হাত বাড়ালেই বাংলাদেশ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আমরা যখন ছোট ছিলাম, যখন কোনো ইন্টারনেট ছিল না, তখন বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল দৈনিক পত্রিকা, বলতে গেলে একমাত্র মাধ্যম। মনে আছে স্কুল থেকে এসে কোনো রকমে বইখাতার ব্যাগ ছুড়ে ফেলে এক দৌড়ে বসে যেতাম দৈনিক পত্রিকা নিয়ে। খবরের কাগজের আদ্যোপান্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম। দেশের কোথায় কী হচ্ছে তা তো জানতেই হবে। সেই সঙ্গে কচি মনের আগ্রহ ছিল বিদেশের খবর জানা। বিদেশের খবর পড়ে মন ভরত না, আরও জানতে ইচ্ছা করত। খেলার খবর, রাশিফল, সম্পাদকীয়, চিঠিপত্র, বিনোদন, সাপ্তাহিক সাহিত্যের পাতা কিছুই বাদ পরত না। টেলিভিশনে তখন এতগুলো চ্যানেল আসেনি। বিটিভিতে কিছু কিছু ইংরেজি সিনেমা দেখানো হতো ঠিকই, কিন্তু সিনেমা তো সিনেমাই, একেকটা দেশ সম্পর্কে, সেই জাতি, সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবন এগুলো সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার সুযোগ ছিল সীমিত।
১৯৯৮ সালে যখন বিদেশে আসি, তখন মোটামুটি দেশ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। দুই ডলার পার মিনিট রেটে দেশে কথা বলা ছাত্রদের সীমিত আয়ে প্রায় এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। পশ্চিমা দেশগুলোতে ইন্টারনেট তত দিনে বেশ চালু হয়ে গেলেও, আমাদের দেশে তখনো ইমেইল ততটা জনপ্রিয়তা পায়নি। প্রথমবার দেশছাড়ার কষ্ট অনেক গভীর। দেশের সবকিছুর জন্যই মন পোড়ে। প্রিয়জনদের মুখ মনে পড়ে, কণ্ঠস্বর শুনতে ইচ্ছা করে। অস্বাভাবিক উঁচু দরে কেনা ফোনের মিনিট সেই কণ্ঠস্বর শুনে, চোখের পানি ফেলে, জরুরি কুশলাদি বিনিময় করতে করতেই চোখের পলকে শেষ হয়ে যায়। দেশের সব খবর জানতে ইচ্ছা করে। প্রতিদিন সকালে উঠে মনে হয় একটা দেশি খবরের কাগজ যদি পাওয়া যেত। জানতে ইচ্ছা করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, হরতাল, ধর্মঘটের খবর, বিভিন্ন দলের কর্মসূচি, জানতে ইচ্ছা করে ফুটবল লীগে আবাহনী জিতল নাকি মোহামেডান। প্রতিদিনের অভ্যাস মতো রাশিফল পড়ে অকারণে খুশি হওয়া, কারণ ছাত্র ছাত্রীর জন্য আজকের দিনটি শুভ। মুগ্ধ হয়ে পড়া সম্পাদকীয় আর মনে মনে ভাবা ইস আমিও যদি এ রকম লিখতে পারতাম। দেশের আনাচকানাচে ঘটে যাওয়া অসংখ্য টুকরো খবর। দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আপামর জনসাধারণের জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন কাহিনি, সব মিলিয়ে আমাদের বাংলাদেশের এইসব দিন রাত্রি। দেশে থাকতে জানতে ইচ্ছা করত বিদেশ সম্পর্কে, বিদেশে এসে মন খালি জানতে চায় দেশ সম্পর্কে, দেশের খবর, তবে জানার ইচ্ছার তীব্রতাটা বহুগুণ বেশি।

সপ্তাহে, দুই সপ্তাহে একবার যেতাম বাঙালি দোকানে মাছ, মাংস, সবজি এসব কিনতে। সেই সঙ্গে চড়া মূল্যে কিনে নিয়ে আসতাম বেশ কয়েক দিনের বাসি দৈনিক পত্রিকা। বাসায় এসে সেই পত্রিকা নিয়ে কাড়াকাড়ি। পত্রিকার কটা পাতা যেন ছাপার অক্ষরে লেখা এক টুকরো স্বদেশ। কী যে গভীর আগ্রহ নিয়ে সেই পত্রিকা পড়তাম, একটি খবরও যেন বাদ না পড়ে। দেশের খাওয়া, দেশের বাতাস, দেশের আকাশ এই সব কিছুর সঙ্গে সঙ্গে তীব্রভাবে মিস করতাম দেশের খবর। আকাশ, বাতাসের কোনো বিকল্প ব্যবস্থা আজও হয়নি, তবে দেশি খাওয়ার বিকল্প ব্যবস্থা ছিল বরফ দেওয়া ছয় মাসের পুরোনো বিশেষ বিশেষ মাছ, বা শুকিয়ে আসা দুই চার রকমের সবজি, ঠিক তেমনি দেশি খবরের বিকল্প ছিল সেই সাত দিনের বাসি পত্রিকা।
আজ আমরা অনেক ভাগ্যবান। ধন্যবাদ ইন্টারনেটকে। ধন্যবাদ অনলাইন পত্রিকাগুলোকে। ইন্টারনেটের কল্যাণে স্কাইপ, ভাইবারে বিনা মূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে কথা বলতে পারছি আপনজনদের সঙ্গে, ইচ্ছা করলেই তাদের দেখতে পারছি, তারা আমাদের দেখতে পারছেন। অসুস্থ বাবা-মা, যারা বিদেশে যেতে সক্ষম নন, তারাও দেশে থেকে ছেলেমেয়ের বিদেশের সংসার দেখে তৃপ্তির হাসি হাসেন। নাতি-নাতনিদের কাছে তারা এখন আর দূরের মানুষ নন, অপরিচিত কিছু সম্পর্ক না। বিদেশে থাকা সন্তান যারা নানা কারণে বিদেশ ত্যাগ করতে অপারগ, তারাও বছরের পর বছর বাবা-মা, পরিবারকে না দেখার গভীর শোক ভুলে থাকছেন দেশে থাকা বাবা-মাকে দুবেলা নিজ চোখে দেখে। এমনকি দেশের হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে যে অসুস্থ বাবা-মা, তাকেও দুবেলা নিয়ম করে বিদেশ থেকে দেখতে পারছে নানা কারণে আটকে পড়া ছেলেমেয়ে, নাতিনাতনি।
এ তো গেল ব্যক্তিগত, পারিবারিক পর্যায়ে যোগাযোগ। এ রকম আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়েছে অনলাইন পত্রিকাগুলো, প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে স্বদেশের। এই ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে প্রথম আলো। আজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অজস্র বাংলাদেশি রুটিন করে নিয়মিত অনলাইন প্রথম আলো পড়ছেন, দেশের সমস্ত খবর, দেশের মানুষের সঙ্গে সঙ্গে সময়মতো পেয়ে যাচ্ছি আমরা প্রথম

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আলোর কল্যাণে। প্রথম আলো ভৌগোলিক দূরত্ব অতিক্রম করে বাংলাদেশকে পৌঁছে দিয়েছে প্রবাসীদের দোরগোড়ায়। দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতি, দেশের সমস্যা, উন্নতি, শিক্ষা ব্যবস্থা, আবহাওয়া থেকে শুরু করে সংস্কৃতি, সাহিত্য, খেলাধুলা, চলচিত্র সবকিছুই এখন আমাদের প্রবাসীদের নখদর্পণে। একই সঙ্গে প্রবাসের বিভিন্ন খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রথম আলো আমাদের মতো প্রবাসীদের সুযোগ করে দিয়েছে প্রবাস জীবনের বিভিন্ন চিত্র দেশবাসীর কাছে তুলে ধরতে আমাদের লেখনীর মাধ্যমে। প্রথম আলোর এই প্রচেষ্টা যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা এখন আর নিজেদের কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন মনে করে না। প্রবাসীদের সঙ্গে দেশের মানুষের এক অবিচ্ছেদ্য সেতু বন্ধন তৈরি করে দিয়েছে প্রথম আলো। বিদেশের মাটিতে, বিশেষ করে দ্বিতীয় প্রজন্মের বাংলাদেশিদের মাঝে দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রসারে উৎসাহ তৈরি করেছে প্রথম আলোর দূর পরবাস। তাদের সংস্কৃতি ও সাহিত্য চর্চার সংবাদ সম্মানের সঙ্গে স্থান পাচ্ছে এখানে। উপরন্তু, দৈনিক পত্রিকার কারণে দেশীয় সংস্কৃতির বর্তমান ধারার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে প্রবাসীরা।
যেহেতু একটি উন্নত মানের দৈনিক পত্রিকা আসলে একটি দেশ, জাতির সামগ্রিক বর্তমান অবস্থা ও অবকাঠামোর দর্পণ হিসেবে কাজ করে, তাই প্রথম আলোর অবদানে সেই দর্পণে আমরা প্রবাসীরা প্রতিদিন দেখতে পাই আমাদের ফেলে আসা বাংলাদেশকে। দেশের গৌরবে আমরা দেশের মানুষের সঙ্গেই আনন্দিত হই, দুর্যোগে ফান্ড রাইজিং, প্রয়োজনে জোট বেঁধে প্রতিবাদ করা, বিদেশি সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করাসহ দেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় উৎসবগুলো এখন ব্যাপক সাড়ম্বরে বিদেশে উদ্‌যাপিত হয়। এভাবে প্রথম আলো প্রবাসী বাংলাদেশিদের জীবনে এক বিরাট অবদান রাখছে। আমাদের দেশের মানুষের জন্য, দেশের জন্য কিছু করার, ভাবার সুযোগ করে দিচ্ছে। সবচেয়ে বড়কথা দেশের জন্য আমাদের যে টান, মায়া মমতা, সেই টান, সেই বন্ধন, সেই মায়া মমতাকে লালন পালন করার সুযোগ করে দিয়েছে প্রথম আলো। সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশিরা এখন প্রথম আলোর সুবাদে একই সঙ্গে একই কারণে হাসে, দেশের গৌরবে গৌরবান্বিত হয়, আবার একই সঙ্গে কাঁদে, একই সঙ্গে উদ্বিগ্ন হয়, আশার আলো দেখে। প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে প্রাণঢালা অভিনন্দন, শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। অনাগত দিনগুলোতে এভাবে করেই যেন আমাদের মন প্রাণ ভরে দেয় এই পত্রিকা, যেন হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারি আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ।