বাঙালির ধর্মীয় মিল মহব্বতে পুলিশ!

বেলজিয়ামের একটি মসজিদে ঈদের জামাতের দৃশ্য
বেলজিয়ামের একটি মসজিদে ঈদের জামাতের দৃশ্য

স্ত্রী ও ছেলেমেয়েসহ বিদেশে থাকলেও মা, (বাবা মৃত), ভাইবোন, আত্মীয় পরিজনহীন অবস্থায় ঈদ আনন্দ আমার জন্য খুব একটা আনন্দময় হয় না। ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে এবং তারা যেন বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও কৃষ্টি ভুলে না যায় সে কথা মনে করে আমি নিজে আনন্দিত হওয়ার ভাব করি। প্রবাসে থাকি এই জন্য আমি যথেষ্ট অপরাধবোধে ভুগী। এ রকম থাকবার কথা ছিল না। ভাইবোন শুধু নয় আত্মীয়পরিজন অনেকেই—চাচাতো ভাইবোনরা পর্যন্ত আমাকে নিয়ে অনেক আশা করত। তারা ভাবত যেকোনো সমস্যায় আমি তাদের দেখবে। এটা তাদের দোষ নয়, দেশে থাকাকালে আসলেই আমি তাদের সকলের খোঁজখবর নিতাম। সাহায্য করতে পারি বা না পারি, যে কারও বিপদে পাশে গিয়ে দাঁড়াতাম। সেই আমি বিদেশে পালিয়ে এসেছি ১৮ বছর! পালিয়ে আসা শুনে অনেকে ধারণা করতে পারেন হয়তো বা মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে বিদেশে এসেছি। আবার কেউ কেউ মনে করতে পারেন বড় কোনো অপরাধ করে ভেগেছি। আমরা নেগেটিভ ধরনের ভাবনা ভাবতে পছন্দ করি। হ‌ুমায়ূন আহমেদের একটা নাটকে দেখেছিলাম-অন্যের দুঃখ কষ্ট দেখলে অনেকেরই আনন্দ হয়। তা কেউ স্বীকার করেন, আবার কেউ করেন না। কিন্তু কথা সত্য আমাদের বাঙালিদের জন্য। মৃত মানুষ দেখলে সকলেই চেতন বা অবচেতন মনে এটুকু পুলক অনুভব করেন যে, তিনি নিজে জীবিত। ঈদ নিয়ে লিখতে গিয়ে এসব কি লিখছি? মূল কথায় আসি।
বেলজিয়ামের অ্যন্টারপেন শহরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের দুটি মসজিদ। দুই মসজিদেই ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়। হর্তাকর্তা বাংলাদেশি হলেও এই মসজিদ দুটি বাঁচিয়ে রেখেছেন আরব আর আফ্রিকান মুসলমান প্রবাসীরা। মুসল্লি তারাই বেশি। দলাদলি করে বাঙালিরা দুই গ্রুপ দুটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছে এ রকম নয়। এখানে এক মসজিদেই সকল দলাদলি বিদ্যমান। এক সিলেটী ভদ্রলোকের বাসার নিচতলায় দোকান ছিল। সেটা বন্ধ করে দিয়ে কি মনে করে মসজিদ ঘোষণা করেছেন। এই মসজিদে কোনো দলাদলি নেই। একক আধিপত্যের মসজিদ। তবে এখানে মুসল্লি কম হয়। গত দুবছর ধরে দেখছি এখানে রোজার সময় তারাবি হয় ও মুসল্লিদের ইফতারও করানো হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ঈদের জামাতও অনুষ্ঠিত হয়েছে ওখানে। আমি নিজে অবশ্য যাইনি।

আর যেটি বাঙালিদের বড় মসজিদ সেটি বেশ পুরোনো। বেশির ভাগ বাঙালি মুসলমানরা নামাজে এখানেই যান। রোজার সময় এখানে খতম তারাবি হয়েছে। এই মসজিদে নির্বাচিত পরিচালনা কমিটি আছে। কিছুদিন আগে মসজিদ কমিটির নির্বাচন হয়ে গেল। আমরা বাঙালিরা যেখানেই থাকি না কেন দেশের সমসাময়িক পরিস্থিতি সেখানেও তৈরি করে ফেলি। যেমন এই মসজিদ কমিটির নির্বাচনটি হয়েছে বাংলাদেশের পাঁচই জানুয়ারির নির্বাচনের মতো। এখানকার সরকারি কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে একতরফা ভোট হয় সম্পূর্ণ আইনগতভাবে। বেআইনি কাজ হয়েছে কেউ বলতে পারবেন না এবং এই শহরের পৌরসভা নির্বাচন পরিচালনা করেছে। একটি অংশের প্যানেল জমা পড়েছিল। তারাই ভোট দিয়ে নিজেদের নির্বাচিত করেছে। ইউরোপে গরিব নাই বিধায় মসজিদ কমিটি মুসল্লিদের সেবা কীভাবে করবেন বুঝতে পারছে না! তবে মসজিদ কমিটির শুভেচ্ছা বিনিময়ের তোড়জোড় দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবেন তারাই মসজিদের হর্তাকর্তা। কত টাকা চাঁদা উঠল, কে কত দিল সব মসজিদে লিখিত অবস্থায় ঝোলানো আছে। আপনি দেখতে না চাইলেও আপনাকে ওই সব হিসাব দেখতে হবে কারণ কমিটির লোকজন তা দেখিয়েই ছাড়বেন। আপনি বাংলাদেশি, আপনার অধিকার এসব দেখা। এ রকম বলে যে বক্তৃতা শুরু করবে, আপনি হিসাব দেখে রক্ষা পাবেন না হলে কথা শুনতে শুনতে কানে তালা লেগে যাবে। ইবাদত বন্দেগি করতে এসে মাঝে মাঝেই এখানে পুলিশ দেখতে হয়। ধর্মীয় কাজেও আমাদের মিল মহব্বত এত বেশি যে, পুলিশকে এসে ওই মহব্বত কন্ট্রোল করতে হয়। না হলে বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। ইবাদত বন্দেগির এমন অবস্থা বাঙালি করেছে এখানে যে আল্লাহপাক অবশ্যই লজ্জা পান।

রাতের অ্যন্টারপেন
রাতের অ্যন্টারপেন


এই মসজিদ কমিটির বেশির ভাগ সদস্য একটি রাজনৈতিক দল (বিএনপি) সমর্থিত। দুই-একজন আওয়ামী লীগ সমর্থক থাকলেও থাকতে পারেন। এরা একই সঙ্গে বাংলাদেশে ভোটারবিহীন নির্বাচনের প্রতিবাদে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সামনে বিক্ষোভ করে এসে নিজেরা মসজিদে একতরফা নির্বাচনের আয়োজন করেছেন। বোঝা যাচ্ছে বিএনপি আগে এ রকম নির্বাচন যে আইনগত ভাবে করা যায় তা জানত না। কুট বুদ্ধিতে তারা আওয়ামী লীগের চেয়ে বড় না এটা ঠিক আছে, আবার কুট বুদ্ধি শিখে তার বাস্তবায়ন বিএনপির চেয়ে ভালো কেউ করতে যে পারে না সেটাও মনে হয় ঠিক।
ঈদের নামাজ দুই মসজিদেই এখানে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়েছে। কোনো গন্ডগোল হয়নি। নামাজ শেষে যথারীতি কোলাকুলি করতেও দেখা গেছে সকলকে। কমিটি বিরোধী হিসেবে যারা পরিচিত তারা প্রায় সকলেই ভাগ ভাগ হয়ে তুর্কি না হয় পাকিস্তানি মসজিদে ঈদের নামাজ পড়েছেন। অতএব, গন্ডগোলের কোনো প্রশ্নই আসে না!