শৈশবের দিনগুলি-দুই

(পূর্ব প্রকাশের পর)

মামা বাড়িতে চাচাতো মামারা হলেন গনি মামা, পোস্ট মাস্টার মামা ও নান্নু মামা। অন্য ঘরে আছেন খালাতো ভাই ছুফা মিয়া, খোকা মিয়া। খালাতো ভাই খোকা মিয়ার দাপটের কথা গ্রামে অনেকেরই জানা। একদিন কোনো এক খেয়া নৌকা পার হয়ে মাঝিকে নাকি পাঁচ টাকা দিয়েছেন আমার সে খালাতো ভাই। সে কথা অনেক দিন আলোচনা হয়েছে৷
মামা বাড়িতে অনেক মজা। এখানে আছে খেলার সাথি হালিমা, মাহমুদা, জিনাত, পারু আরও অনেকে।
‘এই ছেলেপুলেরা, অনেক হলো, এবার খেলা শেষ। ’
মন্তা ভাই ডেকে ডেকে গুছিয়ে নিতে চাইলেন ছোটদের। বিকেলের টিফিনের সময় যে হয়ে এল।
‘মন্তা ভাই, জসীম বলে তুমি নাকি চলে যাবে এ বাড়ি থেকে। ’
‘আমি আর কই পালাব নানা ভাই? ’
মন্তা ভাইয়ের আর কোথাও যেতে ইচ্ছে হয় না। এখানে সেখানে, গাঙের কূলে ঘুরে বেড়ান তিনি। এই গাছপালা, বাতাস, পশুপাখি, জীবজন্তুর সঙ্গে যেন তাঁর কত কথা। ছোটখাটো সবকিছুই আজকাল ভারি গুরুতর হয়ে ওঠে তাঁর কাছে। আজকাল শরীরটা প্রায়ই ঝিমঝিম করে। জীবনে ডাক্তার কবিরাজের খুব একটা দরকার হয়নি। এখন বোধ হয় আর না গেলেই নয়।
‘মন্তা ভাই, ওষুধ খাওনা কেন? তুমি যে সারা দিন খুক খুক করো। ’
‘ঠিক কইছ নানা ভাই। কালই যামু ডাক্তারের কাছে। ’
‘কোন ডাক্তার মন্তা ভাই? ’
‘এন্তাজ ডাক্তার। ’
‘কোথায় তিনি? ’
‘মুনশির হাটে। হোমিও ওষুধের ডাক্তার। বড় ওষুধের আলমারি। ইংরেজি বইও আছে একখান। জটিল রোগে একটু আধটু ইংরেজি বই পড়তে হয় তাঁকে। পাড়া প্রতিবেশী সবাই যায় তাঁর কাছে। আসো আসো টিফিনের সময় হলো। ’
মামা বাড়িতে অতিথির পরিচর্যায় লেশমাত্র ত্রুটি ছিল না কোনোখানে। ছোট মামির সেবাযত্নে রন্ধ্র মাত্র রইল না কোথাও। কিন্তু তবুও আগেকার মতো সে সুর যেন বাজল না এবার কারও মনে। কোথায় রইল ফাঁক, কোনখানে ঘটল বিপত্তি, অবশেষে তার নিশানা পাওয়া গেল। গাঙের ভাঙন গ্রাস করছে মেদুয়া গ্রাম, গ্রাস করছে মামা বাড়ি। মামা বাড়িতে নাকি এই আমাদের শেষ আসা। সে অভাব শুধু মনে নয়, চোখেও দেখা গেল অনেকের।
বড় মামা দুই সপ্তাহ রইলেন গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু কে জানত কোনো এক মক্কেলের প্রয়োজনে হঠাৎ করে বড় মামা চলে যাবেন নির্ধারিত সময়ের আগে। মামিও চলে গেলেন ঢাকায়। চলে গেল ইকবাল, পারভিন আর খোকন। জানালার কাছে পড়ে রইল ভাঙা বন্দুকটা। ফিরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন রইল না। তারপর একে একে সব খালা চলে গেলেন। বাড়িটা কি ফাঁকাই না হয়ে গেল। সব যেন ঝিমিয়ে পড়ল। পুকুর থেকে জলভরা কলসি নিয়ে আসার সময় বাড়ির আঙিনায় নির্জনতা টের পেল আলী হোসেনের মা। বারান্দায় এসে ডাকল, ‘ও সুরাইয়া, ও আসমা, তোরাও বিদায় হলি নাকি? ’ কেউ সারা দিল না। বাড়িটা কোলাহলশূন্য। গোটা বাড়িটা যেন ছম ছম করছে। বড় একা লাগল আলী হোসেনের মায়ের।
সেদিন বার বার যেন তন্দ্রার ঘোরে আমি মন্তা ভাইকে দেখলাম। দিগন্তে ঘোর কালো মেঘ করেছে তখন।
‘ওই দেখো নানা ভাই, আজ আবার ভাসিয়ে দেবে বোধ হয়। ’
দেখলাম আবার জীর্ণ এক টিনের বাক্সে তিনি তাঁর জামাকাপড় গুছিয়ে নিচ্ছেন।
‘কোথায় যাবে মন্তা ভাই? ’
‘যাব কোথাও। ’
‘তুমি যেও না মন্তা ভাই। ’
‘তা কি হয়! ’

লেখক
লেখক

ঘুম আর জাগরণের মাঝে যেন আমি আচ্ছন্ন হলাম। নিঃশব্দে সন্ধ্যা নেমে এল ধীরে। মন্তা ভাই যদি সত্যিই চলে যায়, তাহলেই বা ক্ষতি কী? সাধ্যমতো যে যার জীবন তো নিজেই গুছিয়ে নেবে। একটু গরম লাগছে। ঝালর দেওয়া তালের পাখাটা কাছে নেই। নিজের এই পাখাটা সুরাইয়া আর আসমার জন্য সরিয়ে রেখেছেন কোথাও। নিলুফার আর হাসনুর জন্যও রয়েছে একটা। ছোট কক্ষের আবছা অন্ধকারে মন্তা ভাইয়ের শরীরে যেন নানা স্পন্দন ছুঁয়ে যায়। চোখের নিমিষেই এ বাড়িতে ৫০ বছর কেটে গেছে তাঁর। কয়েক দিনের মধ্যেই ছোট মামা তাঁর ভিটে মাটি নিয়ে চলে যাবেন ভোলার অদূরে কাঁঠালি গ্রামে। সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল মন্তা ভাইকে। জীর্ণ শরীরের ক্লান্তি নিয়ে এ বয়সে আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না তাঁর। বাকি জীবনের গতিপথ যদি ক্লেশময় আর বিপদসঙ্কুল হয়ে ওঠে তাহলেই মন্তা ভাই কাঁঠালি চলে আসবেন, ছোট মামা তা-ই বললেন।
মন্তা ভাইয়ের বাবার নাম রজব হোসেন আর মায়ের নাম কামিনি। মন্তা ভাই মা-বাবার একমাত্র সন্তান। দউলত খাঁ গ্রামের জমিদার কালারায়ের তালুকে খাজনার তাগিদে নায়েবের অত্যাচার বেড়ে চলছিল একদিন। গ্রামে দাঙ্গা বেধে ছিল কোথাও কোথাও। প্রচলিত জনশ্রুতি এই যে, রাজা কালা রায় এ সংঘাত উসকে দিয়েছেন। মন্তা ভাইয়ের বাবা রজব হোসেন নিজের জীবন বিপন্ন জেনে এক অন্ধকার রাতে সপরিবারে মেদুয়া গ্রামে চলে আসেন। মেদুয়ায় সে সময় থেকেই মন্তা ভাইয়ের পূর্বপুরুষের শুরু। আজ মন্তা ভাইয়ের পরিজনেরা পরলোকগত। তাঁর কোনো গৃহ আছে বলে জানি না। জানি না কোথায় হবে তাঁর ঠিকানার সন্ধান। সে একা, গাঙে ভাঙা এক প্রবহমান পথের মানুষ।
ভোলা জেলার সদর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার পূর্বে মেদুয়া গ্রাম। ৫০ বছর আগে মেঘনা গাঙের ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে এই গ্রাম। এই সেই মেদুয়া, যেখানে লুকিয়ে আছে মন্তা ভাইয়ের জীবন আর আমার শত গল্প বলার উৎস। এখানেই মিশে রয়েছে শিমুল ফুল আর কৃষ্ণচূড়ার রঙে মুখরিত আমার মায়ের শৈশবের দিনগুলি। (শেষ)

আরও পড়ুন: