একদিন ঢাকা শহরে

যেকোনো শহর আমার ভালো লাগে। হয়তো ঢাকা শহরে জন্ম বলেই। ভালো লাগার একটি কারণ শহর কখনো কাউকে একাকিত্ব দেয় না। একাকিত্ব না দেওয়ার সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে যে তখন জীবনে বিষণ্নতা বা অবসাদ আসার সুযোগ পায় না। চারপাশে মানুষ ও বিষণ্নতার সম্পর্ক বিপরীতমুখী। শহরে সবকিছুতেই থাকে ভাগীদার। রাস্তায় হাঁটা, স্যালুনে চুল কাটা, আইসক্রিম খাওয়া, একা একা কোথাও মনের সুখে কান্নাকাটি করতে বসা—যা-ই করতে যাবেন না কেন, পেয়ে যাবেন অনেক ভাগীদার। লুকিয়ে লুকিয়ে কান্না করছেন, সেটাও কেউ না-কেউ দেখে ফেলবে। পাশে এসে দাঁড়িয়ে মিষ্টি সুরে বলবে, ‘ভাইসাবের হইসে কী? চোখ মুছেন। দুইন্নায় কান্নাকাটির কোনো দাম নাই। মোবাইল ফোনটা লাগান তো দেহি, ভাবিরে জানাই।

আমার সাথে এহনি চলেন, রিকশায় উঠাইয়া দেই।’ আপনার মন গলে যাবে দরদি মানুষটির প্রতি। পকেট থেকে ফোন বের করবেন। ভদ্রলোক ‘ওই রিকশা, ওই রিকশা’ করতে করতে এগিয়ে যাবেন। ইতিমধ্যে আপনার খারাপ মন ভালো হওয়া শুরু করেছে। নিজেকে বোঝাচ্ছেন, পৃথিবীটা আসলে এত খারাপ না। ভালো মানুষ এখনো রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায়। আপনি রিকশার জন্য অপেক্ষা করছেন তো করছেন। রিকশা আর আসে না। লোকেরও খবর নাই। একটু পর পকেটে হাত দিয়ে দেখেন মানি ব্যাগ উধাও। সঙ্গে মোবাইল ফোনও। এবার আপনি টেনশনে আছেন এই কাহিনি বাসায় গিয়ে বউকে কীভাবে বর্ণনা করবেন। আপনার মনে হবে সেই মুহূর্তে বাটপারের চাইতে বউ বড়, বউয়ের চাইতে বড় একটা বিশ্বাসযোগ্য কাহিনি। আপনি মানসিকভাবে ব্যস্ত হয়ে যাবেন একটা আকর্ষণীয় কাহিনি তৈরিতে। ব্যস, আপনার দুখী দুখী ভাব শেষ। এই হচ্ছে শহরে থাকার সবচেয়ে বড় মজা। বিশেষ করে ঢাকা শহর।

প্রতিবার ঢাকা গেলে আমার একটা প্ল্যান থাকে শহরময় ঘুরে বেড়াবার। এ জীবনে নিউইয়র্ক শহরে বেশ কিছুদিন থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছে। তা ছাড়া প্যারিস, লন্ডন, ভেনিস, কায়রোসহ অনেক শহর ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু ঢাকার স্থান সবার ওপরে। অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অতুলনীয় শহর। আমেরিকায় ছাত্র অবস্থায় আমি আর আমার বন্ধু অপু মিলে একবার প্ল্যান করলাম ঢাকা শহরের বিভিন্ন পেশা নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি বানানোর। ওই ডকুমেন্টারির নাম হবে ‘প্রফেশনস ইন দ্য সিটি অব ঢাকা’ অর্থাৎ ঢাকা শহরের পেশাসমূহ। পৃথিবীতে সাড়া ফেলে দেবে। আইডিয়াটা ছিল ঢাকা শহরের এমন কিছু পেশা নিয়ে প্রামাণ্য চিত্র করা, যা কিনা পৃথিবীর অন্য কোনো শহরে বিরল। শুধু বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে সদরঘাট লঞ্চ ঘাট পর্যন্ত হাঁটা দিলে যেসব পেশার মানুষ পাওয়া যাবে, তা নিয়ে। আমি ছোটখাটো একটা লিস্টও বানিয়েছিলাম। যেমন কান পরিষ্কার ও চোরাই জুতা বিক্রি করার পেশা। টাকা বেচাকেনার ফেরিওয়ালা। পুরোনো টাকা বদলিয়ে নতুন টাকা কেনা। টাকা দিয়ে টাকা বেচাকেনা পৃথিবীর আর কোথাও আছে কি না, জানা নেই। সবচেয়ে আকর্ষণীয় হতো জিন্দামরার ভিক্ষা পেশা। একটা মরা মানুষ সাদা চাদরে ঢাকা। মাথা ও পায়ের দিকে সুগন্ধী আগরবাতি জ্বলছে। কালো বোরকা পরা একজন মহিলা তাঁর পায়ের কাছে পবিত্র কোরআন শরিফ পড়ছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই দৃশ্যের সঙ্গে খুবই পরিচিত ছিলাম। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া বাস স্ট্যান্ড বা এখনকার বঙ্গবাজারের আশপাশে এই দৃশ্য ছিল নিয়মিত। ওই মহিলাকেও অনেকবার দেখছি। মাঝেমধ্যে স্থান পরিবর্তন করতেন। এগুলো ছাড়াও আছে হাতির ভিক্ষা করা। বিশাল এক হাতি এসে জানালার সামনে শুঁড় উঁচিয়ে টাকা চাইবে, দিলেন ৫০ টাকা। ছুড়ে ফেলে দেবে। দিবেন ১০০ টাকার একটা চকচকে নোট। তখন রাস্তা পরিষ্কার। ওই হাতিগুলোর পূর্বপুরুষ বনে-জঙ্গলে হয়তো ভারী মালামাল বহন করত। কপালের কী খেল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হাতিও আজ ভিক্ষুক।

শেষবার ঢাকায় গিয়ে গেলাম সস্তা দামের শার্ট আর বেল্ট কিনতে ঢাকা কলেজের উল্টো দিকে নুরজাহান সুপার মার্কেটে। সঙ্গে ফেলে আসা ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসেও ঢুঁ মারার প্ল্যান। ফুফাতো ভাইকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দিলাম। ফুটপাতে নকল ডাবের পানি আর মবিলে ভাজা জিলাপি খেয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। ডাবওয়ালাকে আগেভাগেই বললাম, ইনজেকশন দেওয়া চিনিমিশ্রিত পানি না হলে খাব না। আমি চিনিখোর। ডাবওয়ালা বলল, ‘ভাইজান কি ইয়ার্কি মারেন?’
-ইয়ার্কি না, সিরিয়াস কেস।
-আসল ডাব ছাড়া এই আলফাজ মিয়া দুনিয়ায় ব্যবসা করে না। আফনে রাস্তার যেকোনো মানুষরে জিগান আমি কিমুন ডাব বেচি। সামনেই কাইটা দিমু। আলফাজ মিয়া হাতে চকচকে দা নিয়ে ধার পরীক্ষা করে আর আমার দিকে যেন কীভাবে তাকায়।

আলফাজ মিয়াকে অবাক করে দিয়ে আমি অদূরেই বসা আরেক ডাবওয়ালাকে জিজ্ঞেস করি,
-কার ডাব ভালো বলেন তো ভাই। আলফাজ মিয়ার না আপনের?

-খালি কলসি বাজে ভালো। হেরেই জিগান। হারা দিন পটোর-পটোর কইরা বিশটা ডাবও বেচতে পারছে কিনা জিগান। আমার মাল দেহেন। তিন ঘণ্টাও হয় নাই, পেরাই সব বেইচ্যা দিছি।

আমি আবার আলফাজ মিয়ার দিকে ফিরে তাকাই আর বলি,
-তুমি জিজ্ঞেস করতে বললে, তাই করলাম কিন্তু তোমার রেফারেন্স তো ভালো না। আলফাজ মিয়া হাতের দা নিয়ে অন্য ডাবওয়ালার দিকে যায় চ্যালেঞ্জ করতে। দেখি দুই ডাবওয়ালা প্রায় মারমুখী অবস্থা। ইতিমধ্যে ভিড়ের মধ্য থেকে এক মহিলা এসে শার্ট টান দিল। হাতে পান রাখার বাক্স বা কৌটার মতো কিছু একটা দেখাচ্ছে। কিছুই বুঝে উঠতে পারি না। কাজিন এসে উদ্ধার করল। বাংলাদেশের প্রাচীন পেশা বেদে গোষ্ঠী যারা কিনা একসময় সাপ খেলা দেখাত, তারা অনেকেই এখন শহরের রাস্তায় ভিক্ষা করে। এটাই পেশা। ওই কৌটার মধ্যে সাপ নিয়ে তারা ঘুরে বেড়ায়। পথচারীরা সেই কৌটার ভেতর বসে থাকা বাচ্চা সাপের ভয়ে ৫ কি ১০ টাকা যা পারে, দিয়ে সটকে পরে। আমি মহিলাকে বললাম, আমার বাসায় পোষা ইগল পাখি আছে। সাপের বাচ্চা পেলে সে খুব মজা করে খাবে। আমাকে সাপ দিয়ে ভয় দেখিয়ে লাভ হবে না। তাকে কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করলাম।

ইতিমধ্যে দুই ডাবওয়ালার তর্কাতর্কি তুমুল পর্যায়ে। এ পর্যায়ে তাদের বাপ-দাদার জেনারেশন নিয়ে গালিগালাজ চলছে। গালিগালাজের বেশির ভাগই পেশা সম্পৃক্ত। এই যেমন একজন বলছে, তার দাদা আগে আন্তজেলা ডাকাত ছিল এবং জীবনে অনেকগুলো খুন করে এখনো জীবিত ও সুস্থ সবল। প্রয়োজনে আরও একটা খুন করা তার জন্য হাতের ময়লা। তো আরেকজন অন্যজনকে চ্যালেঞ্জে দিয়ে বলছে, তার দাদা ওই রকম অনেক ডাকাতকে কোপায়ে মেরেছে। ইতিমধ্যে আশপাশে দর্শক জমে গেছে। একজন আবার মোবাইল ফোন উঁচু করে আলফাজ মিয়ার হাতে রাখা দায়ের ভিডিও করছে। যেকোনো মুহূর্তে কোপ পড়লে যাতে ভিডিওটা মিস না হয়। বেগতিক অবস্থা দেখে কাজিন কেটে পড়ার জন্য তাগাদা দিল। শেষমেশ দুইজনের বাগযুদ্ধ থামিয়ে আলফাজ মিয়ার ডাব খেয়ে শার্ট, বেল্ট কিনে ঢাকা কলেজে ক্যাম্পাসে ঢুঁ মারলাম।

স্মৃতিবিজড়িত ঢাকা কলেজ। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার, শামীম আজাদ ম্যাডামের ক্লাস। অলস দুপুরে ‘লাল সালু’র মজিদ চরিত্রের বিশ্লেষণ—সবকিছুই স্মৃতিতে ভাসে। তখন নব্বইয়ের উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তার রেশ ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসেও। এরশাদের ক্ষমতা যায় যায় অবস্থা। প্রতিদিন বেলা ১১টার দিকে ক্যাম্পাসে মিছিল হয়। শিক্ষাজীবনে খুব একটা মিছিলে যাইনি বা যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। মিছিলে না যাওয়াটাই ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। নেতারা নজর রাখত। মিছিলের ভাষাও মুখস্থ—জ্বালো, জ্বালো, আগুন জ্বালো। জেলের তালা ভাঙব অমুক ভাইকে আনব। এরশাদ তুই স্বৈরাচার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড় ইত্যাদি। নব্বইয়ের শহীদ নূর হোসেন ও ডাক্তার মিলনেরা তখনো জীবিত। স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে অনেক সাধারণ ছাত্রছাত্রীও বেশ ক্ষুব্ধ ও সক্রিয়।

তখন দুই পার্টির নেতা-নেত্রীরা অ্যারেস্টের ভয়ে বাসাছাড়া। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মতো খালেদা জিয়াও ছিলেন এরশাদের রোষানলের শিকার।

দুপুর ১২টার দিকে হতো আরেক পার্টির মিছিল। মোটামুটি একই ফরমেট। সভ্য পৃথিবীতে মানুষের জীবনযাত্রা থেকে শুরু করে মিটিং, মিছিল, হত্যা, ঘুষ-বাণিজ্য অনেক কিছুই একটা সিস্টেমের মধ্যে চলে এসেছে। আমজনতা কিছুদিন মাত্র সময় নেয় সেই সিস্টেমের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে। কলেজে পড়া অবস্থায় অনেক বিখ্যাত বা কুখ্যাত ছাত্রনেতার সাক্ষাৎ পেয়েছি যাঁদের তখন প্রায়ই পত্রিকার পাতায় দেখা যেত বা এখনো দেখা যায় অনেক সিনিয়র পদে।

মিছিল শেষে চা-নাশতা খেয়ে যার যার মতো আবারও ক্লাসে। বেলা আড়াইটা কি তিনটার দিকে সব ক্লাস শেষ। তখন শুরু হতো ছাত্রদের দ্বিতীয় প্রহর। এই প্রহরটা ইন্টারেস্টিং। ঢাকা কলেজ তখন খুবই নামীদামি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হরেক রকম ব্যাকগ্রাউন্ডের ছাত্র দিয়ে ক্যাম্পাস ঠাসা। উচ্চবিত্ত, মন্ত্রী-মিনিস্টারদের সন্তান থেকে শুরু করে গ্রামের ধনী-গরিব, কৃষকের মেধাবী ছাত্রদের মিলনস্থল ছিল এই ঢাকা কলেজ। মনে আছে, প্রথম ক্লাসের দিনে এক স্যার ক্লাস নিতে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দেখি এসএসসি রেজাল্টের পর তোমাদের মধ্যে থেকে কার কার ছবি পত্রিকায় এসেছে।’ সঙ্গে সঙ্গে প্রায় পুরো ক্লাস দাঁড়িয়ে গেল। এতগুলো বোর্ড স্ট্যান্ড করা ছাত্র একই ক্লাসে দেখে অবাক না হয়ে উপায় কি।

প্রতিদিন ক্লাস শেষে ধনীর ছেলেরা গাড়ি বা মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে বাড়ি যেত। কেউ যেত নিউ মার্কেট, নীলক্ষেতের মোড়ে লাল রঙের বিআরটিসি বাস ধরতে মিরপুর, মালিবাগ, নারায়ণগঞ্জ বা অন্য কোনো গন্তব্যে। কেউ যেত দুপুরের কড়া রোদে হেঁটে আশপাশের এলাকায় টিউশনিতে। কেউ যেত নর্থ বা সাউথ হোস্টেলে দুপুরের খাবার খেতে। ধনী সন্তানদের কেউ কেউ থেকে যেত এলিফ্যান্ট রোড, নিউ মার্কেটে কেনাকাটায়, রেস্টুরেন্ট কিংবা অন্য কোথাও।

একটা ঘটনা না বললেই নয়। শেষ বর্ষের শেষ ক্লাসের দিন সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম কলেজ ক্যাম্পাসের গাছ থেকে ডাব খাব। আমরা প্রায় ৩০ জনের গ্রুপ। বেশির ভাগই ঢাকায় বড় হওয়া। এখনকার নামকরা সাংবাদিক গোলাম মর্তুজাও ছিল, আমার ভালো বন্ধু। গ্রুপে আমি ছাড়া কেউ গাছে উঠতে পারে না। সেদিন চা-শিঙাড়া খাওয়ার পর সবাই আমাকে প্রায় জোর করে গাছে উঠিয়ে দিল। গাছ ছিল বেশ উঁচু। তখন ক্যানটিন আর পুকুর পাড় ঘেঁষে ছিল বেশ কয়েকটা নারকেলগাছ। সবাই প্রতিজ্ঞা করল, কলেজের প্রভোস্ট বা কোনো শিক্ষক এলে তারা নিচ থেকে স্যারদের সামলাবে। গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদে আমি সেই উঁচু গাছে উঠলাম। নিচে তাকিয়ে দেখি ৩০ জনের মধ্য থেকে বাকি আছে পাঁচ কি ছয়জন। কাকের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেশ কয়েকটা ডাব নিচের পানিতে ফেললাম। একটু পর নিচে তাকিয়ে দেখি সব ফাঁকা। সব পালিয়েছে। শুধু একজন দাঁড়িয়ে। উনি সাউথ হোস্টেলের প্রভোস্ট স্যার। আমার দিকে তাকিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছেন।

-এই গাছে কে উঠেছে?
-আমি?
-আমি কে? বহিরাগত?
-না স্যার, কলেজের ছাত্র।
-বুঝব কী করে তুমি ছাত্র? কী ব্যাপার? গাছে কী করো?
ভাগ্যিস পকেটে আইডি কার্ড নিয়ে উঠেছিলাম। নিচে ছুড়ে মারলাম। আইডি গিয়ে পড়ল পানির কাছাকাছি।

-স্যার, আইডি ভিজে গেলে সমস্যা হবে। একটু যদি দয়া করে তুলতেন। স্যার ইস্ত্রি করা প্যান্ট এক হাত দিয়ে উঠিয়ে পানির কাছাকাছি থেকে আইডি কার্ড তুলে নিলেন।

গাছে কী করি, এর উত্তরে একবার ভাবলাম বলি স্যার, গাছ থেকে পানিতে লাফ দিব। মজা করার জন্য উঠেছি। যাকে বলে টারজান ডাইভ। খুবই পারদর্শী ছিলাম এই ডাইভে। লাফের আগে টারজানের মতো চিৎকারও দিব ও -ওহ- ও- ওহ- ও- ও। সেই চিৎকার নিউমার্কেট পার হয়ে ইডেন কলেজ পর্যন্ত যাবে। পরে ভাবলাম, ডাব তো কয়েকটা পানিতে ফেলে দিয়েছি। স্যারের সঙ্গে এই ইয়ার্কি মারা ঠিক হবে না। উপরন্তু এইচএসসি পরীক্ষার প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় তো তাঁর কাছেই যেতে হবে। হাই রিস্ক আইডিয়া ভেবে ক্ষান্ত হলাম। স্যারকে অন্য রকম কিছুই বললাম না। প্রভোস্ট স্যারকে ডেকে নিয়ে আসছে বেটা দারোয়ান।

-স্যার, সবাই বলল শেষ দিন। কলেজের ডাব খাবে। এই ক্যাম্পাসের ফুল-ফল, গাছ ও ডাবে নাকি তাদের অধিকার আছে। ২০-২২ টাকা বেতন দেয়। কেউ গাছে উঠতে পারে না, তাই আমাকে উঠাল।

-বাহ। বেশ অধিকার রক্ষণকারী। বলি ডাব খাবে তো খাবে। অনুমতি কি নিয়েছিলে?
-না স্যার।
-যে কয়টা পেড়ে ফেলেছো ঠিক আছে। আর পাড়বে না। নেমে এসো। আমি সেদিনের মতো বেঁচে গেলাম।

ঢাকা কলেজজীবন দ্রুতই শেষ হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পুরোনো অনেকের আবার সাক্ষাৎ পেলাম। সেই সময়ও খুব দ্রুত পারে হলো। তারপর অনেক অনেকগুলো বছর পার হয়ে গেছে। আমার জীবনের তরি এসে ভিড়ল আমেরিকায়। এখানেও নতুন পরিবেশ, নতুন ইউনিভার্সিটি, নতুন মানুষ, নতুন জীবনে অভ্যস্ত হলাম। আমি ঢাকা শহরের জীবনকে স্মৃতিতে ধরে রাখতে চাই কিন্তু স্মৃতি ক্রমেই ধোঁয়াশার জাল বুনে দিচ্ছে। আমি জালের অন্যপাশে ছটফট করি। আমার জন্মশহর আমার হয় না, আমার থাকে না। আমি হয়ে যাই সেই শহরের অচেনা আগন্তুক। আমি শহর থেকে নিক্ষিপ্ত উল্কাপিণ্ডের মতো ঘুরিফিরি মহাশূন্যে। আমি গন্তব্য খুঁজে বেড়াই অনন্তকাল। আমি একটা শহর খুঁজে বেড়াই।

ঢাকা থেকে উড়াল দেওয়ার আগে প্লেনের সিটে বসে খান আতাউর রহমানের সুর করা আর কলিম শরাফীর কণ্ঠে সেই গানটিও বার বার শুনি—

পথে পথে দিলাম ছড়াইয়া রে
সে দুঃখের চোখেরও পানি
ও আমার চক্ষু নাই
পাড় নাই কিনার নাই রে
ও আমার চক্ষু নাই
ঘর নাই
ও মোর জন নাই
তবু দিলাম ভাঙা নায়ে
অকূল সায়র পাড়ি।