আমার ভেতরটা বড় একাকী ও নিঃসঙ্গ

বাবার সঙ্গে লেখিকা
বাবার সঙ্গে লেখিকা

আজ ১৬ বছর হলো মৃত্যু শব্দটার সঙ্গে আমার পরিচয়। এর আগে শুধু শব্দটা জানা ছিল, কিন্তু কী তার রূপ, তা জানার জন্য কখনো তার কাছাকাছি যাওয়া হয়নি। যেদিন শব্দটা আমার খুব কাছাকাছি এসেছিল, তখনো আমি ভাবছি, এ–ও হয়তো জীবন। জীবনের আরেক প্রতিচ্ছবি, যার সঙ্গে আমার কোনো দিন দেখা হয়নি। আমি তখনো অনর্গল কথা বলে যাচ্ছি—আমার কাঁধে জড়ানো জীবনের সঙ্গে, আমার প্রিয় বাবার সঙ্গে। বলছি, আরেকটু পর সব ঠিক হয়ে যাবে, হসপিটালে সব ঠিকঠাক করা আছে। আমরা সরাসরি হসপিটালে যাব। কিন্তু আমার কথার কোনো উত্তর পাচ্ছিলাম না।

আমার নিত্যদিনের অভ্যাস ছিল, ঘুমিয়ে পড়া আমার প্রিয় কোনো মানুষের বুকের শ্বাস-প্রশ্বাস চেক করা। আমি তো আর ডাক্তার নই যে অন্য কিছু চেক করে বুঝব Is everything ok, or not? তো এটাই ছিল আমার একমাত্র উপায়। সেদিনও ঠিক একইভাবে তা করছিলাম। জীবনে এই প্রথমবারের মতো দেখলাম বাবা শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলছেন না। আমি চিৎ​কার দিয়ে বললাম, বাবা তো নিশ্বাস ফেলছেন না। আশপাশে বসা সবাই আমাকে সরিয়ে দিল বাবার কাছ থেকে। আমি আল্লাহকে বললাম, হে আল্লাহ, আমার পর্যবেক্ষণটা আজকে যাতে ভুল হয়, কিন্তু তা আর হলো না।
বাবার সঙ্গে সারা দিন লেগে থাকা সেই মেয়েকে দূরে সরানোর সেই সাহস এই প্রথম সবাই বুঝি পেল। সারা দিন কত মানুষ যে শুধু একটিবার বাবাকে দেখার জন্য এল। কত মানুষ যে বাবার পায়ের ওপর পড়ে মাফ চাইল। কারণ, তারা কেউ বাবাকে না বলে বাবার জিনিস চুরি করেছে, কেউ আবার রাজনীতির ব্যাপারে বাবাকে কষ্ট দিয়েছে।
এরপর আস্তে আস্তে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। একটা দিনের বিদায় হচ্ছিল। দিন তার নিজের ঘরে ফিরে যাচ্ছে। সঙ্গে বাবাও চলে যাচ্ছেন তাঁর প্রিয় মসজিদের কাছে। পার্থক্য শুধু এটুকু, অন্যদিন বাবা হেঁটে যেতেন, আজ যাচ্ছেন অন্যভাবে। শূন্য দৃষ্টিতে আমি কতক্ষণ যে তাকিয়ে ছিলাম, তা আর বলতে পারব না।
সেই থেকে আমার ভেতরকার রূপটা বড় একাকী, নিঃসঙ্গ ও ডানাভাঙা পাখির মতো। উড়ে যাওয়া পাখির ঝাঁক আজ বড় বেশি ব্যতিব্যস্ত শুধু নিজেদের বাসা বুনতে। তুমি তো জানো না বাবা, তুমি চলে যাওয়ার পর পৃথিবীটা কত স্বার্থপর হয়ে গেছে। তোমার ভালোবাসার মেয়েগুলো কেমন আছে, আজ আর সেটা জিজ্ঞেস করার দরকারও কেউ মনে করে না। জিজ্ঞেস করতে এসে যদি অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। হয়তো বা সেই ভয় তাদের তাড়া করে ফেরে। তাই বলে তুমি দুঃখ পেয়ো না বাবা, তোমার মেয়েরা খুব ভালো আছে বাবা। মায়ের জন্যও তুমি কষ্ট পেয়ো না বাবা। মাকে তোমার ছোট মেয়ে তার সবটুকু দিয়ে ভালো রাখতে চেষ্টা করে।
অনেক ভালো থেকো বাবা, সৃষ্টিকর্তার কাছে এটাই শুধু চাই।