সাপ

স্ত্রী ছন্দা মারা গেছে। শোকাহত সোহাগ আজ ১৫ দিন গ্রামের বাড়িতেই আছে। ইউটেরাস ক্যানসার শেষ পর্যায়ে। যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। জীবনের শেষ সময়টুকু মা-বাবা, ভাই-বোনের কাছে থাকার ইচ্ছা করেছিল। তাই ছন্দা দেশে চলে আসে আজ থেকে চার মাস আগে। সোহাগ এসেছিলেন ছন্দার অন্তিম সময়ে।

ছোটবেলার বন্ধু অয়নকে নিয়ে সেদিন বিকেলে সোহাগ নদীর পাড়ে হাঁটছিল। নানান গল্পে মেতে হাঁটতে হাঁটতে দূরত্ব আর সময় কোনো কিছুরই খেয়াল নেই। তখন তারা শহরের প্রায় কাছাকাছি।

নদীর পাড়ে পৌর কবরস্থানের এক কোণে ছোট্ট একটি ঝোপ। কয়েকটা জোনাকির বিহার। ঠিক ঝোপটার কাছাকাছি এসে অয়ন থমকে দাঁড়ায়। বলে, ‘দোস্ত, হঠাৎ এখানে দাঁড়ালে যে!’

একদৃষ্টে ঝোপের দিকে চেয়ে অয়ন বলে, দোস্ত, তোমার কি তানিয়ার কথা মনে আছে?

হতভম্ভের মতো দু-একবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে অয়ন বলে, ‘হ। ভালো করেই মনে আছে। দোস্ত, তোমার ভাবি মারা গেছে। মনটা ভালো না। এখন থাক না ওসব কথা। কী আর হবে চৌদ্দ বছর আগের এসব কথা মনে করে।’
কিছুক্ষণ কী যেন ভেবে অয়ন বলে, ‘অন্য কিছু না। শুধু একটা বিষয় জানতে ইচ্ছে করে।’
লম্বা একটা নিশ্বাস ছেড়ে সোহাগ বলে, ‘আচ্ছা দোস্ত, বল।’

অয়ন দরিদ্র পরিবারের ছেলে। প্রতিষ্ঠানিক পড়ালেখা বলতে হাইস্কুলে ভর্তি হয়েই ইতি। সংসারের হাল ধরতে হয়। বাজারে বইয়ের একটি দোকান আছে। ছোট একটি পুকুরও আছে। আছে কিছু জমিজমা। এই তার জীবন। একসঙ্গে পড়ুয়া দুই বন্ধু। অনেক শখ্য তাদের। অবস্থানের দূরত্ব বেড়ে গেলেও বন্ধুত্বে বাড়েনি। কারণ একটাই, এই অয়ন খুব বই পড়ে। সিলেবাসের সুড়ঙ্গে আটকা সোহাগ তাই তার সঙ্গে ইচ্ছে করেই সময় কাটায়। অয়নের ঘরে অসুস্থ মা। ছোট তিনটা বোনের লেখাপড়া। পারিবারিক এসব দায়িত্বের ভারে জীবন তাকে খেয়ালের পথে দৌড়ানোর সুযোগ দেয়নি। সোহাগের বেলায় ঠিক উল্টো। পকেটভরা টাকা। তার বড় ভাই যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী। মা-বাবা কখনো যুক্তরাষ্ট্রে কখনো ঢাকায়। আজ এই মেয়ের বাসায় আবার কাল ওই মেয়ের বাসায়। কখনো-বা কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে থাকা। এভাবেই চলছে।

এইচএসসি পর্যন্ত সোহাগের পড়াশোনা চলে গ্রামের বাড়ি থেকেই। এত দিন অয়নের গল্প এবং বিভিন্ন তাত্ত্বিক বিষয়ের আলোচনা শুনেই মুগ্ধ হয়েছে সোহাগ। উচ্চমাধ্যমিক থেকে সোহাগের গল্পও মাঝেমধ্যে শুনতে হয় অয়নকে। পাশের গ্রামের মেয়ে তানিয়া সীমাহীন দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হলেও সে ছিল অসাধারণ রূপবতী। যে কারও চোখ একবার পড়লে ওই মুগ্ধতা নেশায় পরিণত হতো। ক্লাস এইট পর্যন্ত গ্রামের স্কুলে আসা-যাওয়া করতে পারলেও শেষ পর্যন্ত মা-মেয়েকে গ্রামই ছাড়তে হয়। দু-একটা সম্বন্ধ যে আসত না তা নয়। তবে রহস্যজনকভাবে ওই আসা পর্যন্তই শেষ।

তানিয়ার বাবা সলিম ছিলেন একজন সহজ-সরল মানুষ। অন্যদিকে মা নাজমা খুবই সুন্দরী। এত দারিদ্র্যের মধ্যে নাজমার স্মার্ট চলাফেরা সবার চোখে পড়ত। পাশাপাশি সন্দেহেরও জন্ম দিত। এ নিয়ে অবরুদ্ধ কামনায় চোখ-কান গরম হওয়া ছেলেরা গল্পের পর গল্প সাজিয়ে ছোট্ট ওই বাড়িটির দিকে চেয়ে থাকত। কালক্রমে নাজমাকে ঘিরে ওই সব টসটসে গল্প বাবার মুখ থেকে গড়ায় ছেলের মুখেÑনাজমা থেকে তানিয়ায়। মোড়ের দোকানে, শুকনো খালের তলায় তাসের আড্ডায়। কখনো ওই রাস্তার মাঝখানে ব্রিজটার নিচে ঝোপের ভেতরÑনানান গন্ধের ধোঁয়ার আড্ডায় মুখরোচক গল্পের এই নির্ঝঞ্ঝাট উত্তরাধিকার চলতেই থাকে।

গ্রাম্য মাতবরেরা যে কারণে অসহায় দরিদ্র নারীদের ওপর নাখোশ হন, মা-মেয়ের ওই দোষটা বরাবরই ছিল। তাই সহজ-সরল সলিম বেঁচে থাকতে কোনো রকমে দিন চললেও তার মৃত্যুর পর মা-মেয়ের ওপর থেকে অতি দুর্বল শেষ ছায়াটুকুও কালবৈশাখীর প্রচণ্ড বাতাসে উড়ন্ত একখণ্ড মেঘের মতো নিরুদ্দেশে মিলিয়ে যায়। এরপর নানা রকম নালিশ আর সালিসে পরিবেশটা দূষিত হয়ে পড়ে। অবশেষে রটিয়ে দেওয়া হয়, হারু মাতবরের কাছ থেকে সলিম টাকা ধার করেছিল। মা-মেয়ে এ ঋণের কথা কখনো শোনেনি। এই রটনায় তারা আকাশ থেকে পড়লেও উপায় নেই। সুদ-আসল মিলে টাকার যে পরিমাণ দাঁড়ায়, এই ছোট্ট বাড়িটা তিনবার বিক্রি করলেও ওই টাকা হবে না। এখন উপায় কী? হারুর সঙ্গে নীরব সময়ে একান্ত দেখা-সাক্ষাৎই একমাত্র উপায়। মাতবরের চোখের ইঙ্গিত ওই কথাই বলে। অবশেষে স্বামীর ভিটেটুকু ছেড়ে যাওয়া ছাড়া নাজমার আর কোনো পথও খোলা রইল না।

এরপর মাকে নিয়ে তানিয়া ছোট্ট একটা ছাপরা ভাড়া নিয়ে কলেজপাড়ায় চলে যায়। নাজমা বাসাবাড়িতে কাজ নেয়, আর তানিয়া বিকেলে একটা টিউশনি শুরু করে। তানিয়া এলাকা ছাড়লেও সোহাগ তাকে ছাড়তে পারেনি। প্রায়ই কলেজ থেকে ফিরে অয়নের সঙ্গে সোহাগের একান্ত ওই সব গল্প হতো। গল্পের সারাংশটা এমনÑদোস্ত, তানিয়ার সঙ্গে কারও তুলনা চলে না। একবার দেখা করলে ওই সপ্তাহজুড়ে বুকটা থাকে ঠান্ডা। মধুর ঘুম। পড়ালেখা, খেলাধুলা, নদীর পাড়ে ঘোরাঘুরি সব ভালো লাগে। দিগন্তের দিকে বুকটা টান করে আহা কী তৃপ্তির নিশ্বাস! ইচ্ছে করে হাজার বছর বেঁচে থাকি। এ কারণে কুলীন বংশের মেয়েদের আমি দেখতে পারি না। অহংকারী আভিজাত মেয়েরা নিজের প্রয়োজনে ছেলেদের ব্যবহার করে। প্রয়োজন শেষে চলে যায়। তোমার বুকের ভেতর যে অতৃপ্তির গোঙানি, তা শোনার সময় ওদের নেই। আর আমার তানিয়া? আমার দেখা পৃথিবীতে এটাই আমার স্বর্গ।

অয়নের ছোট তিনটি বোন আছে। তাই অসহায় একটা মেয়েকে নিয়ে এ রকম লাগামহীন বন্যতায় তার মন সায় দেয় না। কোথায় যেন বাধে। স্বশিক্ষিত অয়ন এটুকু বোঝে যে পশুপাখিদের মধ্যে একে অপরের প্রতি সম্মানবোধ আছে কি না, সে জানে না। তবে সে জানে আমরা মানুষ। আমাদের মধ্যে যদি পারস্পরিক সম্মানবোধ না থাকে, তবে আমরা কী নিয়ে বাঁচব। এমনই কিছু একটা ভেবে একসময় সাহস করে সে বলেই ফেলে, ‘দোস্ত, শোনো। গ্রামের মেয়ে। কত সুন্দর মেয়েটা। অসময়ে বাবাকে হারিয়ে মা-মেয়ে দিশেহারা। দোস্ত, আমার মনে হয় তানিয়াকে যদি তুমি জীবনসঙ্গিনী করো, খুব বড় ভুল হবে না।’
সোহাগ এক লাফ মেরে চেঁচিয়ে বলে, ‘শাটআপ অয়ন! একবার ভেবে দেখো তুমি কী বলছ! তোমার কি মাথাটা পচে গেছে!’
অয়ন শান্ত কণ্ঠে বলে, ‘না, মোটেই না। ওর প্রতি এত টান, আবার এত ঘৃণা! কারণ কী? তুমি কি বলতে চাও তানিয়া বহুগামী?’
এ জগতে নারী-পুরুষ সবাই বহুগামী। মনের ঘরে প্রতিটা মানুষ লাগামহীন। অভিনয়ের চাদর গায়ে দিয়েই মানুষ এ সমাজে টিকে থাকে। সেনসিটিভ বিষয়গুলো আড়াল করতে গিয়ে অনর্গল মিথ্যা কথা বলে। এ সমাজে একজন ভালো মানুষের রূপরেখা এমনই। তবে তানিয়া অন্য রকম মেয়ে। সে শুধু আমারই পথ চেয়ে বসে থাকে।

ঠিকই বলেছ, দোস্ত। আমরা এমনটা ভাবতেই ভালোবসি। এই ‘আমার’ শব্দটার ভেতরই লুকিয়ে আছে যত অঘটন।

সোহাগ আর তানিয়ার মধ্যে কোথায় যেন বেশ জটিল এক রহস্যের আভাস পেয়ে অয়ন সেদিন এখানেই থেমে যায়। শুরু করে অন্য প্রসঙ্গে আলোচনা। তবে মনের নিভৃত কোণে তার একটা আশা বসবাস করছিল; এখন স্বীকার না করলেও সোহাগ একদিন ঠিকই তানিয়াকে বিয়ে করবে। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মতো শক্তি নিয়েই সোহাগ মেয়েটাকে আপন করে নেবে। ওই সময় এখনো আসেনি। তাই সে ঘৃণা দিয়ে ভালোবাসা আড়াল করছে।

এইচএসসি ফল প্রকাশ হওয়ার পর সোহাগ বেসরকারি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে ঢাকায় চলে যায়। তানিয়ার সুখ তাকে কখনো দুই সপ্তাহ, ব্যস্ততা বেশি থাকলে কখনো মাসে একবার টেনে আনতই। বাড়িতে এসে মা-বাবার সঙ্গে একটু সময় কাটিয়ে সোহাগ সন্ধ্যার পর বেরিয়ে পড়ত নদীর পাড়ে। নীরব-নির্জনে চলত দুই বন্ধুর আলাপন।

সময়ের নিয়মে সময় কেটে যায়। মাস্টার্স ফাইনাল দিয়ে সোহাগ বিয়ে করে। তার ইউনিভার্সিটিরই এক অধ্যাপকের মেয়ে। নাম ছন্দা। মাসখানেকের মধ্যেই ছন্দার মাস্টার্স শেষ হবে। এরপর এই দম্পতি যুক্তরাষ্ট্রে সেটেল হবে এমনই শোনা যাচ্ছে। সোহাগদের গ্রামের বাড়িটা ছন্দার খুব পছন্দ। পরীক্ষা শেষে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগে আগে মাসখানেক সময় গ্রামের বাড়িতে বেড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে এ নতুন দম্পতি বাড়িতে আসে। চার দিন পর হঠাৎ এক শেষ রাতে পাশের গ্রামে বেশ কয়েকটি মেয়েলি কণ্ঠে চিৎকার শোনা যায়। সকাল হতে না হতেই চারজন পুলিশ সদস্যকে দেখা যায় ওই গ্রামে ঢুকছে। অয়ন তখন দোকানে যাচ্ছিল। ঘটনা কী জানতে চাইলে অয়ন সোহাগকে বলে, ‘ওই যে তানিয়া। গভীর রাতে কবরস্থানে গেছিল বুঝি। সাপে কাটছে। এরপর দৌড়ে এসে ওদের ঘরটার সামনে পড়ে কয়েকটা চিৎকার দিয়েই সব শেষ।’
আরে দোস্ত, বলো কী!
হ, ঠিক তাই। দিনের বেলায় তো আসতে পারে না। হারু মাতবর দখল করে নিছে সব। বাপের কবর দেখতে আসছিল মনে হয়। শুনছি, সপ্তাহ দুই আগে মারা গেছে ওর মা। মনটা হয়তো ভালো ছিল না তাই। নইলে গভীর রাতে কবরস্থানে যাবে কেন।

কী যেন ভেবে সোহাগ অয়নকে বলে, আহা রে! কেন যে আমার খুব অস্থির লাগছে। চলো দোস্ত, দেখে আসি।
হ, আমি দেখে আসছি। ইচ্ছে হলে তুমি যাও। কী আর দেখার আছে, দোস্ত। লোকজন আজেবাজে কথা বলছে। মা-বোন তো সবারই আছে। এসব শুনতে আর ভালো লাগে না।
বলেই অয়ন দোকানে চলে যায়।

পুলিশ সুরতহাল রিপোর্ট করে লাশ নিয়ে চলে যায়। কারণ, চেনা মুখ হলেও গ্রামের কেউ সৎকারের দায়িত্ব নিতে রাজি হয়নি।

*[email protected]