যদি ইন্টারনেট না থাকত...

>করোনাভাইরাসে পাল্টে গেছে জীবনের বাস্তবতা। আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই। করোনায় জীবন নিয়ে লিখছেন অনেকেই। এই চিকিৎসকও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর সিরিজ লিখছেন। আজ পড়ুন ১১তম পর্ব।

আজ কততম দিন, হিসাব না মেলালে বুঝতে পারতাম না।

ঘুম ভেঙেছে দেরি করে। আজ সবাই ব্যস্ত! সবাই মানে পতিদেবতা, কাজে! ছেলের সারা দিনের গেম! মেয়ে নাকি একটু আগেই নাশতা করে গেছে! ফের নেমে বলছে, মাথাব্যথা। ওষুধ খেয়ে নিতে বললাম! দেখি ওর জন্য স্টেরয়েড প্যাক অর্ডার করব। চেক করে দিলাম। ওষুধ লিখতে গিয়ে বাবার সঙ্গে কনফার্ম হচ্ছি, ডেট অব বার্থ। মেয়ের বাবা আমার এই বাচ্চাদের ব্যাপারে ভুলো মন নিয়ে ফাঁস করে না আর! আমার মনে থাকে না! আবার ভুল লিখতেও সায় দেয় না মনে, লিখে জাস্ট কনফার্ম করা! আসলে মন ঠিকমতো সায় দিচ্ছে না! ফোকাস করতে পারছি না ক্ষণে ক্ষণে। মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছে, বাইরে তাকিয়ে ঠিক দেখছি কি না! কিছুটা ব্লার লাগছে! চোখ রগড়ে আরেকবার দেখি, নো চেঞ্জ! বাকি সব ঠিক আছে। ফোকাসটাই ঠিক নেই। ঠিক বুঝতে পারি না চোখের ভুল, না দেখার ভুল।

আমার বাচ্চাদের বয়স মনে থাকে না, ওরা কোনো ক্লাসে পড়ে, মনে থাকে না। দেখা যায়, আমি বছরখানেক পেছনে। আমার কাছে তো, ওরা সেই এইটুকু, কখন বড় হয়ে যায় বুঝি না! মাঝেমধ্যেই অবাক হয়ে জানতে চাইত, আমি আসলেই ভুলে যাই কি না। কারণ ওদের জিজ্ঞেস করেই আমাকে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে হতো। ওরাও অভ্যস্ত এতে, এটা এমন না হওয়াই নরমাল নয়।

ঘণ্টাখানেক পর মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলাম, মাথাব্যথার কী অবস্থা? বলে ভালো লাগছে এখন! তারও কিছু পরে ওদের বাবার সময় হলো ওষুধ নিয়ে আসতে। এদের এর মাঝে দুপুরের খাবার খেয়ে নিতে বললাম! আমি হাতের পাশে যা পাচ্ছি, খেয়ে নিচ্ছি। মেয়ে দুর্বল ফিল করছে। কাশছে, তবে ভালো যে জ্বর নেই, আমার মতো শরীরব্যথায় ভুগছে না। তবে সুবিধা হচ্ছে, বেনজি! বেনজি, আমাদের বিড়াল। খারাপ লাগলে বেনজির মাথায় হাত বুলিয়ে নিজেরা ভালো ফিল করছে, সঙ্গে বেনজিও খুশি থাকছে! বেনজি এ সময় বড় মেন্টাল সাপোর্ট ওদের জন্য।

আজ কারও সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে নাই। ফোন তো বন্ধই রাখি! চেক করেও যোগাযোগ করার ইচ্ছে হলো না। দেখি বাবার বাসায় একটা ফোন দিতে হবে। গতকাল কথা বলা হয়নি! ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। উঠে বুঝতে পারলাম, ওনাদের ঘুমানোর সময়ে বিরক্ত করা উচিত নয়! সময় ধরে কাজ করার বদ-অভ্যাস হয়ে গেছে।

কীভাবে ডিনারের সময়ও চলে এসেছে, যে যার মতো কিছু নিয়ে খেয়ে নিচ্ছে। মায়ের বাসায় আবার রান্না হচ্ছে। আমি আজ ঠিকমতো খাচ্ছি না বলে, সে তার শাশুড়িকে রাঁধতে বলেছে। ভাগ্যিস ওনার শাশুড়ি কাছাকাছি থাকেন! আমার শাশুড়ি থাকলে আর খেতে হতো না! তার চেয়ে সহজ হতো অর্ডার দিয়ে খাবার আনায়। সময়মতো পাওয়া যেত! আসলে আমার শ্বশুর তার বউকে রান্নাবান্না করতে তেমন দেননি, নিজেই করতেন। শাশুড়ি জানেনও না তাঁর স্বামী-সন্তানেরা তাঁকে কতটা আগলে রেখেছিলে! লাকি উইমেন। তবে ওনার যে গুণটা আমার ভীষণ পছন্দ, পড়াশোনা করতে দেখলে কখনোই বিরক্ত করতেন না। আমরা সিনেমা দেখতাম অনেক, নিজে থেকেই হাতে সিনেমার জন্য পয়সা দিয়ে দিতেন! অনেক সময় নিজেই পয়সা দিয়ে বলতেন, ‘যাও তোমরা সিনেমা দেখে আসো। আর হলে গিয়ে সিনেমা! থিয়েটার আর কখনো কি খুলবে? তবে ভাগ্যিস ইন্টারনেটে হাজারো সাইটে যার যেমন চাই—নাটক, সিনেমা, ডকুমেন্টারি দেখতে পায়!

আসলেই যদি ইন্টারনেট না থাকত... এ মহামারি আমরা কীভাবে মোকাবিলা করতাম?

সবার হাতে হাতে ফোন, বন্ধুবান্ধবদের দেখা নেই, তবে ভার্চ্যুয়ালি কন্সটান্টলি দেখা এবং কথা হচ্ছে—সেটাও একটা বিশাল ব্যাপার!

২০-২১ বছর আগেও ফোন ছিল লাক্সারি। মোবাইল ছিল স্ট্যাটাস সিম্বল। মেইল ছিল না তেমন, ডাকঘরের চিঠি আসতে মাস চলে যেত! ফোনে খেজুরে গল্প, ভাবাই যেত না। বিকেল বা সন্ধ্যায় বন্ধুবান্ধবীদের সঙ্গে দেখা না হলে জীবনটাই পানসে মনে হতো! সপ্তাহখানেকের আগে কেউ কাউকে কোনো তথ্যই পৌঁছাতে পারত না! আর আজ? পাঁচ মিনিট ফোন হাতে না থাকলে সব খালি লাগে। সবাইকে এত অ্যাভেইলেবেল থাকতে হয় যেন, জীবন থেকে মুহূর্তগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।

আর কাজ?

আগে না হয় বলা যেত, মনে ছিল না, ভুলে গেছিলাম, সামনের সপ্তাহে করে দিচ্ছি!

এখন?

তোমাকে রাত ১২টায় মেইল পাঠিয়েছি, ইস্টার্ন টাইম, সেন্ট্রাল টাইম বা হোয়াটএভার টাইম, সেটা তোমার মাঝরাত পেরোলেও আমার সন্ধ্যা। মেইল চেক করো নাই? এমন গাফিলতি কীভাবে মানা যায়? প্লিজ এখনই কাজটা করে দাও। হয়তো তুমি এখনো ঘুম থেকেও ওঠনি, তবে আমার এখনই রিপ্লাই চাই!

সবচেয়ে বিরক্তকর হয়, যখন দেখি ল্যাপটপসহ ক্লিনিকে। পাঁচ মিনিট সময় ডাক্তারের জন্য বসে থাকতে হলেও কাজ করতে থাকে, অফিশিয়াল ফোনে ব্যস্ত থাকে! নিজেদের বলে আমাদের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই! সারাক্ষণই ব্যস্ত, ব্যস্ত জীবনের দায়ভার মেটাতে। আমি জীবনের পরিক্রমায় বিবর্তন দেখে যেতে থাকি। তবে সুবিধা যে সে এনে দিয়েছে, সেটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। চলবে...