বাস্তবতার শহরে কাল্পনিক যুবক-পাঁচ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ড. শরাফত হোসেন নিউইয়র্ক মিউজিয়ামের সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন। অনেক দিন হয় এই রাস্তা দিয়ে আসা হয় না। আজ এসেছেন। এই মিউজিয়ামে বেড়াতে এলে তিনি প্রায় সময়ই সেন্ট্রাল পার্কে একটু সময় কাটাতে পছন্দ করেন। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। ধীর গতিতে হেঁটে হেঁটে তিনি কনজারভেটরি গার্ডেনের ভেতর ঢুকলেন। ব্যস্ত শহরের মাঝে চমৎকার একটু নিরিবিলি জায়গা। এই বাগানে আজ কারও বিয়ে হচ্ছে। অতি আকর্ষণীয় সাজে বেশ কিছু নারী ও পুরুষদের ছবি তুলতে দেখা যাচ্ছে। শরাফত হোসেন যে পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন সে পথেই বিয়ের পাত্রী তার সুবিস্তৃত লেজওয়ালা সাদা বিয়ের গাউন পরে উল্টোদিকে হেঁটে যাচ্ছে। তাকে ঘিরে রেখেছে বেশ কিছু মেয়ে। আরও বেশ কিছু মেয়ে অপরূপ পোশাক আসাকে হেঁটে চলেছে। নিশ্চিতভাবেই বলা যায় আজ পাত্রীর জীবনে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ একটা দিন।
শরাফত হোসেন পার্কের একটা স্ট্যাচুর সামনে এসে দাঁড়ালেন। ব্রোঞ্জের তিনটা নারী একে অপরের হাত ধরে নৃত্যরত। সবার পরনে স্কার্ট। অপূর্ব কারুকাজ করা। দেখলে মনে হবে নৃত্যরত নারীদের সমস্ত জীবনটাই প্রাণ পেয়েছে। তিনি মূর্তিগুলো দেখে মনে মনে টাইটেল দিলেন চলমান, সুখী ও যৌবনা। এভাবেই ওরা বেঁচে থাকুক চিরকাল। স্ট্যাচু দেখে তার মনটা ভালো হলো। তারপর হাঁটতে হাঁটতে তিনি একটা বিশাল লোহার গেট পার হয়ে বড় রাস্তায় এসে নামলেন। জায়গাটা ফিফথ অ্যাভিনিউর দিকে। ক্রমেই পার্ক থেকে তার দূরত্ব বাড়তে লাগল। তিনি দেখলেন রাস্তার পাশে একটা লোহার বেঞ্চের ওপর দুজন হোমলেস ব্যক্তি বসে আছে পাশাপাশি। একজন নারী ও অন্যজন পুরুষ। তারা দম্পতি কিনা তিনি ঠাহর করতে পারলেন না। বেঞ্চের একপাশে ময়লাকার বড় দুটি ব্যাগ রাখা আছে। মনে হচ্ছে ওদের সংসারের পুঁজি। চলমান জীবনের অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস রাখা আছে ব্যাগটির ভেতর। পুরুষ লোকটির উসকোখুসকো চুল। লাল দাঁড়িতে একটু জটলাও লেগেছে। তার আবার মন খারাপ হলো। এই আরেক সমস্যা ইদানীং। মন ভালো রাখা বেশ দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। একটুতেই যেমন মন ভালো হয়ে যায় আবার সামান্য কারণেই মনের ভেতর বিষণ্নতা নেমে আসে। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় উপকরণ হচ্ছে নিজের ইমোশনকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। আশপাশের মানুষ যেন ঘুণাক্ষরেও জানতে না পারে মনের ভেতরের অন্য মানুষটি কীসের ভেতর বসবাস করছে। সেই জায়গাটা যদি মানুষ কর্তৃক চিহ্নিত হয়ে যায় তাহলে চলার পথে বারবার আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শরাফত হোসেনের খুব জানতে ইচ্ছে করছিল হোমলেস নারী আর পুরুষটি বিবাহিত কিনা। হয়তো পথে পথেই ওদের পরিচয়। তিনি কল্পনা করলেন কনজারভেটরি পার্কে আজকের লেজওয়ালা গাউন পড়া পাত্রীটি বেঞ্চে বসা হোমলেস নারীটির বহু বছর আগের যৌবনা রূপ। অনেক কষ্টের মধ্যেও বেঁচে থাকার সান্ত্বনা হচ্ছে পরিবর্তনের হাওয়ার জন্য পথ চেয়ে থাকা। এই নারীটি হয়তো তাই করছে। কে জানে হয়তো পথই মুক্তি। বাইরে থেকে আমরা এক জগতের কথা ভেবে বসি কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন কিংবা আনন্দের।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি


দুই.
পিরু জ্যামাইকা থেকে এসে ট্রেনে উঠল। উদ্দেশ্য বাংলাদেশি এলাকায় যাওয়া। কুইন্সের জ্যাকসন হাইটস বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রসিদ্ধ। হরেক রকমের দোকান, রেস্টুরেন্টে ভরপুর। তবে ইদানীং জ্যামাইকা শহরও বাংলাদেশিদের জন্য বেশ জমজমাট ও রমরমা। অনেক দিন হয় পিরু জ্যাকসন হাইটস এলাকায় আসে না। আজ যাবে তার ক্যাবি বন্ধু শাহিনের সঙ্গে দেখা করবার জন্য। ওখান থেকে সে বাংলাদেশের বস্তির ফাউন্ডেশনের জন্যও বেশ কিছু টাকা পাঠাবে। কষ্টার্জিত আয় দিয়ে সে বাংলাদশে একটা চ্যারিটি চালায়। নাম প্রয়াস ফাউন্ডেশন। এখনো বাংলাদেশ সরকার থেকে নিবন্ধন পায়নি কিন্তু তবুও বিশ্বস্ত লোক মারফত টাকা পাঠায়। নিবন্ধন পাওয়া নাকি একরকম অসম্ভব ব্যাপার। একবার আবেদন করেছিল কিন্তু অফিস থেকে এক ভদ্রলোক বলে দিয়েছেন, সরকার নিবন্ধন দেওয়া বন্ধ রেখেছে। মানুষ নাকি চ্যারিটির নামে সরকার বিরোধীদের কাছে টাকা পাঠায়। শক্তিশালী চ্যানেল না থাকলে হবে না। পিরুর বাবা মমিরুল হক সাহেবের তখনো কিছু ক্ষমতা ছিল, কিন্তু পিরু নিজের ক্ষমতায় বিশ্বাস করতে চায়। যদিও তার ক্ষমতা সীমিত। তার বাবা ছেলের শিক্ষাদীক্ষার পেছনে অবৈধ আয়ে জীবনভর যত অর্থ ব্যয় করেছেন পিরু তার পুরোটাই ফেরত দেবার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই প্রয়াস ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশনের মূল উদ্দেশ্য বস্তিবাসীদের কর্মসংস্থান, সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা ও বাচ্চাদের শিক্ষা। পিরু ও বাংলাদেশের আরও পাঁচজন বন্ধু মিলে রামপুরা বস্তি থেকে এই উদ্যোগ শুরু করেছে। তবে সে বাবার ঘুষের টাকায় অর্জিত শিক্ষাকেও অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি নয়। নিউইয়র্কে ক্যাবি হিসেবে জীবনযাপন তারই প্রমাণ। অবৈধ আয় বা অন্য যাই কিছু হোক তা দিয়ে কোনোকালেই কোনো কিছুরই বৈধতা পাওয়া যায় না। শুদ্ধতার প্রথম শর্তই হচ্ছে শুরু থেকেই তা শুদ্ধ হতে হবে। নিজের ক্ষমতা আর ইচ্ছার কথা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার লেখকের কথা মনে হলো। ড. শরাফত হোসেনের ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপরও তার জীবনও অনেকটা নির্ভরশীল।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

তিন.
পিরু ট্রেনের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে। সমস্ত কম্পার্টমেন্ট যাত্রীতে ভরপুর। কেউ বসে বসে ঝিমাচ্ছে, কেউ মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত। ট্রেনের ভেতর একটু পরপর আলোর ঝলকানি দেখা যাচ্ছে যখন নতুন স্টেশনে থামে। পরক্ষণেই আবার তা অন্ধকারের গুহায় হারিয়ে যায়। পিরুর দৃষ্টি ট্রেনের যাত্রীদের দিকে। পৃথিবীর রাজধানী বলে কথা। নিউইয়র্কের মতো শহরের এই একটা ট্রেনের কামরায় কমপক্ষে চল্লিশ কী পঞ্চাশটি দেশের মানুষ একসঙ্গে গুটিসুটি মেরে বসে অথবা দাঁড়িয়ে আছে। একটা শহর কীভাবে পৃথিবীর প্রায় সবকটি দেশের এবং খুব সম্ভবত সবকটি ভাষার মানুষদের একই স্থানে বসবাস করার সুযোগ করে দিয়েছে। সাদা, কালো, ধূসর, হলুদ সর্ব বর্ণের সর্ব দেশের মানুষের মহা মিলনমেলার এই শহর। জয় হে মহানগর। ট্রেনের আলোর ঝলকানির সঙ্গে সঙ্গে পিরুর দৃষ্টি আটকে গেল এক যাত্রীর মসৃণ হাতের দিকে। সেই হাতটি একজন যাত্রী শক্ত করে ট্রেনের ওপরের দিকের হাতল ধরে আছে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে সিলভার রঙের একটা ব্রেসলেট। ব্রেসলেটের পর তার মসৃণ হাতের কিছুটা অংশ ফাঁকা। তার একটু ওপরে আবার কালো ও লাল রঙের শার্টের হাতলের শেষভাগ। ব্রেসলেট আর শার্টের ফাঁকা অংশের মধ্যদিয়ে তার হাতের হালকা নীলাভ পেশিগুলো ভেসে আছে। দেখে মনে হবে বড় একটা নদীর কয়েকটি শাখা প্রশাখা এদিক-ওদিক বাঁক নিয়ে হাতলের ভেতর চলে গেছে। মেয়েটি পিরুর খুব কাছে হলেও মনে হচ্ছে অনেক দূর। কারণ সে দাঁড়িয়ে আছে উল্টোদিকে মুখ করে। ট্রেনের দরজার দিকে। শুধু ওই হাতখানি পিরুর কাছাকাছি। পিরু লক্ষ্য করল সেই মেয়েটি সিন্থিয়া এলভিস। তার স্বপ্নচারিণী। যার জন্য সে জীবন পেতে চায়। যার জন্য সে অনেক কষ্টের মধ্যেও শরাফত হোসেনের দেওয়া জীবনকে মেনে নিতে চায়। বিনিময়ে শুধু সিন্থিয়ার সান্নিধ্য আর তার পাশে বেঁচে থাকার অঙ্গীকার। কী অদ্ভুত এই চাওয়া। যেন স্রষ্টার কাছে মানুষের আকুল প্রার্থনা।
সিন্থিয়াকে ট্রেনের ভেতর আবিষ্কার করে পিরু কিছুটা আশ্চর্য হলো। একই সময়ে একই ট্রেনে করে সে কোথায় যাচ্ছে। ট্রেন নতুন স্টেশনে থামল। পরের স্টেশন জ্যাকসন হাইটস-রুজভেল্ট পিরুর গন্তব্য। আর মাত্র কিছুক্ষণ বাকি আছে গন্তব্যের। সিন্থিয়া কাঁধে রাখা পার্সটি অন্য কাঁধে ঝুলিয়ে দিল। ইতিমধ্যে ট্রেন জ্যাকসন হাইটস-রুজভেল্ট স্টেশনে এসে থামল। অনেক যাত্রীর সঙ্গে সিন্থিয়াও নেমে গেল। পিরু ভিড়ের মধ্যে সিন্থিয়াকে হারিয়ে ফেলল। পিরু সিঁড়ি বেয়ে স্টেশনের নিচ থেকে ওপরের দিকে উঠতে থাকল। আশপাশে যাত্রীদের মাঝে তার স্বপ্নচারিণীকে খুঁজতে লাগল। পেল না কোথাও। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় সে সামনে তাকাল। শুধু আকাশ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। সিঁড়ির শেষে সে ব্যস্ত রাস্তার ওপর গিয়ে উঠল। একটু জোরে পা বাড়িয়ে হাঁটতে লাগল। অনতিদূরে হঠাৎ ভিড়ের মাঝে সিন্থিয়াকে দেখতে পেল। একমনে ময়ূরী ঢঙে হেঁটে চলছে। পৃথিবীর সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে সে আনমনা হেঁটে চলেছে। এই মহা শহরে কত মানুষই তো আসে যায়, কে কার খবর রাখে। পিরুর ভাবনাগুলো যখন মাথার ভেতর এলোমেলোভাবে জড় হচ্ছিল সিন্থিয়া তখন মানুষের ভিড়ের মাঝে হারিয়ে গেল। পিরুও তার গন্তব্যের দিকে পা বাড়াল। (ক্রমশ)
আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন:
নিউইয়র্কের আকাশে বৃষ্টি
পিরু ও তার হলুদ ট্যাক্সি
বাস্তবতার শহরে কাল্পনিক যুবক
বাস্তবতার শহরে কাল্পনিক যুবক-চার