পরাজিতের বিজয় হাসি

টেলিফোনের মনিটরে বেয়াই সদরুল খানের নাম ও নম্বর দেখে একটু অবাক হলেন আলী আযম খান। আলী আযম খানের অবাক হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। তবু হলেন। ফোন ধরবেন কী ধরবেন না, এ নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন কয়েক সেকেন্ড। কারণটা হলো সদরুল খান সপরিবারে বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়েছেন। এখনই তাদের আসার কথা নয়। দেয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তাদের আসার সময় এখনো হয়নি। আরও ১৫ দিন বাকি। তবে কি তারা আগেই ফিরে এলেন? আগে ফিরে আসায় কোনো অসুবিধা নেই, কিন্তু তাকে তো কেউ কিছু জানায়নি। তারা দেশে যাওয়ার পর আলী আযম মাঝেমধ্যে সদরুল খানদের বাসায় গিয়ে দেখে এসেছেন সবকিছু ঠিক আছে কি না। বিশেষ করে লেটার বক্সটি খুলে সব চিঠি ঘরে রেখে এসেছেন এবং মাঝেমধ্যে ফোনে বলেছেন কী কী চিঠি এসেছে। গতকালও আলী আযম কাজটি করেছেন।
সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব পরিত্যাগ করে আলী আযম রিসিভার কানে নিলেন। সেই চিরাচরিত রাশভারি চাতুরিপূর্ণ সদরুল খানের সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর।
‘আসসালামু আলাইকুম বেয়াইসাব, ভালো আছেন?’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহ, জি, আমি ভালো আছি, আপনি ভালো? কিন্তু...।’
‘আমার ফোন দেখে অবাক হলেন, এই তো?’ সদরুল খানের মোলায়েম সুর। খুব শান্তভাবে তিনি কথা বলেন। রাতের বেলা সানগ্লাস পরে থাকার মতো, যাতে চোখের ভাষা কেউ বুঝতে না পারে।

‘একটু অবাকই হলাম বটে। আপনাদের না আরও ১৫ দিন পরে আসার কথা? এখনই যে চলে এলেন? আপনি একা এসেছেন নাকি সবাই এসেছে?’

‘আমি একাই এসেছি। ওরা সবাই নির্ধারিত সময়েই আসবে।’ বললেন সদরুল খান।

একটু কাঁচুমাচু করলেন আলী আযম, তারপর বললেন, ‘কোনো সমস্যা?’

‘না, তেমন কোনো সমস্যা না। দেশে কী এক রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করেছে, কারা কারা নাকি আমার নামের সঙ্গে মিল আছে, এমন একটা নাম দেখেছে। সেটা শুনে মনে করলাম, আর দেশে থাকা নিরাপদ নয়। বোঝেন না, কোন দিকের বিপদ কোন দিকে গড়ায়। আমরা থাকি আমেরিকা। এটাই আমাদের জন্য নিরাপদ দেশ।’ কথাগুলো বলতে গিয়ে কেমন যেন মিইয়ে গেলেন সদরুল খান।

চমকে উঠলেন আলী আযম। কয়েক দিন ধরে এমন একটি খবর তিনিও শুনে আসছেন। রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করার পর ভেতরে–ভেতরে তিনি যেন বেশ ভয়ে আছেন। কিন্তু নিজের দুর্বলতা তো প্রকাশ করা যাবে না। প্রায় অর্ধশত বছর পার হয়ে গেছে, আড়ালে–আবডালে নানান জনে নানাভাবে নানা কথা বললেও কোনো প্রমাণ আজ পর্যন্ত কোনো বাপের বেটা দাঁড় করাতে পারেনি। এখন এসব প্রকাশ করে মানুষের মানসম্মান নিয়ে টানাহেঁচড়া করছে সরকার।

নিজেকে শক্ত করলেন আলী আযম। যেভাবে অর্ধশত বছর ধরে শক্ত রেখেছেন। কেউ কোনো অভিযোগের আঙুল তুললে তাকে গর্তে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। কেউ বেশি বাড়াবাড়ি করলে পরকালের টিকেট দিয়ে দিয়েছেন আর এখন কাগুজে তালিকার কাছে নতজানু হলে চলবে কেন? বেয়াইয়ের কাছে যেন কোনোভাবেই নিজের দুর্বলতা প্রকাশ না পায়, সে জন্য নিজেকে শক্ত করে আলী আযম বললেন, ‘রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করলে তাতে আপনার ভয় পাওয়ার কারণ কী, সেটা তো বুঝলাম না বেয়াইসাব। আর সে ভয়ে আপনি ১৫ দিন আগেই চলে এলেন?’

কোনোভাবেই যাতে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ না পায় সেদিকে কঠোরভাবে নজর দিয়ে, একটু ঢোঁক গিলে সদরুল খান বললেন, ‘কীভাবে আপনাকে বোঝাই, আপনাদের–আমাদের জমানা আর এখনকার জমানার মধ্যে আকাশ–পাতাল তফাত। এখনকার ছেলেপুলেরা কী নেট না যেন কী ঘাঁটাঘাঁটি করে দুনিয়ার সব তথ্য বের করে ফেলে, একদিন শুনবেন...।’ একটু থামলেন আলী আযম।
‘বলুন বেয়াইসাব! তারপর?’
‘তারপর আবার কী? কীভাবে যে আপনাকে বলি?’
‘বলুন, আমাকে বলতে আপনার দ্বিধা কেন? আমি আপনার বেয়াই, আমার কাছে কোনো কথা বলতে আপনার সংকোচ হওয়ার কথা নয়।’
‘না মানে, আমি দেখিনি। কারা কারা পত্রিকায় রাজাকারের নামের তালিকায় আপনারও নাম দেখেছে। গ্রামের লোকেরা তা নিয়ে বলাবলি করছিল। আমি কয়েকজনকে বলেছি, এসব পুরোনো বিষয় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করাই ভালো। তোমাদের অনেকের তো সে সময় জন্মই হয়নি। কে শোনে কার কথা? তারপর তো আমি চলেই এলাম।’

পাহাড় ভেঙে যেন আলী আযমের মাথায় পড়ল। মাথায় একটা চক্কর মারল। যদি দাঁড়ানো থাকতেন, তাহলে হয়তো পড়েই যেতেন। তবে কি জীবনের শেষ বয়সে এসে সব ফাঁস হয়ে যাবে? যদিও তিনি নিরাপদ দূরত্বে আছেন। সরকার কেন, সরকারের বাপের বাপেরও সাধ্য নেই তাকে এখান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। নিজেকে সামলে নিলেন আলী আযম। কিছুক্ষণ ভেবে নিলেন গত অর্ধশতকের কথা। কত আইন হলো আর কত আইন বৃষ্টির পানির মতো ভেসে গেল। এই রাজাকারের তালিকাও ইঁদুরে খেয়ে ফেলবে। ইতিমধ্যে বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে। খোদ মুক্তিযোদ্ধাদের রাজাকারের তালিকায় ঢোকানো হয়েছে। আনাড়ি তালিকা প্রণয়নকারীরা জানে না যে অন্তরালে কারা কলকাঠি নাড়ে।

আপাতত ফোন ছেড়ে দিলেই যেন বাঁচেন আলী আযম। কিন্তু কথা না বলে ছাড়েন কী করে? তাহলে সদরুল খান ভাববে কোথাও গণ্ডগোল একটা আছে। কিছুতেই কিছু বুঝতে দেওয়া যাবে না। অনেকটা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আলী আযম বললেন, ‘ওই যে প্রথম দিকেই যেটা বললেন বেয়াইসাব, আজকালকের ছেলেপুলেগুলো...। একাত্তরে যাদের জন্মই হয়নি তারা কী করে জানবে যে কে মুক্তিযোদ্ধা আর কে রাজাকার ছিল? আন্দাজের ওপর একটা কিছু বলে দিলেই হলো?’

নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ এবং ধোয়া তুলসীপাতা প্রমাণের জন্য আলী আযম কৌশলের আশ্রয় নিলেন। সদরুল খানকে যদি কোনো প্রকার দোষারোপ করা যায়, তাহলে নিজের ব্যাপারটা ঢাকা পড়ে যাবে। তিনি আবার বললেন, ‘যা–ই বলুন বেয়াইসাব, আপনি তাড়াতাড়ি চলে আসায় অনেকেই কিন্তু সন্দেহ করবে। কেন রাজাকারের তালিকা প্রকাশ হওয়ার পরপরই ১৫ দিন টিকিটের সময় থাকতে সদরুল খান আমেরিকা চলে গেলেন? আপনার উচিত ছিল বিষয়টা মোকাবিলা করে আসা।’

আলী আযম খানের কথা শুনে রাগে সদরুল খানের গা ঘিনঘিন করতে লাগল। এ যেন স্বেচ্ছায় ধরা দেওয়া আরকি। গত ৫০ বছরে কেউ তার একগাছি বাঁকা চুল সোজা করতে পারল না, আর একটি রাজাকারের তালিকা করে লোম ছিঁড়বে? কিন্তু রাগ হলে তো চলবে না। আলী আযমকে চাপের মধ্যে রাখতেই হবে। তা না হলে সে কেঁচো খুঁড়ে সাপ বের করে আনবে। যা রটে তার কিছু না কিছু তো ঘটেই। তাই কৌশলী হলেন সদরুল খান। অনেকটা নিজেকে ধিক্কার দিয়েই বললেন, ‘আমি শালা একটা ভুলই করেছি। পত্রিকাটি সঙ্গে করে নিয়ে এলেই তো পারতাম। সেখানে শুধু নামই নয়, বিস্তারিত ঠিকানাও ছিল। তাহলে কোনটা গুজব আর কোনটা সত্যি প্রমাণ হয়ে যেত।’

ধাক্কা খেলেন আলী আযম। নেতার নাম স্মরণ করলেন, তার উপদেশ স্মরণ করলেন। যখন দেখবে তোমার গোপন কথা ফাঁস হয়ে যাচ্ছে, তখন নীরবতা পালন করবে, দেখবে পরিস্থিতি একসময় এমনিতেই শান্ত হয়ে গেছে।

নিজেকে সামলে নিলেন আলী আযম। রাবার যত টানাটানি করা হয়, তা তত বাড়ে। এসব কথা নিয়ে তর্কে লিপ্ত হলে নিজের অজান্তেই সত্যটা বের হয়ে যেতে পারে। যদিও তিনি এখন বাংলাদেশের সব আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে আছেন। প্রসঙ্গ পাল্টে আলী আযম বললেন, ‘তা বেয়াইসাব, আমরা বোধ হয় অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে জড়িয়ে যাচ্ছি, সেসব বাদ দিয়ে কাজের কথায় আসি।’

হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন সদরুল খান। কাউকে চাপের মধ্যে রাখতে গিয়ে নিজেই কখন না আবার চাপের মধ্যে পড়েন। স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে সদরুল খান বললেন, ‘সেটা ঠিকই বলেছেন। যেটা হয়ে গেছে, সেটা নিয়ে টানাটানি না করাই ভালো। তা বলুন, আপনার শরীরের অবস্থা কেমন?’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আপনার কেমন?’
‘আছি আপনার দোয়ায় একপ্রকার। তবে দেশে গিয়ে প্রেসার বেড়ে গিয়েছিল। এখন কন্ট্রোলে আছে।’

মনে মনে আলী আযম বললেন, তোমার প্রেসার বাড়বে না তো আমারটা বাড়বে? ধরা তো জায়গামতোই খেয়েছিলে। পালিয়ে এসে এখন বাঁচলে।

আলী আযম বললেন, ‘একটু বিশ্রাম নিয়ে বাসায় চলে আসুন একদিন। সামনাসামনি বসে গল্প করব।’

সদরুল খান জবাব দিলেন, ‘আমাদের বাসা যে একেবারে খালি, আপনিই বরং চলে আসুন। সারা দিন থাকবেন। বাসায় রান্না করব, সারা দিন গল্প করব।’

‘সেটা অবশ্য খারাপ বলেননি। আজ তাহলে রাখি বেয়াইসাব।’

দুজনেই লাইন কেটে দিলেন।

সদরুল খান তার মেয়ের স্পন্সরে এবং আলী আযম খান তার ছেলের স্পন্সরে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন। লস অ্যাঞ্জেলেসের লিটল বাংলাদেশ এলাকায় তারা বসবাস করেন। দুজনের বয়সই ৭০–এর বেশি। তারপরেও তারা দুজনেই শারীরিকভাবে বেশ সুঠাম আছেন।

ফোনের লাইন কেটে দিয়ে সোফায় আরাম করে বসলেন আলী আযম। ফিরে গেলেন সেই একাত্তরে। একাত্তর এসেছিল বলেই না জীবনে কত অপ্রত্যাশিত জিনিস এসেছিল। কলেজের ক্লাসফ্রেন্ড অরুণার নাদুসনুদুস শরীরটার কথা এখনো তার মনে পড়ে। যুদ্ধের আগে মাথা তুলে তার দিকে তাকালেও সে ফোঁস করে উঠত। আর যুদ্ধ যখন বেধে গেল, আহ! কী মজা...। কতবার তার পায়ে ধরে মাফ চেয়েছিল। ও যখন কাতর হতো, তার শরীরটা তেতে উঠত। আশপাশে আরও কতজনকেই না বাগে এনেছিলেন। একাত্তর না এলে তার ধনসম্পত্তি তো এত বাড়ত না। আহ! সুবলের মায়ের কুঁড়েঘরটা। একটু আগুন লাগিয়ে দিতেই চোখের সামনে ছাই হয়ে গেল। যেন আগে থেকেই তার দেওয়া আগুনের অপেক্ষা করছিল। একটু হুমকি–ধমকি অবশ্য দিয়েছিলেন, দেশ ছেড়ে ওরা দাদার দেশে চলে গেল। তাদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তির মালিক হলেন তিনি। এসবই তো একাত্তরের অবদান। আর কখনো কি একাত্তর ফিরে আসবে জীবনে?

আলী আযমের সঙ্গে কথা শেষে সদরুল খান মনে মনে বেশ শক্ত অবস্থান নিলেন। বেয়াই হোক আর যা–ই হোক, সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো নিজেকে বরাবরের মতোই অটুট রাখতে হবে। কোনো রকম দুর্বলতা পেলে সবকিছু কমিউনিটির লোকজনের কাছে বলে দিয়ে বারোটা এমনকি চৌদ্দটা বাজাতে পারে। আলোর বিপরীতে যেমন অন্ধকার, তেমনি রাজাকারের বিপরীত হলো মুক্তিযোদ্ধা। এই মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টি ধারণ করে এখানে যে পরিচিতি লাভ তিনি করেছেন, সেটা হারানো যাবে না। যদিও তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কেউ স্বীকার করে না, তবু মুক্তিযোদ্ধার বিপরীত শব্দ পর্যন্ত কেউ যেতে পারে না। তার আগেই মিলিয়ে যায়। কেউ কেউ মনে করে, তিনি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু তাকে রাজাকার বলার সাহস পায় না। আর ভুয়াদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে সব সুবিধা ভোগ করে আবার তারাই বলে ভুয়া। সব নাবালকের খেলা আরকি। এই খেলাও মিলিয়ে গেল বলে।

মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা ঠান্ডা মাথার লোক এবং সময়-সুযোগ হলেই কেবল তারা তাদের আসল রূপে ফিরে আসে, সেটা এর আগে বহুবার তারা প্রমাণ করে দেখিয়েছে। এবার রাজাকারদের তালিকা প্রণয়নের সময় তারা তার প্রমাণ দেখাবে, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। একজন মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষা করে জীবন চালালেও রাজাকারকে কিন্তু সে পরিণতি ভোগ করতে হয়নি। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরাই একাত্তরের পরে বিত্ত–বৈভবের অধিকারী হয়েছে। কী করে সেটা সম্ভব হলো, তা কেউ জানে না।

রাজাকারের তালিকা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে একাত্তরের প্রেতাত্মারা আবার অট্টহাসি দিল। সে হাসিতে লজ্জা পেল পুরো জাতি। অনেক মুক্তিযোদ্ধাকেই রাজাকারের তালিকায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারা এমন কাজ করল বা করার সাহস পেল, তা কেউ জানে না। জাতি শুধু জানল শর্ষের মধ্যেই ভূত। সে ভূত নতুন নয়, অনেক পুরোনো ভূত। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার টানা ১১ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকার পরেও সে ভূত দূর করা গেল না। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, তারা আরও পরিপুষ্ট হয়েছে। ভোল পাল্টালেও ভেতরটা একই রকম রয়ে গেছে। আমের ওপরটা দেখে কি বোঝা যায়, ভেতরে পোকা হতে পারে?

অবশেষে রাজাকারের তালিকা বাতিল করা হলো। আবার লজ্জা পেল জাতি। জাতির লজ্জা পাওয়ার কারণ কী? কারণ, সে তালিকায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের রাজাকার বানানো হয়েছে। তালিকা বাতিল করলেই কি সমাধান হয়ে গেল? না। তা হবে কেন? তালিকা বহাল রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম বাদ দিলেই তো হতো, নয় কি? তাহলেই তো রাজাকারদের নামটা তালিকায় থাকত। পুরো তালিকা বাতিল হওয়ার ফলে রাজাকাররাও রেহাই পেয়ে গেল না?

বাংলাদেশের টেলিভিশনে রাজাকারের তালিকা বাতিলের খবর দেখে আনন্দে ফেটে পড়লেন সদরুল খান। আনন্দে তার নৃত্য করতে ইচ্ছা করছে। কাজের কাজ হয়েছে একটা। পরম করুণাময়ের কাছে কৃতজ্ঞতা না জানিয়ে পারছেন না তিনি। কী যে ভয় পেয়েছিলেন! পুরো তালিকা বাতিল। তালিকা প্রণয়নকারীদের জন্য দুহাত তুলে দোয়া করলেন সদরুল খান। যদিও তিনি জানেন যে কারা এ মহান কাজটি করেছে। এভাবে তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম না ঢোকাতে পারলে তালিকা বাতিল করা যেত না। একবার জনসমক্ষে রাজাকার হিসেবে নাম এলে কী ভয়ানক বিপদই না হতো! খবরটা আলী আযমকে দেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে আছেন সদরুল খান।

ফোনের রিসিভার হাতে নিলেন সদরুল খান। এখন লস অ্যাঞ্জেলেসে সকাল ১০টা। বাংলাদেশে রাত ১২টা। একটু আগেই বেসরকারি একটি চ্যানেলে খবরটা দেখাল। রিসিভার হাতে নিয়ে আলী আযমকে ফোন করবেন বলেও করলেন না। নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে ফোন করলে যদি সে কিছু বুঝে ফেলে! যদি প্রশ্ন করে আমি এত আনন্দিত কেন? থাক। দেখি সে করে কি না? রিসিভার রেখে দিলেন সদরুল খান। খবরের বাকি অংশ দেখতে লাগলেন তিনি।

ফোন বেজে উঠল। টিভি অফ করে দিলেন সদরুল খান। আলী আযম খান ফোন করেছেন। তাহলে খবর পেয়ে গেছেন এতক্ষণে? পাক্কা রাজাকার। ...ভাবভঙ্গিতেই সেটা বোঝা যায়।

সালাম দিয়ে নিজের অজান্তেই অট্টহাসি দিলেন সদরুল খান। তারপরেই শান্ত হয়ে গেলেন। নিজের গালে নিজেই থাপ্পড় মারতে ইচ্ছা করছে তার। হাসলাম কেন আমি? ...তো সব বুঝে যাবে।

সালামের জবাব দিয়ে আলী আযমও অট্টহাসি দিলেন। সালামের জবাব দিলেন। তবে কিছু জানানোর আগেই আলী আযম কেন হাসলেন বুঝতে পারলেন না সদরুল খান। যদিও সদরুল খানের হাসার কারণ বুঝতে পেরেছিলেন আলী আযম। ও তো একটা চিহ্নিত রাজাকার। এখানে এসে মুক্তিযোদ্ধার খোলস পরেছে। নিজের বেয়াই বলে কথা। লোকের কাছে বললে নিজেরই অপমান।

কয়েক সেকেন্ড কেটে গেল। কেউ কোনো কথা বলছেন না। তাদের অট্টহাসি যেন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ তারা দুজনেই সব ভান-ভণিতা ভুলে গেলেন। কেউ কাউকে দোষারোপ করা বা সন্দেহ করাও ভুলে গেলেন। এ এক বিজয়। বিরাট বিজয়। এ বিজয়ের সময় ভণিতা মানায় না।

‘খবর কিছু পেলেন বিয়াইসাব?’ প্রশ্ন করলেন আলী আযম।
‘পেলাম তো। একটু আগেই বাংলাদেশের টিভিতে দেখাল। আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ যা করেন তা বান্দার মঙ্গলের জন্যই করেন। মনে মনে যা ভয় পেয়েছিলাম না? এই বয়সে আত্মীয়স্বজনের কাছে মান–ইজ্জত বলতে আর কিছু থাকত না।’

‘ভয় কিন্তু আমিও কম পাইনি বেয়াইসাব। আপনি আপনজন, আপনার কাছে বলতে বাধা কীসের। সে জন্যই ১৫ দিন আগে চলে এলাম। আমাকে দলের একজন শীর্ষ নেতা ফোন করে বললেন আমি যেন তাড়াতাড়ি আমেরিকা চলে যাই।’ কথাটা বলেই জিবে কামড় দিলেন সদরুল খান।

ফোনের অন্য প্রান্তে আলী আযম সামনে–পেছনে মাথা ঝাঁকালেন। মনে মনে বললেন, তোমার সব কীর্তিকাণ্ড আমি জানি। ভণিতা করে কোনো লাভ হবে না।

সদরুল খান আবার বললেন, ‘দেখলেন তো ওস্তাদের মার কাকে বলে? আজকালকার বাচ্চারা, যাদের এখনো আক্কেলদাঁতই ওঠেনি, তারা করবে রাজাকারের তালিকা? আরে বেটারা, রাজাকারের আসল অর্থ জানিস তোরা?’
কথাটা বেশ পছন্দ হলো আলী আযমের।

‘ঠিকই বলেছেন।’ জবাব দিলেন আলী আযম।

‘আজ দুপুরেই আমার বাসায় চলে আসবেন বেয়াইসাব। গরুর ভুনা গোশত পাক করব। খেতে খেতে আপনাকে সব বলব, কীভাবে কী করেছি।’

তালিকা বাতিলের ব্যাপারে বেয়াইকে কি কিছু কৃতিত্ব দেখাতে চায় সদরুল খান?

‘ঠিক আছে আসব।’ জবাব দিলেন আলী আযম খান।

আবার একসঙ্গে অট্টহাসি দিলেন দুজনই।