মধ্যরাতে মনে পড়ে গ্রামের কথা

লেখকের গ্রামে বড় পুকুরের পাশ দিয়ে পথ
লেখকের গ্রামে বড় পুকুরের পাশ দিয়ে পথ
লেখকের গ্রামে ধানখেত
লেখকের গ্রামে ধানখেত

মেঘলা আকাশ। মধ্যরাত। হাজারো রাতের মতো এ রাতটিও শেষ হয়ে যাবে। তার আগে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অনুভব করছি রাতকে। দূর থেকে দক্ষিণা মৃদু বাতাস এসে লাগছে গায়ে। কুয়ালালামপুরে অনেক দিন পর এমন ভালো লাগা একটি রাতের দেখা পেলাম।
এ রকম রাতে মনে পড়ে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। দেশের কথা। গ্রামের মাটি, গন্ধ ও বাতাসের কথা। রাতের বাতাস। রাতের খাবার খেয়ে বাড়ির কাছে রাস্তার পাশে বন্ধুদের সঙ্গে বসে গল্পগুজব করার কথা। রাস্তা ঘেঁষে ধানখেত। নাকে এসে লাগত ধান খেতের মাটির গন্ধ ও বাতাস। ঝিরিঝিরি বাতাস। জ্যোৎস্না রাত। কী যে ভালো লাগা ছিল। অনেক দিন ধান খেতের পাশে বসে গল্প করা হয় না।
আসলে আমাদের গ্রামটা ছিল শিল্পীর আঁকা ছবির মতো সুন্দর। গ্রামের বুক চিড়ে বয়ে গেছে কিছুটা আঁকাবাঁকা মেঠো পথ (এই মেঠো পথ আর থাকছে না। অনেক দেনদরবারের পর রাস্তাটি পাকা হচ্ছে এখন। তাও অর্ধেক রাস্তা)। দুই পাশে সারি সারি বাড়ি। বাড়ির পরে ধানখেত। আবারও বাড়ি। আবারও ধানখেত। এভাবে বয়ে গেছে অনেক পথ। ছোট্ট খালও আছে একটি। যে খাল দিয়ে আমাদের বাড়ির পানি, জমির পানি, অতি বৃষ্টির পানি এক খাল থেকে আরেক খাল হয়ে ঘুরে ঘুরে কর্ণফুলী নদীতে পৌঁছে যায়। সেখান থেকে সোজা বঙ্গোপসাগরে।

লেখক
লেখক

আর বাড়ির অদূরেই পাহাড়। এর নাম দেয়াং পাহাড়। আমাদের শৈশবের দেয়াং পাহাড়। এই দেয়াং পাহাড়ের বুকে শৈশবের কত সময় কেটেছে। দেয়াং পাহাড়ের এখন আর আগের রূপ নেই। এর এক পাশে বিমানবাহিনীর রাডার কেন্দ্র। অন্য পাশে কোরিয়ান ইপিজেড হয়েছে।
সব বাড়ির সামনে বা পেছনে ছোট ছোট পুকুর ছিল আগে। ছোট ছোট পুকুরগুলোর সব নেই আর। ক্রমবর্ধমান পরিবারের সদস্যদের থাকার ঘর বানানোর জন্য ভিটেমাটি বাড়াতে পুকুর ভরাট করা রেওয়াজ হয়ে গেছে এখন। পুকুর থাকাটা বিলাসিতার মতো। শিল্প-কারখানা গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়াতে জায়গার দাম বেড়ে গেছে তরতর করে। তাই এখন আর পুকুর রাখছে না আমাদের গ্রামের মানুষ।

বড় পুকুরের এক পাশে তালগাছ
বড় পুকুরের এক পাশে তালগাছ

পাড়ার মাঝখানে বড় পুকুর। বড় হওয়াতে এটাকে মানুষেরা দিঘিও বলে। এ পুকুরে এখন মাছ চাষ হয়। খাবার দিয়ে মাছ তাড়াতাড়ি বড় করা হয়। আগে এমন ছিল না। তখন মাছকে খাবার দিত না কেউ। মাছেরা নিজেরা কষ্ট করে খাবার জোগাড় করে খেয়ে বড় হতো মানুষের জন্য। অনেক স্বাদের ছিল মাছগুলো। এখন আর সেই স্বাদ নেই। পুকুরের এক কোনায় জামে মসজিদ। বড় পুকুরে চার-চারটি সান বাঁধানো ঘাট আছে। পুকুরের পশ্চিম ও দক্ষিণ পাশে বাড়ি। উত্তরে ধানখেত। পূর্বদিকেও ধানখেত। বাড়ির বুক চিড়ে পুকুরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণ ঘেঁষে বয়ে গেছে গ্রামের রাস্তাটি। পুকুরের পূর্ব পাড়ের দক্ষিণ পাশে বহু বছর ধরে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেক লম্বা একটি তালগাছ। মজার ব্যাপার হচ্ছে এ তালগাছটি ৩০ বছর আগে যত বড় দেখেছি, এখনো তা-ই আছে। ৩০ বছর ধরে তালগাছটির কোনো পরিবর্তন নেই। গাছটি প্রতিবছরই শরৎ​কালে পাকা তাল বিলিয়ে যায় গ্রামবাসীকে। পাড়ার একমাত্র গাছটি বছরের পর বছর নিজের ফলন দিয়ে উপকার করছে মানুষের।
গ্রামের মেঠো পথ যেতে-যেতে সংযোগ হয়েছে উপজেলার বড় পাকা রাস্তার সঙ্গে। যে রাস্তা ধরে শহরে যায় গ্রামের মানুষ। অন্য পাশে আবার কর্ণফুলী নদী পার হলেই চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর। শাহ আমানত থেকে বিমানে চড়েই এই কুয়ালালামপুর শহরে দূর পরবাসের এগারো তলার এ বাসার ব্যালকনিতে।
সামান্য এ লেখাটি লিখতে লিখতে জীবনের অনেকগুলো রাতের মতো স্নিগ্ধ এ রাতটিও গড়িয়ে যাচ্ছে সকালের দিকে। আরও একটি নতুন সকাল। শুভ সকাল।