করোনাকালে একজন সাহেদের গল্প

মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম। ফাইল ছবি
মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম। ফাইল ছবি

দৈবদুর্বিপাক, প্রাকৃতিক ঝড়–জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়–সাইক্লোন, টর্নেডো–বন্যা, অগ্নিকাণ্ড ও স্থল–জলপথের যেকোনো দুর্ঘটনায় অসহায় মানুষের সহযোগিতায় একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়া আমাদের ঐতিহ্য। তাই দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতায় আমরা বিশ্বস্বীকৃত। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারি করোনার কাছে বিশ্ববাসীর মতো আমরাও অসহায়। অদৃশ্য শত্রু করোনা মোকাবিলায় বিভিন্ন পাড়া–মহল্লায় তরুণসমাজ এবং সমাজের সামর্থ্যবানেরা সরকারের পাশাপাশি কমবেশি এগিয়ে এসেছেন। আবার গুটিকয় ত্রাণ আত্মসাৎকারী চেয়ারম্যান-মেম্বারের ঘৃণিত কর্মও দেশবাসী দেখেছে। কিন্তু একজন সাহেদের গল্প ছিল অজানা। তাঁর একই অঙ্গে অনেক রূপ। কী না তিনি? রাজনৈতিক নেতা, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, তথা বিশিষ্ট টক শো বিশারদ, সামরিক কর্মকর্তা, প্রকাশক-সম্পাদক; স্কুল-কলেজ, আবাসিক হোটেল, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, এমএলএ, প্যাথলজি ও হাসপাতালের মালিক-চেয়ারম্যান! আর কিছুটা সময় পেলে তিনি আইন ব্যবসার ফার্ম খুলে দেশ-জাতিকে তথাকথিত সেবাও দিতে পারতেন।

মফস্বল শহর সাতক্ষীরায় জন্ম নেওয়া মাত্র এসএসসি পাস করা সাহেদ রাজধানী শহর ঢাকায় এসে রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে সচিব, এমনকি নেতা-মন্ত্রী, আমলা, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ সবাইকে ঘোল খাইয়ে ছেড়েছেন। কোথায় তাঁর অবস্থান ছিল না? রাষ্ট্রের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে ধারণ করা সহাস্য ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল। তবে কোমরে দড়ি পরার পর আজ কেউ সাহেদকে চিনছেন না। ইনিয়েবিনিয়ে নিজেদের আড়াল করছেন এবং দোষ চাপাচ্ছেন একে অন্যের ওপর। কী তাঁর কীর্তি ছিল, যা রথী-মহারথীরা জানতেন না। আবার কেউ জানতেন না! এ কথা শুনলে গাধাও মিটিমিটি হাসবে। আইন-আদালত কি গোপন বিষয়? ১০ বছর আগে তাঁর বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতির মামলায় আদালতের ছয় মাসের জেলের রায় কীভাবে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল? ২০১৬ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পুলিশের গোয়েন্দা রিপোর্টে সাহেদকে প্রতারক হিসেবে চিহ্নিত করার পরও কীভাবে গণভবন ও বঙ্গভবনে ঢুকতে পারেন এবং রাজধানীর বাইরে পুলিশি প্রটোকল এবং গানম্যান রাখতে পারেন, তা রীতিমতো ভাবার বিষয়। সাহেদদের মতো লোক রাষ্ট্রের সংবেদনশীল এলাকায় ঢুকতে পারলে জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

কেউ জানুক আর না–ই জানুক। বর্তমানে গণমাধ্যমের কল্যাণে সবাই সাহেদকে জানছে। যতই জানছে, ততই অবাক হচ্ছে মানুষ। প্রতারণায় বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই সাহেদ একজন বিস্ময়কর প্রতিভা। এই অল্প বয়সে কম শিক্ষিত সাহেদ অনেক সেক্টরে প্রতারণায় সফলতা দেখিয়েছেন, হয়েছেন কোটি কোটি টাকার মালিক। মোটকথা, বর্তমানের প্রতারকেরা সাহেদের কাছে নস্যি, তবে আগামীর প্রতারকদের জন্য নিশ্চয় গুরু বা আইডল হিসেবে বিবেচিত হবেন আর অপরাধবিজ্ঞানের ছাত্রদের পাঠ্যসূচিতে সাহেদ–কর্মকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, আর কেউ যদি পিএইচডি থিসিসের বিষয়বস্তু হিসেবে নেয়, নেহাত মন্দ হবে না। ধরা পড়ার পরও ভয়–শঙ্কাহীন, ভাবলেশমুক্ত, ডোন্ট কেয়ারসুলভ সাহেদের মুখাবয়ব জাতিকে বিস্মিত করেছে। সত্যিই সাহেদ প্রতারণার জগতে একজন দক্ষ মেধাবী এবং উঁচু মানের কারিগর, যিনি প্রতারণাকে শৈল্পিক রূপদানে সক্ষম হয়েছেন। প্রতারণাশিল্পে অভিনয়ের স্বীকৃতির জন্য যা কিছু মন্দ তা চিহ্নিতকরণে তিরস্কার কমিটি গঠন করে প্রতারণা ক্যাটাগরিতে তাঁকে তিরস্কারের জন্য বিবেচনায় নিতে পারেন (দুঃখিত, রূপক অর্থে)।

প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাহেদ সুই হয়ে ঢুকতেন এবং কুড়াল হয়ে বের হতেন। কোনো একটি সেক্টরের প্রতারণায় সাহেদ সীমাবদ্ধ ছিলেন না। যখন যেই সেক্টরে প্রতারণার সুযোগ আসত, সেই সেক্টরেই ঢুকে পড়তেন। রীতিমতো তিনি একজন ডায়নামিক এবং প্রত্যুৎপন্নমতি প্রতারক। করোনাকালে হাসপাতাল–সংকটের সময় বিনা টাকায় করোনার টেস্ট এবং চিকিৎসার নামে ঢুকে জালিয়াতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লুটে নেন। বিনা টেস্টে ইচ্ছাকৃতভাবে পজিটিভ–নেগেটিভ সার্টিফিকেট দেওয়ার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে করোনা বিস্তার এবং মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেন। এ ছাড়া নানা অপরাধ ছিল তাঁর নিত্যদিনকার ঘটনা।

রিজেন্ট ও জেকেজির মতো ভুয়া টেস্ট প্রদানকারীদের কারণে ইতালি আমাদের প্রবাসীদের ফেরত পাঠিয়েছে এবং জাপানসহ অনেক দেশ আমাদের নাগরিকদের ঢুকতে দিচ্ছে না। বিশ্ব মিডিয়ায় রিজেন্ট ও জেকিজির করোনা টেস্টের ভুয়া সার্টিফিকেটের সংবাদ দেশের ভাবমূর্তিকে ভীষণভাবে হেয় করেছে, প্রবাসীদের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তায় ফেলেছে, নিঃস্ব এবং ভিখারী করেছে অসংখ্য সৎ ব্যবসায়ীর জীবনকে, জীবন গেছে অসংখ্য করোনা রোগীর। যে সাহেদরা শুধু সামান্য টাকার জন্য অসহায় মানুষের অমূল্য জীবন কেড়ে নিতে পারে। সেই মানুষরূপী হায়েনাদের বাঁচাতে উকিল, মোক্তার, ব্যারিস্টারের অভাব নেই, অভাব নেই টক শোতে কূটকৌশলী তথাকথিত রাজনীতিবিদদের। দেশবাসী সাহেদের সর্বোচ্চ শাস্তি এবং সাহেদ তৈরির নেপথ্যে থাকা কারিগরদের দেখতে চায়, নাহলে যে লাউ সেই কদু। দুই দিন পর আমরা সবই ভুলে যাব, পর্দায় হাজির হবে অন্য এক সাহেদ।