আমার ঈদ ও নোনা সেমাই

আজ পবিত্র ঈদুল আজহা। প্রচণ্ড কাজের চাপে গত সাত দিনেও ঈদের কথা মনে ছিল না। মনে থাকার কথাও না। জন্মভূমি থেকে প্রায় ৪ হাজার ২০০ মাইল দূরের দেশ সুইডেনে ঈদ উপলক্ষে যে গরুর হাট বসে না, রাস্তা দিয়ে কোরবানির পশু নিয়ে যায় না কেউ, চিৎকার করে দামও জিজ্ঞেস করে না কেউ, ‘ভাই কত নিল...?’

কাজ শেষে নিদারুণ ক্লান্তি নিয়ে মধ্যরাতে ঘরে ফিরতেই হঠাৎ মনে পড়ল কথাটা। আজ ঈদ! মা-বাবা, প্রিয়জনকে রেখে এটা আমার দ্বিতীয় ঈদ। গেল রোজার ঈদটা ছিল প্রথম।

ঈদের কথা মনে পড়তেই জীবনের কাছে-দূরের কত স্মৃতি যে এসে উঁকি দিল। বাবা সরকারি চাকরি করতেন, সেই সুবাদে আমরা থাকতাম কলোনিতে। এখন যত মানুষ একা একটি গরু কোরবানি করেন তখন এত সংখ্যক মানুষের সেই সামর্থ্য ছিল না। বাবা ও তাঁর সহকর্মীরা মিলে সাত ভাগে কোরবানি করতেন। কলোনির বন্ধুদের মধ্যে অনেক আগে থেকেই এই নিয়ে আলাপ চলত, ‘এই এইবার তোরা কাদের সঙ্গে রে?’ যখন দেখতাম আমার বন্ধুদের কেউ কেউ আমাদের সঙ্গে কোরবানি দিচ্ছে, তখন যে কী আনন্দ হতো! গরু কেনাকে কেন্দ্র করে আমাদের কতশত পরিকল্পনা! আর প্রতি সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেই মায়ের সঙ্গে ঘ্যানঘ্যান করা, ‘মা আব্বা কবে বোনাস পাবে? আমরা গরু কিনব কবে?’ মা বলতেন, ‘তোর আব্বাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর।’ যদি হাটে গিয়ে ব্যথা পাই কিংবা হারিয়ে যাই, সেই ভয়ে আব্বা গরু কিনতে নিয়ে যেতে চাইতেন না। আমাকে না জানিয়ে যেতে চাইতেন।

লেখক
লেখক

কোরবানির শরিক অন্য বন্ধুদের কাছ থেকে খোঁজ নিতাম, সেই অনুযায়ী আব্বার পিছু নিতাম। কেনা শেষে রাজধানীর গাবতলী হাট থেকে সোবহানবাগ পর্যন্ত হেঁটে এসেও ক্লান্তি আসত না। গরু তো কেনা হলো, এবার কার বাসার সামনে বাধা হবে সে নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে একটা মৌন তর্ক চলত। সন্ধ্যার পর কলোনির সবাই সবার কোরবানির গরু দেখত যেত। বাসায় চলত ঈদের রান্না-বান্না, ঘরের সাজগোছ। বন্ধুরা মিলে রাস্তায় গরু নিয়ে যাওয়া মানুষদের কাছে চিৎকার করে গরুর দাম জানতে চাইতাম। জবাব পেলে, পাল্টা জবাবে থাকত, ‘ভাই জিতছেন।’

সব মিলিয়ে কোরবানির ঈদ মানে ছিল বাড়তি আনন্দ। এ স্মৃতিগুলো মাথায় ঘুরতে ঘুরতেই ভাবলাম, একটু সেমাই রান্না করি (রোজার ঈদে কেনা ছিল)। কিছুক্ষণ দুধ গরম করে তার মধ্যে একগাদা চিনি ঢালতেই মনে হলো, আমি কী করলাম! এ তো চিনি না, লবণ! বুঝতে বাকি রইল না, এবারের কোরবানির ঈদটা কেমন যাবে।

*শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব গোথেনবার্গ, সুইডেন