চীনের শিক্ষাব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকা

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

বর্তমান বিশ্বের বিস্ময় গণ চীন। কি অর্থনৈতিক, কি রাজনৈতিক, কিংবা সামরিক—সব দিকেই পৃথিবীর প্রথম সারিতে চীনের অবাধ বিচরণ। যে চীন কে নিয়ে এত কথা, এত আগ্রহ তাদের শিক্ষাব্যবস্থা আসলে কেমন? ধারাবাহিক লেখার প্রথম পর্বে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাস্তর পর্যন্ত আলোচনা হয়েছে। আজকের পর্বে থাকছে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে আলোচনা। তৃতীয় পর্বে থাকবে চীনে বিদেশিদের জন্য উচ্চশিক্ষা এবং শিক্ষকতা পেশার সুযোগ নিয়ে। লেখাটি তাঁদের জন্য, যাঁরা চীনের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে জানতে আগ্রহী। চীনের শিক্ষাব্যবস্থা কেমন? আমাদের সঙ্গে তাদের মূলত কী কী পার্থক্য রয়েছে?

‘দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা’র শুরুতে, চীনের শিক্ষা সংস্কারের জন্য ১০টি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিল। সংস্কারের বিষয়বস্তুগুলো সব স্তরের মূল ক্ষেত্রগুলো এবং শিক্ষার মূল গঠনগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে। যেমন: ‘কেনো শিক্ষাজীবনে প্রবেশ কঠিন’ এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ‘বই, অনুশীলনের ভারী বোঝা’র মতো মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের দিকে মনোনিবেশ করে এবং সামগ্রিক পরিকল্পনা ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের নীতি অনুসরণ করে। সংস্কারের প্রধান বিষয়বস্তুগুলো তাদের দৃঢ় সংকল্প এবং ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন নিশ্চিতও করে থাকে।

চীনের কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষাসংস্কারে আরও গভীর, বাস্তবসম্মত এবং ১০টি পাইলট প্রোগ্রাম চালু করার জন্য সংকল্পবদ্ধ। দশটি পাইলট প্রোগ্রামের কিছু কাজ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যেমন—

তিনটি প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্রিক—
১.
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার বিকাশকে ত্বরান্বিত করা
২.
বাধ্যতামূলক শিক্ষার সুষম বিকাশের প্রচার করা
৩.
প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক বোঝা হ্রাস করার উপায়গুলো অন্বেষণ ও বাস্তবায়ন।

তিনটি উচ্চশিক্ষার প্রোগ্রাম—
১.
বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষায় প্রতিভা প্রশিক্ষণের মডেলটিকে সংস্কার করা
২.
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চলমান মডেল
৩.
একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ব্যবস্থা নির্মাণ।

আর বাকি চারটি বৃত্তিমূলক শিক্ষার—
১.
বর্তমান বৃত্তিমূলক স্কুল মডেলটির সংস্কার
২.
বেসরকারি শিক্ষার বিকাশের পরিবেশ উন্নতি
৩.
শিক্ষক পরিচালনব্যবস্থার উন্নতি
৪.
শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি সাধন।

এখন আসুন দেখি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রগুলো
বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষা:
জাতীয় নবম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময় উচ্চশিক্ষার উন্নয়ন ও সংস্কারের লক্ষ্যে, ‘প্রকল্প ২১১’ প্রস্তাব করা হয়েছিল। এটি ২১ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, প্রায় ১০০টি বিশ্ব টপ র‌্যাঙ্কিং বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ এবং বেশ কয়েকটি মূল বিজ্ঞান শাখার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। মাধ্যমিক শিক্ষার পরে কলেজ, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা শুরু হয় তাদের। চীনে উচ্চশিক্ষা বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলো হলো বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ এবং উচ্চশিক্ষার কলেজ। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তিনটি প্রধান কাজ রয়েছে—
১. পাঠদান,
২. বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং
৩. সামাজিক পরিষেবা

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

সারা চীনে ১ হাজার ৩০৬টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৭২টি বেসরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোতে প্রায় ১০ লাখ শিক্ষক এবং ৪৫ লাখ শিক্ষার্থী আছেন। পাশাপাশি সর্বমোট ৭১৮টি সরকারি বয়োবৃদ্ধ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়, ৪টি বেসরকারি প্রাপ্তবয়স্ক কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় এবং ২ লাখ শিক্ষক রয়েছে। প্রসঙ্গত, বিশ্বের টপ ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে চীনের ৮টি (হংকং ৪) বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এশিয়ার প্রথম ৫০০টির মাঝে শুধু চীনেরই ৮১টি বিশ্ববিদ্যালয় (জাপান ১১০)।

ছাত্রছাত্রীরা গাও কাও (ভর্তি পরীক্ষা) দিয়ে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সুযোগ পান। এই ভর্তি পরীক্ষা দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পরিচালিত সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একই মাপকাঠির একটি পাবলিক পরীক্ষা। ১৪০ কোটির জনসংখ্যার দেশে একটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হিমালয় জয়ের থেকে কম তৃপ্তিদায়ক নয়। পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে পছন্দমতো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলেও অনেক সময় পছন্দমাফিক বিষয় না পাওয়ার দরুন অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয়। তারপর শুরু হয় আরেক যুদ্ধ। অনার্স প্রথম এবং দ্বিতীয় বর্ষে ছাত্রছাত্রীরা খুব কম অলস সময় পান। সপ্তাহে প্রতিদিন ক্লাসসহ প্রায় ২১ থেকে ২২টি ক্লাস ঘণ্টা থাকে, যেটা তৃতীয় বর্ষে এসে খানিকটা কমে যায়। চতুর্থ বর্ষে প্রথম সেমিস্টারে ছাত্ররা ২-৩টা বিষয় নিয়ে থাকেন আর শেষ সেমিস্টার ইন্টার্ন ও থিসিসের জন্য। আমাদের দেশে যেমন আমরা মাস্টার্সে এসে থিসিস লেখা নিয়ে কিছুটা ধারণা লাভ করি, চীনারা অনার্সে এসেই সেটা করে। সম্ভবত এ জন্যই ভালো ভালো জার্নালে পাবলিকেশনের সংখ্যার দিক দিয়ে এরা বিশ্বে প্রথম।

অনার্স শেষ করার পর আবার ভর্তির যুদ্ধ শুরু হয়। এবারের যুদ্ধ ভালো একটা ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্সে পড়ার সুযোগ পাওয়ার যুদ্ধ। যদিও অনেক ছাত্র অনার্স শেষ করার পর আর মাস্টার্সে যায় না, তাই তুলনামূলকভাবে এই যুদ্ধ সহজ। মাস্টার্স সাধারণত ২-৩ বছরের হয়। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ডিগ্রির জন্য থিসিসের পাশাপাশি ভালো জার্নালে পাবলিকেশন আবশ্যিক। মাস্টার্স শেষ করার পর আবার ভর্তির যুদ্ধ পিএইচডির জন্য। সাধারণত যারা শিক্ষকতাকে পেশা অথবা একাডেমিশিয়ান হতে চান, তাঁরাই ওই পথে হাঁটেন। পিএইচডি ভর্তি পরীক্ষার জন্য কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। সেটার পরে যদি কেউ পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি করতে চান, সেটার জন্য একই ফিল্ডের প্রফেসর খুঁজে নিতে হয়।

অব্যাহত শিক্ষা
কন্টিনুয়েশন এডুকেশন বা প্রাপ্তবয়স্কদের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ, প্রাপ্তবয়স্কদের নন-একাডেমিক উচ্চশিক্ষা এবং সাক্ষরতার শিক্ষার আওতায় অন্তর্ভুক্ত। দেশজুড়ে ৪ লাখ ৬০ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক কারিগরি প্রশিক্ষণ স্কুলে সাড়ে ছয় কোটি শিক্ষার্থী; ৩ কোটি সাধারণ মানুষ বিভিন্ন ধরনের প্রাপ্তবয়স্ক নন-ডিগ্রি শিক্ষা সম্পন্ন করেন। পাশাপাশি প্রায় ৫০ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে, যাদের আনুমানিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় তিন কোটি।

পরিশেষে, আমরা দেখতে পাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থা আর চীনের শিক্ষাব্যবস্থার মাঝে বিশাল ফারাক। শুধু কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থায় যদি আমরা দেখি, চীনারা কারিগরি শিক্ষা দিয়ে এক–একজন উদ্যোক্তা (ছোট-বড়) বানায় আর আমরা ভোকেশনাল থেকে পাস করে চাকরি খুঁজে খুঁজে মরি। আবার, যেখানে বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ের প্রথম দিকে আমাদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই বরং যেন পেছনে যাচ্ছি আমরা, সেখানে চীন দিনে দিনে সংখ্যাটা বাড়িয়েই চলেছে। যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার এখন আমাদের সময়ের দাবি। সে জন্য বিদেশি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়, একাডেমিশিয়ান, দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষাবিদ থেকে পরামর্শ নিয়ে সেটার সফল বাস্তবায়ন অতীব দরকার। চলবে...

*লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, গুয়াংডং ইউনিভার্সিটি অব ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইকোনমিকস, চীন

*তৃতীয় পর্ব: বিদেশি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা, জীবন, চীনে শিক্ষকতা পেশা