন না। শুধু বলতেন, তুই আকাশ ছুঁয়ে যাবি কিন্তু তোর না শোনার আগ্রহতা তোকে দূরে ছিটকে ফেলে দেবে। তখন মন খারাপ হতো আর বলতাম; আপনি আমাকেই কেন বলেন আব্বা? তিনি হেসে বলতেন কারণ, তুমিই আমার সন্তান। বাবা হলে ইউ উইল রিমেম্বার যে আব্বা কী উত্তর দিয়েছিল।

এখন সাফল্য ধরতে গিয়ে প্রতি কদমে কদমে বুঝতে পারি উনি আমাকে কিসের কথা বলতেন। আমার সব কথা সব আবদার, সব উত্তর, সব গল্পই পড়ে গেছে ধূম্রজালের মতো হঠাৎ করে। সুযোগ হয়নি একটিও। কারণ, আমি যখন বুঝতে শিখেছি, যখন জেনেছি বাবা নামক বিশালতা। আমার যখন ভেতর থেকে আব্বার সঙ্গে কথা বলা দরকার বা কী বলতে হবে; যখন জেনেছি তখনই তিনি মানসিক পঙ্গুত্ব বরণ করেছিলেন। বারবার আব্বা-আব্বা বলে ডাকলেও তখন বাবা উত্তর করতে পারতেন না। হাজারবার ডাকলেও মুঠোফোনের ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। তিনি কথা বলতেন পারেন না কারণ তিনি স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন, হারিয়ে ফেলেছিলেন কথা বলার শক্তি। একজন সন্তানের কাছে এর চেয়ে হৃদয়বিদারক কী হতে পারে। আপনি আব্বা আব্বা বলে ডেকে যাচ্ছেন তিনি তাকিয়ে আছেন আর কিছু একটা বলতে চাইছেন, কিন্তু পারছেন না। মা পাশেই বসে শিশুর মতো শিখিয়ে দেন, এটি আপনার ছোট ছেলে।

শেষ কথা হয়েছিল ২০১৩ সালের মাঝামাঝি। আমাকে বলেন বাবা আমি অনেক খুশি তুমিও বড় হয়ে গিয়েছ, আজ হয়তো আমি সাফল্যমণ্ডিত বাবাদের তালিকায়, বলেই কেঁদে দিয়েছিলেন। কিন্তু আফসোস আমিও আমার সাফল্যের গল্প তাকে বলতে পারিনি। আমি যখন আমার সহপাঠী বা বন্ধুদের দেখি তখন ভেতরে কেমন যেন মনে হয় শুধু আকাশ পানে তাকিয়ে বলি সব সৃষ্টির মতন হয়তো আমিও সীমাবদ্ধ। অনেক খুঁজি কথা বলার জন্য, থাকলে হয়তো চলার পথটি আরও সুন্দর হতো। হয়তো পাশে বসেই বাবার কাছ থেকে জীবনের জন্য কিছু শিক্ষণীয় অভ্যাস ও নেতৃত্ব দিয়ে নেতা হওয়ার নীতি শিখতাম। কারণ, বাবার দেওয়া শিক্ষা আর সত্যিকারের নেতা শুধু বাবাই হতে পারেন। বাবাকে কিছু না হোক এটি তো অন্তত বলতে পারতাম, আব্বা আপনার এই দুষ্ট ছেলের সব আছে এখন আপনি শুধু আমাকে একবার বলেন আমি আপনার সামনে এনে রাখব দুনিয়া। জুতো সেলাই তো দূরে থাক আমি ভেলেনতিনোর গোল্ডেন সুজ কিনে দেব আব্বা। শুধু একবার বলেন, শুধু উচ্ছলতা দেখতাম শুনে বাবা কী বলে?

এমন হাজারো ভাবনার দলে বসে থাকা প্রশ্নের দল আছে যাহ নিজের ভেতরেই আবর্তন করে আব্বা। এখানে দিতে পারিনি। বিশাল এক লিস্ট তোমাকে বলার। আমি গন্তব্যতে বিশ্বাস করি। এখানে দেখা হয়নি তবে দেখা তো হবেই ওপারের ময়দানে আব্বা। আমি চাই যেদিন ডাক আসবে সেদিন আমার মনে উৎসব লাগবে। কারণ, পিতা-পুত্রের দেখা হয়েছে। কোনো পুত্রই একা হয়ে যেন মাকে প্রশ্ন না করে । মা, কিছু বাবা হঠাৎ কোথায় চলে যায়?