গ্রীষ্মের ছুটি, ঈদ আর করোনায় গ্রিস ভ্রমণ

ভূমধ্যসাগরে ডুবছে সূর্য। ছবি: লেখক
ভূমধ্যসাগরে ডুবছে সূর্য। ছবি: লেখক

ইউরোপেই কাটল এবারের ঈদ আর গ্রীষ্মের ছুটি। ভেবেছিলাম ২৫ বছর পর প্রথমবার বাংলাদেশে পরিবারের সবাইকে নিয়ে কোরবানির ঈদ করব। তো সেভাবেই স্ত্রী তানিয়া আর আমি গ্রীষ্মের অবকাশকালীন ছুটির সময়টা পছন্দ করে রেখেছিলাম গত বছর থেকে। সে আর হলো কই! আমিরাত, কাতার, তুর্কি বা ব্রিটিশ এয়ারলাইনসসহ বিভিন্ন এয়ারলাইনসগুলো কোনোভাবেই আশ্বস্ত করতে পারছিল না বাংলাদেশে ভ্রমণের শিডিউল। পাওয়া হলো না পরিবারের সংস্পর্শ আর শ্বশুরবাড়ির জামাই আদর।

করোনাকালীন হোম অফিস আর ঘরবন্দী জীবনে হাঁপিয়ে ওঠা সময়ের ব্যাটারি রিচার্জ করা একেবারেই আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যেই ভাবা সেই কাজ। সুইস এয়ারলাইনসের ওয়েবসাইটে ঢুকতেই আমার মেম্বারশিপ পাতায় সবুজ সংকেত। এ করোনাকালীনও দুহাত বাড়িয়ে আমন্ত্রণ, ‘গ্রিস আপনাকে ডাকছে।’ ত্বরিতগতিতে ছোটখাটো একটা ত্রিমুখী কনফারেন্স হয়ে গেল তানিয়া ও মেয়ে জারার সঙ্গে। বের হয়ে এল কনফারেন্সের বটমলাইন সিদ্ধান্ত, গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে আমরা গ্রিসে যাচ্ছি। করপোরেট সোসাইটির চাকরি অনেকের মতো আমার ব্রেইনের হার্ডডিস্কটাও এমনভাবে তৈরি করে ফেলেছে যে একবার ফাইনাল ডিসিশন হয়ে গেলে যতক্ষণ না তা বাস্তবায়ন এবং চূড়ান্ত রূপ পাচ্ছে, ততক্ষণ আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না।

বলে রাখি, মিটিংয়ে সংসারের সিইও গিন্নির শর্ত ছিল ঘুম থেকে উঠেই জানালা খুললেই যেন সমুদ্র দেখা যায় এবং রাতে সমুদ্রের গর্জন শুনে ঘুমানো যায়—এ ধরনের হোটেল হতে হবে। সেই পথ ধরেই হয়ে গেল সুইস এয়ারলাইনসের টিকিট কাটা আর পাঁচ তারকা হোটেলের সুইট বুকিং। মা–মেয়ে তো ডিসিশন হতে না হতেই ছুটল শপিংয়ে। তৃপ্তির ঢেকুর তুলে লাগেজ গোছানোর কথা ভাবতেই কেমন জানি ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। যদিও লাগেজ গোছানো ওটা আমার ডিপার্টমেন্ট নয়। ম্যাডাম আলম এ ডিপার্টমেন্টের প্রধান হর্তাকর্তা। তবু দায়িত্ব বলে একটা কথা। করোনাকালীন ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ ভ্রমণ কতটা সংগত। আমি করপোরেট কায়দায় মাথায় হাত দিয়ে রিস্ক পরিমাপে বসে গেলাম।

অত্যাশ্চর্য ক্রেট গ্রিক দ্বীপপুঞ্জের বৃহত্তম এবং ভূমধ্যসাগরের পঞ্চম বৃহত্তম। এটি চমৎকার সৈকত এবং পর্বতমালা পরিবেষ্টিত। যেদিকেই তাকান, সমুদ্রের নীল রঙের জল আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে, জলকুমারী বলবে, আসো, আমার ঢেউ আর পানিতে একটু ভেসে বেড়াও। নির্লিপ্ত গ্রামগুলোর সঙ্গে সারি সারি জলপাইগাছ সবুজের এক লীলাভূমি।

লিটোস সমুদ্রসৈকতে এক উপাসনালয়। ছবি: লেখক
লিটোস সমুদ্রসৈকতে এক উপাসনালয়। ছবি: লেখক

ব্রোঞ্জ যুগে, এই সুন্দর দ্বীপটি মিনোয়ান সভ্যতার আবাস ছিল। এটি প্রথম উন্নত ইউরোপীয় সভ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়, তাই ক্রেটেও রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক আকর্ষণ। মিনোয়ান ধ্বংসাবশেষ ছাড়াও, আজও প্রাচীন গ্রিস, ভেনিজিয়ান যুগ এবং অটোমান আমলের নমুনা আজ অবধি দ্বীপের চারপাশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা অবশেষ দেখা যায়।

আরকাদি মঠটি হলো ক্রেটের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী। ১৮৬৬ সালে, তুরস্কের শাসনের অধীনে থাকা ক্রেটান বাসিন্দারা বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নেন। বিদ্রোহের সময় একপর্যায়ে, মঠটিতে ৯৪০ জনেরও বেশি গ্রিক, বেশির ভাগ নারী ও শিশু আশ্রয় নিয়েছিল। তুর্কিরা তিন দিন মঠটিতে অবরোধ করে রেখেছিল এবং অবশেষে এর দ্বারগুলোতে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। আশ্রয়প্রার্থীরা বন্দী হওয়ার পরিবর্তে তাদের জীবন শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং গোলাবারুদ দিয়ে নিজেদের উড়িয়ে দেয়, যার ফলে শত শত তুর্কি ও ক্রেটান নিহত হয়। এ ঘটনাটি ক্রেটবাসী মানুষের দুর্দশার প্রতি সহানুভূতি এবং বিশ্বব্যাপী মনোযোগ জাগিয়ে তুলেছিল। মঠটি, যা প্রায় দ্বাদশ শতাব্দী থেকেই এখানে এবং ১৮৩০ সালে পুনরুদ্ধার করা হয়। বর্তমান সময়ে আজও তুর্কি ও গ্রিস বিভিন্ন বিষয়ে কূটনৈতিক টানাপোড়েন চলছে।

আপনি যদি ক্রেট ভ্রমণ করেন এবং ক্রেট সম্পর্কে জানতে চান, তাহলে অবশ্যই আরকাদি মঠ, রিথিমন ওল্ড টাউন, অ্যাজিওস নিকোলোস, ইলাফোনিসি বিচ, স্পিনালোনগা, হেরাক্লিয়োন প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর, বালোস লেগুন, চানিয়া ওল্ড ভিনিশিয়ান হারবার, সামারাইয়ের জাতীয় উদ্যান, কননসোসের প্রাসাদ ভ্রমণ করতে হবে।

ক্রেট দ্বীপে ১২০০ বছরের পুরোনো একটি জলপাইগাছ। ছবি: লেখক
ক্রেট দ্বীপে ১২০০ বছরের পুরোনো একটি জলপাইগাছ। ছবি: লেখক

ক্রেটের সমুদ্রসৈকতগুলো অপলোক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। দ্বীপটির কৃষ্টি-সংস্কৃতি যেমনভাবে আপনাকে কাছে টানবে, তেমনি সাগর সৈকতের নোনাজলে পা ভেজানোর লোভ সামলানো আপনার জন্য বড়ই কঠিন হবে।

এই মহামারি দুর্যোগকালেও যে কটি দেশ পর্যটনশিল্পে এগিয়ে, নির্দ্বিধায় ইউরোপীয় দেশ গ্রিস তাদের মধ্যে অন্যতম। বোঝার অবকাশ নেই করোনাভাইরাস এ দেশের অর্থনীতির চাকা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো প্রায় থেমে গেছে। গ্রিস ইউরোপের অন্য দেশের তুলনায় করোনা মহামারির বেশ অগ্রগতি সাধন করেছে, গত ১৪ দিনে ১ লাখ বাসিন্দার মধ্যে গড়ে মাত্র ৩.৭ নতুন কোভিড-১৯ হদিস পাওয়া গেছে।

মহামারিতে পর্যটকদের কাছে গ্রিসকে আকর্ষণীয় করে তুলতে দেশটির পর্যটন মন্ত্রণালয় বেশ কিছু ভিন্নধর্মী উদ্যোগ নিয়েছে। আর তাই আমার মতো অনেক ভ্রমণপিপাসুর ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রটিতে করোনাকালীন গ্রীষ্মের অবকাশকালীন ছুটি কাটানোর ইচ্ছা আরও দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। ইদানীং গ্রিসের জাতীয় পর্যটন সংস্থা (জিএনটিও) দেশের বৃহত্তম ক্যারিয়ার, এজিয়ান এয়ারলাইনসের সঙ্গে মিলে এক প্রচারণা শুরু করে। ‘গ্রিস’ শিরোনামে এই প্রচারণা প্রতিপাদ্য স্লোগান হলো ‘গ্রিস, গন্তব্যের চেয়েও বেশি।’

আরকাদি মঠ। ক্রেট, গ্রিস। ছবি: লেখক
আরকাদি মঠ। ক্রেট, গ্রিস। ছবি: লেখক

‘গ্রিস’ শিরোনামে, নতুন প্রচার ৪২ সেকেন্ডের ভিডিওতে প্রখ্যাত সব গ্রিক ভ্রমণ স্পট এবং ভিডিওটি এমনভাবে বানানো, যা এক অনাবিল আবেগের সংমিশ্রণ ঘটায়, যেখানে প্রতিটি গন্তব্য পর্যটকেরা স্বাধীনতা, উচ্ছ্বাস, বিনোদন এবং স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করতে পারেন। এমনকি ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে, ‘পরের বার আপনি গ্রিসে ছুটি কাটানোর পরিকল্পনা করুন’—এই বাক্যাংশটি ভিডিওতে আছে, যা ভ্রমণকারীদের গ্রিসে গ্রীষ্মের অনন্য অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

গ্রিক পর্যটনমন্ত্রী হারিস থিওহারিস, দেশটির পর্যটন সম্পর্কে আশাবাদী। রেডিও স্টেশন প্যারাপোলিটিকা এফএমকে তিনি বলেন, প্রতি সপ্তাহ আগের সপ্তাহের তুলনায় ভালো এবং উৎসাহজনক। বর্তমানে গ্রিসের পরিস্থিতিতে তাঁর এই মন্তব্যের সঙ্গে আমার মতো অনেকেই সহমত পোষণ করবেন।

ক্রেট সৈকতে ভ্রমণপিপাসু বাংলাদেশি ফারজানা তানিয়া আলম। ছবি: লেখক
ক্রেট সৈকতে ভ্রমণপিপাসু বাংলাদেশি ফারজানা তানিয়া আলম। ছবি: লেখক

করোনাভাইরাস সুরক্ষাব্যবস্থার জন্য যাতে জরুরি পরিস্থিতিতে প্রত্যেক ভ্রমণকারীকে ট্র্যাক করা যায়, সে জন্য গ্রিস ভ্রমণ করতে হলে ভ্রমণকারীদের প্রস্থানের কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা আগে একটি ফরম পূরণ করতে হবে। এটি মুদ্রণ বা মোবাইল ফোনে ডাউনলোড করে একটি কিউআর কোড গ্রহণ করতে হবে। এই কিউআর কোড ছাড়া বিমান, স্থল বা নৌপথে গ্রিসে প্রবেশ নিষিদ্ধ। সবকিছু ঠিক থাকলে, গ্রিসে ২০২১ সালের শুরুতে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন বাণিজ্যিক বিক্রির জন্য পাওয়া যেতে পারে বলে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আশা করছে।

সরকারি কর্মকর্তাদের মতে, গ্রিসে ফেব্রুয়ারিতে প্রথম করোনা সংক্রমণ হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ৫ হাজার ৬২৩ জন সংক্রমিত হয়েছেন। জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির মতে, মৃত্যু ২১২ জনের।