আতঙ্কের এক রাত

একটি স্থাপনাকে অগ্নিঝুঁকিমুক্ত করে মানুষের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিল্ডিং কোড অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই
একটি স্থাপনাকে অগ্নিঝুঁকিমুক্ত করে মানুষের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিল্ডিং কোড অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই

রাতে (১৪ জুলাই) ড্রয়িং রুমে ঘুমিয়েছি। রাত দুটো বাজে, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। জাগতিক পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্নপ্রায়। চারপাশে কী হচ্ছে, কিছুই আমার ইন্দ্রিয়ে ধরা পড়ছে না। পাশের রুম থেকে আমার স্ত্রীর মৃদু কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। ওঠো ওঠো…।

হঠাৎ তার হাতের ধাক্কায় ঘুম ভেঙে উঠে বসলাম।
বললাম, কী হয়েছে?
বাইরে থেকে কেউ কলবেল টিপছে শুনতে পাচ্ছ না?
উত্তরে বললাম, শুনিনি তো ।
এবার ঘন ঘন কয়েকবার কলবেলের আওয়াজ হলো।
সে বলল, দরজায় গিয়ে দেখো কে সুইচ টিপছে?
এত রাতে কলবেল, একটু ভয় কাজ করছে ভেতরে। কে টিপছে কলবেল এবং কেন টিপছে?

চোখ মুছতে মুছতে দরজার কাছে দাঁড়াতে আবারও বেজে উঠল। দ্বিধা, সংকোচ ও ভয় নিয়ে দরজা খুলতেই দেখি চেনা মুখের এক তরুণ, উদ্‌ভ্রান্তের মতো বলছে, ‘ফু ফু, ছোরতে দো ভোতর আপারতোম।’ অর্থাৎ আগুন আগুন, আপনারা অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে যান। আগুনে পোড়া গন্ধ নাকে ভেসে আসছে। ছেলেটি অন্য একটি অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে কলবেলের সুইচ টিপতে লাগল। আমি কী করব ভেবে পাচ্ছি না।

আমার স্ত্রীকে বললাম, ভবনে আগুন লেগেছে, দ্রুত বেরিয়ে যেতে হবে। ঘুমের পোশাক পরেই শুধু মুঠোফোন ও অ্যাপার্টমেন্টের চাবি পকেটে নিয়ে বের হতে উদ্যত হলাম। মেয়েকে ঘুম থেকে দ্রুত জাগানো হলো। আমার স্ত্রী তার প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের ব্যাগ সঙ্গে নিয়েই বের হলো। কিন্তু আমার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেওয়ার কথা মাথায় এল না। সম্পদের চেয়ে সময় ও জীবনের গুরুত্বকে প্রাধান্য দিয়ে দ্রুত দরজায় তালা মেরে ওদের নিয়ে বিল্ডিংয়ের দরজার কাছে চলে গেলাম। আমাদের ফ্লোরের অন্য প্রতিবেশীরাও বারান্দায় বেরিয়ে এসেছেন। প্রতিটি তলায় পুলিশ ও দুই আফ্রিকান বংশোদ্ভূত যুবক দরজায় দরজায় গিয়ে মানুষকে ঘুম ভাঙিয়ে বাইরে বের করে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা যখন সিঁড়ি বেয়ে নামছি, তখন অন্যান্য অ্যাপার্টমেন্টের পরিবারগুলো তাদের শিশু–বাচ্চাদের বিছানার কম্বল জড়িয়ে তড়িঘড়ি করে নামার চেষ্টা করছে। পোড়া গন্ধ আরও প্রকট হয়ে নাকে লাগায় নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। সিঁড়ির দরজায় পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ংকর এক আতঙ্কের মধ্য দিয়ে আমরা বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। গতকাল (১৩ জুলাই) বিকেল থেকে আমাদের এলাকায় অসংখ্য পুলিশ সশস্ত্র অবস্থায় পাহারারত। ১৪ জুলাই ফ্রান্সের জাতীয় দিবস, এই দিন রাতে সাধারণত এলাকার তরুণেরা ককটেল ফাটিয়ে আনন্দ উল্লাস করে থাকে। এই উন্মাদনার কারণে অনেক সময় নানা অঘটন ঘটে থাকে। তাই পুলিশ প্রশাসন বিভিন্ন এলাকা অতিরিক্ত নজরদারির মধ্যে রাখে।

রাস্তায় এই গভীর রাতে অসংখ্য মানুষের ভিড় জমে গেছে। পুলিশ বিক্ষিপ্ত লোকজনকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে। ভবনের দ্বিতীয় তলায় রাস্তার ধারের অ্যাপার্টমেন্টে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আগুনের লেলিহান শিখা ক্রমেই বেড়ে চলছে। তখন ফায়ার সার্ভিস এসে পৌঁছেনি। অ্যাপার্টমেন্টটিতে একটি পরিবারের বসবাস। অ্যাপার্টমেন্টের কলবেল টিপে ভেতরে অবস্থানরত কাউকে জাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তাই আফ্রিকান এক যুবক বিল্ডিংয়ের কার্নিশ বেয়ে চলে গেল অ্যাপার্টমেন্টটের বারান্দায়। তার সন্নিকটে জ্বলছে আগুন। কিন্তু সে সাহসিকতার সঙ্গে একটি লোহার রড দিয়ে দেয়ালের কাচ ভেঙে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করল। বাইরে থেকে ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে সন্ধান করল, ভেতরে কেউ আছে কি না। কিন্তু কারও সাড়া না মেলায় ছেলেটি নিচে নেমে এল। আমরা যখন নিজের জীবন রক্ষায় ব্যস্ত, তখন যুবকটি অন্যের জীবন রক্ষার চিন্তায় নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেভাবে আগুনের সামনে এগিয়ে গেল; তখন মনে হলো পৃথিবীতে মানুষ কত মহান ও মানবিক হতে পারে। সৃষ্টিকর্তা মনে হয় কিছু মানুষকে বিশেষ অনুভূতি দিয়ে পৃথিবীতে পাঠায়। যারা অন্যের বিপদ দেখলে নিজের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে এগিয়ে যায়।

আগুন। প্রতীকী ছবি
আগুন। প্রতীকী ছবি

পাঁচ মিনিট পর ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি চলে এল। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা দ্রুত আগুন নেভানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। হালকা পোশাক পরে বাইরে চলে এসেছি, ঠান্ডায় শরীর কাঁপছে। বিল্ডিংয়ের লোকজন রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নিয়েছে। সবাই আগুন নিয়ন্ত্রণের প্রতীক্ষায় উৎকণ্ঠিত সময় পার করছে। দ্বিতীয় তলায় আগুন লাগায় ফায়ার সার্ভিস দলের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে খুব বেশি কসরত করতে হলো না। ১৫ মিনিটের প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এল। কিন্তু অন্য তলায় আগুন ছড়িয়ে পড়েছে কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য আমাদের কাছ থেকে চাবি সংগ্রহ করে ফায়ার ব্রিগেডের সদস্যরা বিভিন্ন তলায় চলে গেল। সেই সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে আগুন নেভানোর কার্যক্রম চলতে লাগল। সম্পূর্ণভাবে নেভানোর কাজ শেষ হতে প্রায় ভোররাত চারটা বেজে গেল। কিন্তু কারও বিল্ডিংয়ের ভেতর প্রবেশের অনুমোদন মিলছে না। ফায়ার সার্ভিসের যাবতীয় পরীক্ষা–নিরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ভোর পাঁচটায় বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করলাম।

একটি আতঙ্কের রাত পাড়ি দিতে হলো। টিভি পর্দায় শুধু পোশাক কারখানা ও ভবনে আগুন লাগার দৃশ্য দেখেছি। কিন্তু ১৪ জুলাই রাতে বাস্তবতার সম্মুখীন হলাম। যে আফ্রিকান বংশোদ্ভূত তরুণকে রাস্তার মোড়ে আরব বখাটে ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখি, সেই তরুণই আমাদের মধ্যরাতের ঘুম ভাঙিয়ে জাগিয়ে তুলেছিল । অসংখ্য ধন্যবাদ ভাই তোমাকে...।

ধারণা করা হচ্ছে, রাস্তা থেকে উচ্ছৃঙ্খল যুবকদের ছোড়া ককটেল ফুটে এ আগুনের সূত্রপাত। যে অ্যাপার্টমেন্ট পুড়ে ছাই হয়েছে, ওই ফ্ল্যাটের পরিবার গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনে বাইরে রয়েছে। একটি বাসায় একটি পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র, আসবাস ও দীর্ঘদিনের সংগৃহীত শৌখিন জিনিসপত্র থাকে। নিজেদের রুচি অনুযায়ী সাজানো হয় নিজ বাসস্থল। যদিও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটি ইনস্যুরেন্স কোম্পানির ক্ষতিপূরণ পাবে। কিন্তু তাদের শখের সাজানো বাসাটি আগের মতো করে পাবে না। দেয়ালে টাঙানো শখের পেইন্টিং ও সংগৃহীত স্যুভেনিরগুলো পাবে না। যখন পরিবারটি ফিরে এসে দেখবে রেখে যাওয়া সাজানো–গোছানো নীড়টি ছাই হয়ে বাতাসে ওড়াউড়ি করছে, তখন কী কষ্টটাই বুকের মধ্যে জমাট বাঁধবে...।