রূপ প্রকল্প ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র

রাশিয়ার পরমাণু গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা
রাশিয়ার পরমাণু গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা

স্বপ্নের শুরুটা হয়েছিল সেই ১৯৬১ সালে। পাবনা জেলার ঈশ্বরদীতে সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয় দেশ স্বাধীন হওয়ারও ১০ বছর আগে। সেই সঙ্গে প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণও করা হয় ২৬০ একর জমি। কিন্তু চিরশত্রু পাকিস্তানের জন্য আমাদের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। ১৯৬৪ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য যে সকল যন্ত্রপাতি জাহাজে করে পাঠানো হয়েছিল, সেই জাহাজ পাকিস্তান তাদের সুবিধার কথা মাথায় রেখে তা চট্টগ্রাম বন্দরে না এনে করাচিতে নিয়ে যায়। আর সে সঙ্গেই বাঙালির স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়ে। কিন্তু বাঙালি জাতি কখনই মাথা নোয়াবার নয়।
তাই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য বর্তমান সরকারের উদ্যোগে ২০১০ সালের ২১ মে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়নের জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশ আর রাশিয়ান ফেডারেশনের মধ্যে পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার বিষয়ক একটি Framework চুক্তি মস্কোতে স্বাক্ষরিত হয়। ধীরে ধীরে বাঙালি জাতি স্বপ্ন বাস্তবায়নের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে যায়। এর ফলশ্রুতিতে ২৫ ডিসেম্বর ২০১৫ সালে পাবনার রূপপুরে দুই হাজার চার শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে রাশিয়ার এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সই করে সরকার। চুক্তি বাস্তবায়নের সময়কাল সাত বছর ধরা হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট ২০২৩ সালে এবং দ্বিতীয় ইউনিট ২০২৪ সালের অক্টোবরে উৎপাদনে সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ৬০ বছর ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে।

ভিভিইআর ১২০০ (VVER 1200) -এর মডেল
ভিভিইআর ১২০০ (VVER 1200) -এর মডেল


বাংলাদেশের জন্য পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। আমাদের দেশে বিদ্যুতের প্রচুর ঘাটতি রয়েছে। দেশের এই বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিকল্প নেই। উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে প্রচলিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে নতুন পথের সন্ধানে যেতেই হবে আমাদের। আর এ ক্ষেত্রে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কোনোই বিকল্প নেই। এশিয়ার বেশির ভাগ জনবহুল দেশ যেমন চীন, ভারত, কোরিয়াসহ আরও অনেক দেশ এর প্রয়োজনীয়তা আগেই টের পেয়েছে এবং পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছে ও করছে। আমরাও আর পিছিয়ে নেই। বিদ্যুৎ একটি দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। দেশের অর্থনীতির সঙ্গে বিদ্যুতের সম্পর্ক খুব ওতপ্রোত হলেও জনসংখ্যার মাত্র ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ সেবা পান। তবেও তা নিরবচ্ছিন্ন নয়। গ্রামাঞ্চলে এর অবস্থা আরও প্রকট। এ অসহনীয় পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা হলে যেকোনো নাগরিকেরই খুশি হওয়ার কথা।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? আর কতটুকুই বা নিরাপদ? জাপানের ফুকুশিমা আর চেরনোবিল দুর্ঘটনার পরে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনে এই প্রশ্নটি আসাটাই স্বাভাবিক। সাধারণ নাগরিকের ভয় পারমাণবিক শক্তির ব্যবহারের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে। বাংলাদেশের সর্বোত্তম নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখেই রাশিয়া তাদের সর্বশেষ আধুনিক প্রযুক্তি ভিভিইআর ১২০০ (VVER 1200) মডেলটি আমাদের দিচ্ছে। বিশ্বের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলো মাথায় রেখেই রাশিয়া তার সর্বশেষ মডেলের আধুনিকায়ন করে। আর তাই সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই বাস্তবায়িত হচ্ছে রূপপুর প্রকল্প। রাশিয়ার অভ্যন্তরেই নবোভরনেজ ও লেনিনগ্রাদে ভিভিইআর ১২০০ (VVER 1200) মডেলটি চালু করা হয়েছে। খুব শিগগিরই তা থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। ভবিষ্যতে তুরস্ক ও ফিনল্যান্ডসহ বিশ্বের আরও অনেক দেশে এটি ব্যবহার করা হবে। বরং আমাদের জন্য খুশির খবর আমরা রাশিয়ার সর্বাধুনিক প্রযুক্তিটি গ্রহণ করছি।

রাশিয়ার প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ​কেন্দ্রের একটি অংশ
রাশিয়ার প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ​কেন্দ্রের একটি অংশ

নিরাপত্তার সব দিক খুঁটিয়ে দেখেই আমরা এটি নিচ্ছি। ভূমিকম্পের রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প ধারণ ক্ষমতা রয়েছে সর্বশেষ আধুনিক এই মডেলটির। আর পাবনা জেলাতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প হলো ৭.৮ রিখটার স্কেল। যার কেন্দ্রস্থল ছিল নেপালে। বাংলাদেশের ভূমিকম্পের ইতিহাসে এই মাত্রার ভূমিকম্প বিরল। আর রাশিয়ান কোম্পানি রোসাটোম থেকে এও বলা হয়েছে এই মডেলটি যে কোনো ধরনের বিমান হামলা থেকেও রক্ষা পেতে সক্ষম। পৃথিবীতে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় তার সিংহভাগ উৎপাদন করে আরেভা ফ্রান্স। আর এর পরেই আছে রাশিয়ার রোসাটম। জনবহুল দেশের কথা মাথায় রেখেই সম্পূর্ণ নিরাপত্তা সংবলিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হবে বাংলাদেশে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। অনেকের ধারণা এই সব বর্জ্য বাংলাদেশের কোনো এক অংশে মাটিতে পুঁতে ফেলা হবে। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে এই কাজ করাটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই বাংলাদেশের জন্য কঠিন এই কাজটির দায়িত্ব নিয়েছে রাশিয়া। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত ইউরেনিয়ামের বর্জ্য রাশিয়া তাদের নিজেদের তদারকিতে রাশিয়ায় ফেরত নিয়ে যাবে। আর নিরাপদ ও নির্ভরশীলতার ব্যাপারে রাশিয়ার বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো আন্তর্জাতিক মান নির্ণয়কারী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির (IAEA) মান অনুযায়ীই তৈরি করা হয়েছে। তাই আমাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। রাশিয়াকে উন্নত পরমাণু শক্তির পথিকৃৎ বলা হয়ে থাকে এবং তারা তাদের উন্নত এই প্রযুক্তিটি আমাদের শেয়ার করছে বলে আমরা তাদের ধন্যবাদ জানাই।

রাশিয়ার পরমাণু গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা
রাশিয়ার পরমাণু গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা


সর্বশেষেও একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, আর তা হচ্ছে বাংলাদেশের এত বড় প্রকল্পটির রক্ষণাবেক্ষণ কে করবে? কীভাবে করবে? রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর দক্ষ জনশক্তি তৈরির লক্ষ্যে রাশিয়ায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্রতি মাসে কয়েকটি দল কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে রাশিয়াতে আসছে। আরও দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য সারা বাংলাদেশ থেকে বাছাই করে তিন বছর মেয়াদি মাস্টার্স প্রোগ্রাম এবং পাঁচ বছর মেয়াদি স্পেশালিস্ট প্রোগ্রামে রাশিয়াতে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যারা তাদের পড়াশোনা শেষ করে দেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে তাদের অর্জিত জ্ঞান ও মেধা কাজে লাগাবেন। তারা মুখিয়ে আছে দেশের ইতিহাসের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিজেদের সবটুকু দিয়ে কাজ করার জন্য। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হওয়ার পরের কয়েক বছর প্রকল্পটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাশিয়া সাহায্য সহযোগিতা করবে। কিন্তু সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন বাংলাদেশের প্রকৌশলীরাই দেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ অর্জন করবে অগ্রযাত্রার নতুন এক মাইলফলক। শাবাশ বাংলাদেশ, এ অবাক পৃথিবী তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবুও মাথা নোয়াবার নয়। বিশ্বায়নের এই যুগে সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের হাত ধরে বাংলাদেশ পৌঁছে যাবে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদিত দেশগুলোর মধ্যে। তারুণ্যে ভরপুর ভবিষ্যতের পরমাণু প্রকৌশলীগণ অপেক্ষায় আছেন নতুন বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে। রাত পোহাবার আর বেশি দেরি নেই পাঞ্জেরী।

(মো নিজাম উদ্দিন: শিক্ষার্থী জাতীয় পরমাণু গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া)