একটা ফুলবাগানের গল্প

আসুন শিশুদের প্রতি মানবিক হই। ছবি: লেখক
আসুন শিশুদের প্রতি মানবিক হই। ছবি: লেখক

একটা গল্প বলি, এটা অবশ্য আমার গল্প নয়। তবে এই গল্প আমাদের জানা উচিত। আপনার, আমার—সবার জানা উচিত।

এক.
চার বছরের বাচ্চা একটা ছেলে প্লেগ্রাউন্ডে দাঁড়িয়ে আছে। শিশুরা এমনিতেই ফুলের মতো। এদের ফুলবাগানে ছেড়ে দিলে ফুলের সৌন্দর্য পর্যন্ত ম্লান হয়ে যায়। তার ওপর এই ছেলে দেখতে হলো রাজপুত্রের মতো। আমি নিজে দেখেছি তাকে। সে কোনো প্লেগ্রাউন্ডে দাঁড়ালেও কংক্রিটের প্লেগ্রাউন্ড আর লোহার শেকলে বাঁধা দোলনাটা রঙিন হয়ে যায়।

প্লেগ্রাউন্ডে বাচ্চারা খেলবে, দৌড়াদৌড়ি করবে। দূর থেকে তাদের দেখলে মনে হবে তারা কী করছে, সেটা তারা নিজেরাই জানে না। কিন্তু এই ছেলে দাঁড়িয়ে আছে কেন? ঘটনা কী?

ঘটনা খুবই সামান্য। ছেলেটা অটিস্টিক। আমলে আনার মতো কোনো বিষয় নয়। সে এখনো বাগানের ফুলই আছে, আগাছা হয়ে যায়নি।

চিন্তার বিষয় হলো হলো, প্লেগ্রাউন্ডে সে ট্যাগ অ্যান্ড রান, মানে ‘ছোঁয়াটুয়ি’ খেলার মতো আদিম ও অকৃত্রিম শিশুদের খেলাটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। তবে কেউ বুঝিয়ে দিলেই সে বুঝে ফেলবে। এটা যেহেতু অ্যাস্ট্রোনমিক সায়েন্স নয়, অতএব, শিখতেও সময় লাগার কথা নয়।

কিন্তু কেউ তাকে বোঝাচ্ছে না। সে খুব চাচ্ছে তাকে কেউ একবার বলুক এই খেলার নিয়মটা কী? তার হাত ধরে কেউ তাকে দেখিয়ে দিক কীভাবে দৌড়টা শুরু করতে হয় আর কোথায় গিয়ে থামতে হয়।

সে গভীর চিন্তায় মগ্ন...হঠাৎ আরেকটা, তার বয়সী শিশু চিৎকার করে বলল, ‘এই, তুই কি ইডিয়ট? ট্যাগ অ্যান্ড রান কী, তাও জানস না?’

আমাদের রাজপুত্রের চিন্তার গাড়িটা থেমে যায়, সে এখন ভাবছে ‘ইডিয়ট’ শব্দটি নিয়ে। ‘ইডিয়ট’ শব্দটি তার কাছে ‘ট্যাগ অ্যান্ড রান’-এর চেয়ে বেশি কঠিন মনে হচ্ছে।

সে তার মাকে খুঁজছে। এসব কঠিন শব্দের অর্থ তার মা-ই ভালো করে বোঝাতে পারেন।

তার আর এখন ট্যাগ অ্যান্ড রান খেলতে ইচ্ছা করছে না। চিৎকার করে কাউকে ‘ইডিয়ট’ বলতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু মানে জানে না, এই শব্দ বলাটা কি ঠিক হবে?

তার মা তাকে সব সময় বলেন, ‘বাবা, অলওয়েজ লার্ন বিফোর ইউ স্পিক...।’

দুই
দূরে এই ফুলগাছের মালিক দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা অবশ্য তাকে ‘মা’ বলে ডাকি কিন্তু মানুষটা আজীবন তার একমাত্র ফুলের যত্ন ছাড়া আর বিশেষ কিছুতে মনোযোগ দেননি।

তিনি জানেন তার ফুল দুর্বল, তিনি জানেন তার ফুল এই ফুলবাগানে সবচেয়ে স্পেশাল। তবু তিনি চান তার রাজপুত্র শক্ত হয়ে দাঁড়াক, প্রচণ্ড বাতাসে তাকে যেন নুয়ে পড়তে না হয়। কেউ যেন তার ফুলের মতো এই ছেলেকে ভবিষ্যতে পা মাড়িয়ে চলে যেতে না পারে।

তিনিও আরও দশটা মায়ের মতো ঠিক একই প্রসবযন্ত্রণা, ভালোবাসা আর অপেক্ষা নিয়ে এই রাজপুত্রকে পৃথিবীতে এনেছেন। তিনিও চান তার রাজপুত্র ঘর ছেড়ে তেপান্তরের মাঠটি পার হোক। তাই তিনি মাঝেমধ্যেই দূরে দাঁড়িয়ে তার এই স্পেশাল ফুলকে বাতাসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে দেখেন।

হঠাৎ তিনি শুনতে পান সেই আরেক শিশুর চিৎকার, ‘ইডিয়ট’

‘ই-ডি-ও-ট’

তিনি দৌড়ে যেতে চান, কিন্তু তার পা ভেঙে আসে...দৌড়ানোর সময় তার চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে, গলার ভেতর দলা পাকানো কান্নাটাকে তিনি টুপ করে গিলে ফেলেন।

আচ্ছা, একটা প্রিয় ফুল কিংবা গাছকে পা দিয়ে দলিত-মথিত করলে কী হয়, জানেন?

সেই ফুলের বিশেষ কিছু হয় না। সে বিবর্ণ হয়, তারপর দ্রুত মারা যায়। সে যে বিবর্ণ হয়, সেটা সে নিজেও জানে না।

কিন্তু ফুলের যত্ন নেওয়া সেই মায়ের কী হয়, জানেন?

তিনি বারবার ফুলটাকে আঁকড়ে ধরেন, তিনি খুব চান সব ঠিক হয়ে যাক। তার ফুলের ক্ষতস্থান মুছে যাক। তিনি পাগলের মতো মলম খোঁজেন। তিনি পান না...

একটা বিবর্ণ ফুলকে বুকের কাছে ধরে তার খুব কান্না পায়...।

তিনি বারবার চোখ মুছতে পারেন না। তাই তার চারপাশটা অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি তখন আর কিছু দেখতে পান না। তার অসহায় লাগে। অনেক অসহায়। তবু তিনি আরও একবার আশা নিয়ে উঠে দাঁড়ান। একদিন নিশ্চয়ই সবাই বুঝবে যে বাগানের স্পেশাল ফুলকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতে হয়।

তিন
ওপরের এই গল্প আমার বান্ধবী আর তার ছেলের জীবনের ছোট্ট একটি গল্প। এমন গল্প তাদের জীবনে অসংখ্য আছে। তাই তাদের গল্প থাকুক, বরং আমাদের গল্প বলি।

আপনার, আমার গল্প। আমরা, যাদের সন্তান অটিস্টিক নয়, তাদের গল্প।

আমরা কি আমাদের সন্তানকে শেখাই যে বাগানের সব ফুলকে ভালোবাসতে হয়? কাউকে কটাক্ষ করে কথা তো দূরের কথা, কারও সঙ্গে চিৎকার করে কথা বলাটাও একটা চরম ভুল আচরণ? আমরা কি তাদের জিজ্ঞেস করি, এই, বলো তো কাইন্ডনেস কী?

দয়া দেখানো? নাহ্‌...।

কাইন্ডনেস মানে দয়ালু থাকা, সবার সঙ্গে, সর্বাবস্থায়।

লেখক
লেখক

যে অটিস্টিক কিংবা অটিস্টিক নয়, যার ডিসলেক্সিয়া আছে অথবা নেই, যার এডিএইচডি হয়েছে কিংবা হয়নি। সবার প্রতি নির্বিশেষে সহনশীল আর সহানুভূতিশীল থাকা।

মেয়েকে আর্ট ক্লাসে পাঠাই এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটির জন্য, অথচ একবারও কি বলি, ‘মা গো, মানুষের মনের ক্যানভাস হলো সবচেয়ে বড় ক্যানভাস, এখানে রংতুলি দিয়ে যে ছবি আঁকবে, সেটাই তার মনে গেঁথে থাকবে, আর্ট যেমন-তেমন শেখো, কিন্তু ওই ক্যানভাসের ছবি যেন সব সময় সুন্দর হয়।’

ছেলেকে সকার কিংবা ক্রিকেট মাঠে নিয়ে যেতে যেতে কি পিঠ চাপড়ে বলি, ‘আরে ব্যাটা, মানুষ হতে গেলে সবার আগে মানুষকেই ভালোবাসতে হবে, বুঝলি, নো কম্প্রোমাইজ।’

নাহ্, আমার মতো এত ড্রামাটিক হওয়ার দরকার নেই, হতেও হবে না। আমি শুধু চাই আমরা সবাই আমাদের সন্তানদের সমতা বোঝাই, সততা বোঝাই, অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে উদ্বুদ্ধ করি।

‘আরে ধুর, পোলাপান এমনেই সব শিখব’—কথাটা ভুল। বাচ্চারা কলাগাছ নয় যে যত্ন ছাড়াই গাঁটি গাঁটি কলা দেবে আর আপনি সেগুলো খাবেন।

১০টা মিনিট তাদের সঙ্গে কথা বলুন, মানুষের প্রতি সদাচরণ কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটুকু বোঝান। প্রতিটা শিশু যেহেতু আলাদা, তাই তাদের বোঝার এবং বোঝানোর ভাষাও আলাদা। তাদের ভাষাতেই বোঝান।

হোমওয়ার্ক না করলে কোনো সমস্যা নেই কিন্তু স্কুলে সে কাউকে মারলে, বকলে, ঝগড়া করলে, কারও চেহারা, ড্রেস কিংবা অমুক খেলনা নেই, এই বিষয়গুলো নিয়ে হাসাহাসি অথবা কোনো কমেন্ট করলে তাকে ডিসিপ্লিন করেন। এই দায়িত্ব আপনার।

ওপরের গল্পটির মতো গল্পগুলো আসেন আমরা পাল্টে ফেলি। কাউকে মনে কষ্ট দিয়ে কথা বলাটা সামাজিক ও ধর্মীয় অপরাধ। শিশুরা অপরাধ করে না, এটা ভুল। তারাও অপরাধ করে, পাপ করে কিন্তু সেসব অপরাধ আর পাপের বোঝাটা মা-বাবার ওপর। এই বোঝাটা নেওয়ার সাহস করেন। এই বোঝাটা দূর করেন।


*লেখক: সাইকোলজিক্যাল ইনজুরি ম্যানেজমেন্ট কাউন্সিলর, অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল কোর্ট, ক্যানবেরা, অস্ট্রেলিয়া