করোনায় স্লোভেনিয়াতে অন্য রকম এক ঈদ

আইডোসচিনাতে ঈদের নামাজে মুসল্লিরা। ছবি: সংগৃহীত
আইডোসচিনাতে ঈদের নামাজে মুসল্লিরা। ছবি: সংগৃহীত

পৃথিবীর অনেক দেশের মতো আজ স্লোভেনিয়াতেও উদযাপিত হচ্ছে পবিত্র ঈদুল আজহা।

ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো স্লোভেনিয়াতে ঈদ উপলক্ষে কোনো সরকারি ছুটি থাকে না। তাই এখানকার মুসলিম অধিবাসীদের মধ্যে ঈদ আবির্ভূত হয় বছরের অন্যান্য সাধারণ এক কর্মব্যস্ত দিনের মতো।

প্রায় ২১ লাখ জনসংখ্যার স্লোভেনিয়াতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টানিটি। এর পরই দেশটির সবচেয়ে বেশি মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করেন। ২০১৮ সালের জনগণনা অনুযায়ী স্লোভেনিয়ার মোট জনসংখ্যার শতকরা ৩.৭ ভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করেন। স্লোভেনিয়ার মুসলিম জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই বসনিয়ান এবং আলবেনীয় বংশোদ্ভূত। ১৯৯২ সালে যুগোস্লাভ যুদ্ধের সময় সার্বদের গণহত্যা ও বিভীষিকা থেকে বাঁচার জন্য বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা ও কসোভো থেকে নিরাপদ জীবনের আশায় অনেকেই স্লোভেনিয়াতে পাড়ি জমান, যাঁদের বেশির ভাগই মুসলিম। এঁরাই আজকের দিনের স্লোভেনিয়ার জনগোষ্ঠীর দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ।

গত ১৫ মে ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে স্লোভেনিয়া লকডাউন তুলে নেয়। তবে গত কয়েক সপ্তাহে নতুন করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। স্লোভেনিয়ার গণমাধ্যমগুলো দাবি করছে, লকডাউন শিথিল ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সীমান্ত সংযোগ পুনরায় চালু করার পর বলকান দেশ বিশেষ করে সার্বিয়া, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, মেসেডোনিয়া, আলবেনিয়া, কসোভো থেকে মানুষের যাতায়াত বৃদ্ধির কারণে দেশটিতে নতুন করে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। উল্লেখ্য, পুরো ইউরোপে রাশিয়ার পরপর করোনাভাইরাসের সংক্রমণের দিক থেকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে বলকান দেশগুলো। তাই নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধির ভয়ে প্রায় অর্ধশতাব্দী পর উদ্বোধন হওয়া দেশটির ইতিহাসের প্রথম অফিশিয়াল মসজিদে এ বছর কোনো ঈদের জামাতের অনুমতি দেওয়া হয়নি। এমনকি দেশটির রাজধানী লুবলিয়ানাসহ অন্য বৃহত্তর নগরী মারিবোর, ক্রানিয়ে, ছেলইয়েও সেভাবে ঈদ জামাতের খবর পাওয়া যায়নি।

তবে স্লোভেনিয়াতে আমার ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস যে স্থানে অর্থাৎ আইডোসচিনাতে অত্যন্ত স্বল্প পরিসরে জামাতে ঈদের নামাজের আয়োজন করা হয়। আইডোসচিনা এবং এর আশপাশের এলাকার মুসলিমরা একটি ফ্ল্যাট কিনে সেখানে মসজিদের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। যেহেতু স্লোভেনিয়ার সরকার করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে একই সঙ্গে ৫০ জনের বেশি মানুষের জমায়েত নিষিদ্ধ করেছে, তাই কয়েক গ্রুপে বিভক্ত করে এ ঈদ জামায়াতের আয়োজন করা হয়। ভোর ৬টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত ৪টি ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়। কোনো নির্দিষ্ট গ্রুপে একসঙ্গে ৩০ জনের বেশি মানুষকে একত্র হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি এবং যারা যারা নামাজে অংশ নিতে আগ্রহী ছিল, সবাইকে গতকাল ইমামের সঙ্গে যোগাযোগ করে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করতে হয়েছিল। ইমাম নির্ধারিত করে দেন কে কোনো গ্রুপে কোন সময় নামাজের জন্য উপস্থিত হবেন। ইমামের অনুমতি ছাড়া কাউকে ঈদের নামাজে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়নি, তা ছাড়া মসজিদে প্রবেশের আগে সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মুখে মাস্ক পরিধান ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হয়েছিল। পাশাপাশি দুজন মুসল্লির মাঝে ফাঁক রাখা হয়েছিল এবং প্রত্যেককে একটি নির্দিষ্ট টোকেন নম্বর দেওয়া হয়েছিল। কে কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করবে, সেটা এ টোকেন নম্বরের ভিত্তিতে নির্ধারিত করা হয়েছিল।

নামাজ শেষে বসনিয়ার এক বন্ধুর সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
নামাজ শেষে বসনিয়ার এক বন্ধুর সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

দেশে আমরা একে অপরকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে ‘ঈদ মোবারক’ শব্দটি বেশি ব্যবহার করি। কিন্তু এখানকার মানুষ ঈদ মোবারকের পরিবর্তে ‘বায়রাম ওলসুন’ শব্দটি ব্যবহার করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তুর্কি ভাষায় ঈদকে বায়রাম বলা হয়। এমনকি তাঁদের দেশের মসজিদগুলো তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের স্থাপত্যশৈলীকে অনুসরণ করে নির্মিত। যেহেতু ঈদ জামাতে আসা মুসল্লিদের বেশির ভাগই বসনিয়ান বংশোদ্ভূত, তাই ইমাম সাহেবও খুতবা দিয়েছিলেন বসনিয়ার স্থানীয় ভাষায়। আমাদের দেশেও যদি আরবি ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষায় খুতবা দেওয়া হয়, তাহলে মানুষের কাছে এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অধিক ফলপ্রসূভাবে পৌঁছাবে।

ইউরোপের বেশির ভাগ দেশের মতো স্লোভেনিয়াতে বাংলাদেশের মতো পশুর হাটের রীতি নেই। পাশাপাশি আমাদের দেশের মতো সেখানে জনসমক্ষে পশু জবাই করা নিষিদ্ধ। যাঁরা সামর্থ্যবান, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা নিকটস্থ কোনো মসজিদের কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অথবা কোনো মাংসের দোকানের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোরবানির ব্যবস্থা করেন। তাঁরাই কোরবানির যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এক থেকে দুই দিনের মাথায় বাসায় মাংস পৌঁছে দেন।

স্লোভেনিয়াতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংখ্যা বলতে গেলে একেবারে হাতে গোনা। সব মিলিয়ে মধ্য ইউরোপের এ দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সংখ্যা হবে ৩০ থেকে ৪০ এর মধ্যে। ইউরোপের অন্যান্য দেশ বিশেষ করে ফ্রান্স, ইতালি, গ্রেট ব্রিটেন, স্পেন, পর্তুগাল—এসব দেশের মতো স্লোভেনিয়াতে এখনো সেভাবে বাংলাদেশি কমিউনিটি গড়ে ওঠেনি। এ কারণে নিজেদের মাঝে সেভাবে পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা করাও সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই স্লোভেনিয়াতে বাংলাদেশিদের মাঝে ঈদ আয়োজন বলতে গেলে অনেকটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক। লুবলিয়ানা কিংবা মারিবোরে অনেক সময় দেখা যায় কিছু বাংলাদেশি একত্র হয়ে ঈদ উপলক্ষে নিজেদের মাঝে ছোটখাটো একটি আয়োজনের ব্যবস্থা করে। স্লোভেনিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্র অস্ট্রিয়া এবং ইতালিতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশির বসবাস রয়েছে এবং এ দেশ দুটিতে বাংলাদেশিদের শক্তিশালী কমিউনিটি রয়েছে। আমাদের দেশের মতো সেখানেও প্রবাসী বাংলাদেশিরা ঈদ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে বিশেষ করে সেকেন্ড ওয়েভে ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে নতুন করে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এ মুহূর্তে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে রাখা হয়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে ইচ্ছা থাকলেও সীমানা পেরিয়ে অন্য দেশগুলোতে যাতায়াত করা সম্ভব হয় না। অনেকটা একাকিত্বের মাঝে চলে যায় এখানকার বেশির ভাগ প্রবাসী বাংলাদেশিদের ঈদ আনন্দ।

কোনো জিনিস না হারালে মানুষ আসলে বুঝতে পারে না তার মর্ম আদতে কতটুকু? বাংলাদেশ ছেড়ে যখন স্লোভেনিয়াতে আসি, কোনো দিন ভাবিনি জীবন থেকে সেরা সময়গুলো একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাবে। এখন আর বাবার সঙ্গে কোরবানির হাটে যাওয়া হয় না। নিজের পছন্দমতো পশু নির্বাচনের সুযোগ হয় না। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গেও একসঙ্গে আর ঈদের নামাজে অংশ নেওয়া হয় না। মায়ের হাতের রান্না করা সেমাই, জর্দা, পোলাও এবং কোরবানির মাংসের স্বাদ এখন আর জোটে না। অতীতের সে সোনালি সময় এখন কেবল স্মৃতি। সব ধরনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা এবং প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাবকে বুকে চাপা দিয়ে এগিয়ে চলে প্রত্যেক প্রবাসীর জীবন।


*লেখক: শিক্ষার্থী, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।