করোনাকালের বিমানযাত্রা

ফাঁকা বিমানবন্দর।
ফাঁকা বিমানবন্দর।

নিকষ কালো অন্ধকার, সময় রাত ১টা বেজে ৪০ মিনিট। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। কিছুক্ষণের মধ্যে এমিরেটসের EK-585 বিমানটি পাখা মেলবে দুবাইয়ের উদ্দেশে। আর সেখান থেকে ট্রানজিট নিয়ে আমার গন্তব্য সুদূর নিউইয়র্ক।

বিমানের জানালার পাশে বসে ভাবছি পেছনে ফেলে রাখা আমার সবকিছু, এই বিমানের যাত্রা শুরু হলেই দেশ, মাটি, মা-বাবার সঙ্গে প্রতিটি ঘণ্টায় প্রায় শত শত কিলোমিটারের ব্যবধান হবে। এমন এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা, যে সময়ে চাইলেই হয়তোবা প্রিয়জনের দুঃসময়ে তার কাছে ছুটে এসে মাথায় হাত রাখা যাবে না, আবার সুসময়েও আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়া যাবে না।

মহামারি করোনার কঠিন এক সময়ে আমার এই বিমানযাত্রা। পেছনে ফেলে যাচ্ছি অসুস্থ বাবা আর করুণ চাহনিতে চোখ ছলছল করে দরজায় দাঁড়িয়ে বিদায় দেওয়া মাকে। মহাশূন্য যাত্রার মত শূন্যতা বিরাজ করছে আমার মনেও, বৈশাখের কালো মেঘের ছায়ার মতো মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছি আমি, না জানি কখন হঠাৎ ঝড় এসে সব এলোমেলো হয়ে যায়। বুকে ভেঙে যায় সবাইকে ছেড়ে যেতে, কিন্তু নিরুপায় আমি, জীবন ও জীবিকার তাগিদে দেশ ছাড়তে হবে।

সাদা রঙের মাস্ক আর পিপিই পরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যখন প্রবেশ করলাম, তখন ২৬ জুন রাত ৯টা বেজে ২০ মিনিট। এয়ারপোর্টে ঢোকার পরপরই মনে হলো সব জায়গায় বড় ধরনের পরিবর্তন, আগের মতো প্রাণের স্পন্দন নেই। প্রায় তিন মাস বন্ধ থাকার পর, জুন মাসে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পুনরায় শুরু হলো বাংলাদেশ থেকে। এই মহামারির মধ্যে একের পর এক ফ্লাইট বাতিল হয়ে যাওয়া, টিকিটের দাম আকাশছোঁয়া, টিকিট স্বল্পতা আরও কত অনিশ্চয়তা ও প্রতিকূলতা। সব অনিশ্চয়তা কাটিয়ে এমিরেটসের ২৭ জুনের টিকিট নিশ্চিত হলো। এয়ারপোর্ট এসে দেখলাম এমিরেটস ছাড়া সেদিনের সব ফ্লাইট বাতিল হয়ে গেছে। এয়ারপোর্টে ঢোকার পথে জীবাণুনাশক স্প্রে, মাস্ক/গ্লাভস, স্যানিটাইজার, থার্মাল স্ক্যানার সব মিলিয়ে এক ভুতুড়ে এবং ভয়ার্ত অবস্থা আবার নতুন অভিজ্ঞতাও।

এমিরেটসের কাউন্টারে যখন আমার শেষ গন্তব্য ইউএসের ঠিকানা জানতে চাইল, স্বামী, অবার্ন ইউনিভার্সিটি, আলাবামার কথা মনে পড়ল, আর কিছুই মনে আসছিল না। চেকিং শেষ করে, বোর্ডিং পাস নিয়ে যখন গেটে পৌঁছালাম, মাস্ক/গ্লাভস থাকা সত্ত্বেও অজানা আশঙ্কায় বুক দুরদুর করছিল। যখন এমিরেটসের সুপরিসর বিমানে চেপে বসলাম, তখন ঘড়ির কাঁটায় রাত ১২টা বেজে ৫০।

লেখক।
লেখক।

ঢাকা থেকে দুবাই আনুমানিক চার ঘণ্টার পথ। আকাশপথে করোনার সাবধানতা মেনে চলার জন্য বিমানে দুই যাত্রীর মাঝখানের সিট ফাঁকা রাখা হয়েছিল। বিমানের যাত্রীদের মধ্যে একধরনের চাপা ভয় কাজ করছে, সবাই চোখে রাজ্যের শঙ্কা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। যাত্রীদের আঁটোসাঁটো হয়ে চুপচাপ বসে থাকার মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে সবার মধ্যে একধরনের উৎকণ্ঠা। এমনিতেই যাত্রীদের তাঁদের নিজের সিটের বাইরে খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া কথা বলা বা ঘোরাফেরা না করার জন্য কেবিন ক্রুরা অনুরোধ করছেন। এর মধ্যেই আমার এক সিট পরে যে যাত্রী বসে ছিলেন, তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন কোথায় যাচ্ছি?

কথোপকথনের একপর্যায়ে জানতে পারলাম উনি শিকাগোর ফ্লাইট ধরবেন দুবাই থেকে। তাঁর পাশে থাকা এক বাংলাদেশি পরিবার প্রথমবারের মতো আমেরিকা যাচ্ছে। গ্রিনকার্ড পেয়ে বাংলাদেশের সবুজ শ্যামলের মায়া ছেড়ে আমেরিকায় স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। পরিবারের কিশোরী মেয়েটার চপলতা আমাকে মুগ্ধ করল। দুবাই এয়ারপোর্ট নামার পর সামাজিক দূরত্বের বাঁধ ভেঙে গেল। কিশোরী বয়সের মেয়েটা আমাকে বান্ধবী বানিয়ে ফেলল। দুজনে মিলে ম্যাকডোনাল্ডসে খেলাম। এক বছরের বেশি সময় চীনে ছিলাম, চীনে ম্যাকডোনাল্ডসে খেতে অনেক বাছবিচার করতে হতো। দুবাই এয়ারপোর্টে হালাল ঘোষণা থাকায় ম্যাকডোনাল্ডসে পেট পুরে খেলাম।

দুবাই এয়ারপোর্টের ফ্রি ওয়াইফাইয়ের সুবিধায় প্রিয়জনদের জানালাম এখন পর্যন্ত ভালো আছি। দুবাই বিমানবন্দর পৃথিবীর ব্যস্ততম বিমানবন্দরগুলোর একটি। কিন্তু বড়জোর দুটি–তিনটি ফ্লাইটের মানুষ দেখতে পেলাম, এয়ারপোর্টগুলোতেও আগের মতো প্রাণ নেই, একপ্রকার নিষ্প্রভ ও নিস্পন্দ অবস্থা। স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ৩০–এ চড়ে বসলাম নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টের উদ্দেশে। এবার প্রায় ১৪ ঘণ্টার দীর্ঘ ফ্লাইট, আঁটোসাঁটো হয়ে বসলাম। খাবারের বিপুল আয়োজন। কিন্তু দুঃসময়ে এবং বিমানের খাবারের এত আয়োজন বিস্বাদ লাগে। ঘুম ছিল না অনেকক্ষণ, খাবার শেষে এবার ঘুমানোর পালা। বেশ কয়েক ঘণ্টা ঘুমালাম।

ঘুম ভাঙতেই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নিউইয়র্কে পৌঁছে গেলাম। স্বামীকে জানিয়ে দিলাম পৌঁছে গেছি সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, আমার পাসপোর্টে চীনের সিল দেখে ইমিগ্রেশন অফিসার চোখ কপালে তুলল! চীনে মাস্টার্স করার সুবাদে ওখানে শেষ যাওয়া হয়েছিল এ বছরের জানুয়ারিতে। যাহোক, এবার যাত্রা শুরু আলাবামার দিকে। পরের গন্তব্য আটলান্টা হার্টস্ফিল্ড জ্যাকসন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট।