সরিষা ফুল ও সরিষায় ভূত

কানাডার সাস্কেচেওয়ানের সরিষার খেত৷ সংগৃহীত
কানাডার সাস্কেচেওয়ানের সরিষার খেত৷ সংগৃহীত

প্রতিবছর ঘুরে-ফিরে শীত আসে। দেশের শীত সঙ্গে নিয়ে আসে হরেক রকমের ঋতুবাহারি ফুল, টক-মিষ্টি কুল, শজিনার ডাঁটা, নানান শাকসবজি, হাওর-বাঁওড়ের মাছ, পিঠাপুলি, নবান্নের ধান, খেজুরের রস ও পাটালি গুড়। বয়ে আনে উত্তুরে ঠান্ডা হাওয়া। সেই সঙ্গে নিয়ে আসে শুষ্কতা আর ঠোঁট ফাটা। কিন্তু সবচেয়ে আমার হৃদয়কে যে জিনিসটা খুব বেশি আকৃষ্ট করে, তা হলো শীতের অবারিত সরিষাখেত, হলুদে হলুদে ভরা শীতের সরিষা ফুলের মাঠ। এই সুদূর কানাডায় বসেও মানসচোখে দেখতে পাই দেশের সেই হলুদ চাদরে মোড়ানো সরিষা ফুলের খেত আর সুঘ্রাণ পাই সেই মাতাল হাওয়ায় হলদে ফুলের সুমিষ্ট গন্ধ, ছোঁয়া পাই হলদে আভার।
মনে পড়ে নবম শ্রেণিতে বায়োলজি ক্লাসে ফুলের অঙ্গব্যবচ্ছেদ করার সময় সরিষার ফুলকে আমরা বেছে নিয়েছিলাম। তখন দেখেছিলাম, হলুদ রঙের এই ফুলটিতে চারটি পেটাল বা পাপড়ি থাকে। জেনেছিলাম, একটি সরিষাগাছের জীবনধারায় আনুমানিক ২০০টির মতো ফুল ফোটে এবং একটি গাছ এক হাজার শস্যবীজ তৈরি করতে সক্ষম হয়। আরও জেনেছিলাম, সরিষাগাছ ক্রুশিফেরাস গোত্রের অন্তর্ভুক্ত তেল উৎপাদক একবর্ষজীবী প্রজাতির উদ্ভিত।

বাংলার অবারিত সরিষামাঠ৷ সংগৃহীত
বাংলার অবারিত সরিষামাঠ৷ সংগৃহীত


বাংলাদেশের কৃষক ভাইয়েরা রবি মৌসুমে অর্থাৎ মধ্য কার্তিক থেকে অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম সপ্তাহ (মধ্য নভেম্বর) পর্যন্ত সরিষার বীজ বপন করে থাকেন। শীতকালে ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে তাই গ্রামের মাঠে মাঠে হলুদের সমারোহ দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের দেশে কমবেশি সব জেলাতে সরিষার চাষ হলেও ঢাকা, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর, গাইবান্ধা ও পঞ্চগড় জেলায় পরিমিত পরিমাণের আবাদ হয়ে থাকে। আমাদের দেশে সরিষা দিয়ে ভোজ্যতেল তৈরি করা হয়। দেশের ঐতিহ্যগত ঘানির খাঁটি সরিষার তেল সবাই পছন্দ করে। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে, যখন দলবেঁধে কলুপাড়ার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতাম, দেখতাম চোখে পটি বেঁধে কলুর বলদ ঘানি বা কাঠের তৈরি দেশি তেলকল টেনে সরিষার বীজ থেকে খাঁটি তেল নিংড়াচ্ছে। তখন বুঝতাম না কেনই বা বলদের চোখে পটি বাঁধা হয়। আজকাল ঘানির বদলে বৈদ্যুতিক তেলকল চালু হয়েছে এবং বলদগুলো মাথা ঘোরার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।

আমার ধারণা ছিল, আমাদের দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে সরিষা উৎপন্ন হয় কিন্তু ধারণাটা ভুল ছিল। বাংলাদেশকে সরিষা আমদানি করতে হয়। কারণ, আমাদের প্রয়োজনমাফিক আমরা উৎপাদন করতে পারি না। নেপালও বাংলাদেশর চেয়ে অনেক বেশি সরিষা উৎপাদন করে। আমরা হয়তো অনেকে জানি, কানাডা বিশ্বের সর্বোচ্চ সরিষা উৎপাদনকারী দেশ। বিশ্বের মোট উৎপাদনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সরিষা উৎপাদিত হয় কানাডায়। এর পরেই ক্রমান্বয়ে আছে নেপাল, মিয়ানমার, ইউক্রেন, রাশিয়া, চেক রিপাবলিক, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র।
কানাডার আলবার্টা, সাস্কেচেওয়ান ও ম্যানিটোবা—এ তিনটি প্রদেশে মূলত সরিষা উৎপাদিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে রবি মৌসুমের শীতের সময় বিশেষ করে নভেম্বর ডিসেম্বের মাসে যখন ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকে, তখন যেমন সরিষার চাষ শুরু হয়। তেমনি কানাডায় গ্রীষ্মকালের শুরুতে মে-জুন মাসে ওই তিন প্রদেশে হলুদ সরিষাখেত দেখতে পাওয়া যায়।

নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার হরিশপুর মাঠে সরিষা৷ সংগৃহীত
নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার হরিশপুর মাঠে সরিষা৷ সংগৃহীত

টরন্টোর সন্নিহিত এলাকায় আমরা হলুদ আভার সরিষা ফুলের অবারিত মাঠ দেখতে পাই না। তাই খুব মিস করি দেশের শীতকালের মাঠের পর মাঠ হলদে আভার নয়নাভিরাম দৃশ্যপট। তাই টরন্টো বসে আলবার্টা কিংবা সাস্কেচেওয়ানের সরিষাখেতের কোনো ভিডিও কিংবা ক্যামেরায় বন্দী হওয়া কোনো স্থিরচিত্রের দৃশ্য দেখে প্রাণটা জুড়ায় না বা মনটাও তেমন করে কাড়ে না। বরং নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার হরিশপুর মাঠের দৃশ্য অথবা সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার রসুলপুর গ্রামের দৃশ্য মনশ্চক্ষুর সম্মুখে স্পষ্টভাবে উদ্ভাসিত হয় এখনো।
দেশে সরিষাখেতে কৃত্রিমভাবে মৌমাছির চাক বানিয়ে মধু আহরণ করা হয়, যা আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক উপায়ে মৌমাছির চাষ করতে পারলে লাখো-কোটি টাকার মধু বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা সম্ভব বলে মনে হয়।

কানাডার আলবার্টায় সরিষার খেত৷ সংগৃহীত
কানাডার আলবার্টায় সরিষার খেত৷ সংগৃহীত

আমাদের দেশে প্রধানত সরিষা থেকে ভোজ্যতেল উৎপাদন করা হয়। দেশে ভোজ্যতেলের মধ্যে সয়াবিন তেল প্রথম হলেও সরিষার তেলের স্থান দ্বিতীয়। তবে তেলের জন্য ফসল হিসেবে আমাদের দেশে সরিষার চাষই হচ্ছে প্রধান। আমাদের দেশে খুব স্বল্প পরিমাণের সরিষা চাটনি ও কাসুন্দিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
উত্তর আমেরিকা এবং বিশ্বের অন্য দেশগুলো সরিষার দানা দিয়ে প্রধানত কন্ডিমেন্ট বা গুঁড়া মসলা, আচার, চাটনি, কাসুন্দি প্রভৃতি প্রস্তুত করে। হলদে জাতের সরিষার দানা, আমরা যাকে রাই-সরিষা বলি, যা স্বল্প-মিষ্ট স্বাদের হয়ে থাকে। এই জাতের সরিষার পেস্ট ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় রকমারি রন্ধনে। বাদামি রঙের সরিষা, যা কিছুটা সৌরভযুক্ত ও ঝাঁজাল ধরনের হয়, তা দিয়ে ‘ডিজন মাস্টারড’ তৈরি হয় এবং অনেক খাবার প্রস্তুত করতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে এসব দেশে।
বর্তমানে বাংলাদেশে সরিষার তেলের ব্যবহার বহুলাংশে কমে গেছে। আমরা সয়াবিন তেলে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। কিন্তু তাই বলে পোড়া শুকনো মরিচের সঙ্গে ঝাঁজওয়ালা খাঁটি সরিষার তেলের সংমিশ্রণের আলুভর্তা পছন্দ করবে না, এমন বাঙালি কোথাও পাওয়া যাবে বলে আমার মনে হয় না। আর লোভনীয় সরষে-ইলিশ, তার কথা না-হয় বাদই দিলাম। খিচুড়ির সঙ্গেও আমরা অনেকে সরিষার খাঁটি তেল মাখিয়ে খেতে পছন্দ করি। সরিষা দিয়ে প্রস্তুত করা কাসুন্দি দিয়ে কাঁচা টক আম বা আধা পাকা আম খাওয়ার লোভ এখনো সামলাতে পারি না এবং মনে এলে জিবে জল আসে। দেশি ঢঙে নানা রান্নায় সরিষাবাটা ব্যবহার করে নানা পদের তরকারি আমাদের মা-ভাবিরা বানিয়ে থাকেন। আবার ওই যে কথার কথা আছে, খাঁটি সরিষার তেল নাকে দিয়ে আমরা ঘুমুতেও পছন্দ করি।

বাংলাদেশের সরিষাখেতে মৌমাছি থেকে মধু আহরণ৷ সংগৃহীত
বাংলাদেশের সরিষাখেতে মৌমাছি থেকে মধু আহরণ৷ সংগৃহীত

এমন সুন্দর হলুদ বর্ণের সরিষা ফুল থেকে ফল হয়ে ছোট ছোট যে সরিষা দানা হয়, তার উপকরিতা অপরিসীম। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সরিষা বীজে তেল, আমিষ, আঁশ ও ‘গ্লুকোসিনোলেটস’ থাকে, যা মানুষের শরীরের জন্য খুবই উপকারী। ‘গ্লুকোসিনোলেটস’ উপাদানটি খাদ্যে গাঁজলা-পড়া, ছাতা-ধরা ও ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি হতে বাধা দেয়। সরিষায় থাকা কিছু যৌগিক পদার্থ মানবদেহের রক্তের কোলেস্টেরল ও গ্লুকোজ লেভেল কমায়। এ ছাড়া অন্যান্য বহু ঔষধি গুণাগুণ রয়েছে এই ছোট্ট বীজটির অভ্যন্তরে, যা ক্যানসার প্রতিরোধ করে এবং ‘কার্সিনোজেনিক’ জিনকে দমন করে টিউমার বৃদ্ধিকে রহিত করে।
এই বহুমাত্রিক উপকারী দানাটির বিষয়ে উদাহরণ টেনে আমাদের দেশে যখন শোনা যায় যে ‘সরিষায় ভূত’ ঢুকেছে, তখন দুঃখের আর শেষ থাকে না। আমার ধারণা, যখন রক্ষকই ভক্ষক হয় বা যাদের ওপর গুরু দায়িত্ব থাকে, তারাই যখন পথভ্রষ্ট হয় বা স্বেচ্ছাচারিতা করে, তখন বোধ হয় বলা হয় সরিষার ভেতর ‘মামদো’ ভূত ঢুকে পড়েছে। এ ছাড়া আমদের দেশের সহজ-সরল গ্রামের খেটে খাওয়া কৃষকেরা শরীরের ঘাম ছুটিয়ে যে সরিষা উৎপাদন করে থাকেন, সেই সরিষায় ভূতের স্পর্শ করা উচিত নয় বা তার ভেতরে ঢোকারও কথা নয়।
দেশে এখন রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল চলছে, তার কারণ একটি গণতান্ত্রিক দেশ চালানোর জন্য যেখানে অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল আদলের একটা গভর্নমেন্ট থাকা জরুরি, সেখানে ভোট না পাওয়া, গায়ের জোর, মিথ্যা আস্ফালন—এমনকি মায়াকান্নার গভর্নমেন্ট জেঁকে বসেছে জগদ্দল পাথরের মতো। তার মানে সবচেয়ে বড় যে একটা স্থান গণতন্ত্র, সেখানকার সরিষায় ভূত ভয়ংকরভাবে ঢুকে পড়েছে। এ অবস্থায় যিনি দেশের নির্বাহী প্রধান, তাঁকেই দায়িত্বটি নিতে হয় ভূত তাড়ানোর৷ কিন্তু সেই নির্বাহী প্রধানেরও সরিষায় যদি ভূত ভর করে, তখন তাঁকে কেই-বা ঝাড়ফুঁক দেবে কিংবা তাঁর ওপর বসা ভূতকে কে-ই বা তাড়াবে? আর সময়বত সেই ভূতকে তাড়াতে না পারলে দেশসুদ্ধ সবাইকে চোখে সরষে ফুল দেখতে হবে অচিরেই৷