বিয়ের আসরে সিরাজুদ্দৌলা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘চকচক করিলেই সোনা হয় না, বকবক করিলেই জ্ঞানী হয় না।’
আপনার কথা শুনে এই কথাটাই মনে হচ্ছে চাচা।
চমকে উঠলাম, বলে কী এই যুবক! দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের মেয়ের বিয়েতে এসেছি। পল্টনের আনন্দ কমিউনিটি সেন্টারে। শীতের রাত। বরযাত্রীরা এখনো আসে নাই। কনেও বিউটি পারলারে। তাই সর্বত্রই একটু ঢিলেঢালা ভাব। আমি আট-দশজনের এক দঙ্গলে দাঁড়িয়ে কথা শুনছি। কারও সঙ্গেই আগে পরিচয় ছিল না। তবে এসব অনুষ্ঠানে সেটা কোনো বিষয় না। মূল বক্তা কোনো এক মন্ত্রণালয়ের আধা সচিব। ভদ্রলোকের চেহারা ও বলার ভঙ্গি বেশ আকর্ষণীয়। রাজনীতি-বিজ্ঞান শেষ। সবে সিনেমা-সাহিত্য শুরু করেছেন আর সেই সময়েই যুবকের এই কথা।
মানে? বেশ রাগতভাবে আধা-সচিব সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।
শেখ মুজিব মনে মনে স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলেন। স্বাধীনতা না। আপনি শেখ মুজিবের মনের কথা বুঝলেন কীভাবে? তারপর হাইজেনবার্গের আন সার্টিনিটি প্রিন্সিপ্যালকে বলে ফেললেন আইনস্টাইনের থিওরি। আর এখন মৃণাল সেনের আকালের সন্ধানেকে বলছেন সত্যজিৎ রায়ের ছবি। গল্প করার ঢঙে নিরুত্তাপভাবে বলে যায় যুবক।

বেয়াদব ছেলে। বয়সের কারণে দু-একটা নাম না হয় এদিক সেদিক হয়েছে। তাই বলে...।’
বাদ দেন স্যার। আজকালকার পোলাপান। এই সিরাজ তুমি এখান থেকে যাওতো। যেমন বাপ তেমন তার ছেলে...। আরেকজন মধ্যবয়স্ক লোক পরিস্থিতি সামাল দেন।
আমার কৌতূহল হয়। ছিপছিপে একহারা যুবকের পিছে পিছে যাই পরিচিত হতে। সিঁড়ি দিয়ে নামতেই দেখি যুবক আপাদমস্তক চুনকাম ও জড়োয়ায় সজ্জিত এক মধ্যবয়স্ক নারীর সঙ্গে কথা বলছে। আমি পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে কথা শুনি...শোনা যায়।
কেমন আছিস সিরাজ। অনেক দিন পরে দেখা।
ভালো তুমি কেমন আছ খালা।
আর বলিস না। এই বিয়ের জন্য ব্যাংকক যাওয়া পেছাতে হলো। তোর খালুতো মহাখাপ্পা। বাদ দে। আমাকে কেমন লাগছে বলত। শেষ বাক্যটা বলার সময় খালার কণ্ঠস্বর কেমন কিশোরীদের মতো শোনা যায়।
চলে গেছে রূপ রয়ে গেছে ধূপ।
কি বললি?
না বললাম কি সেন্ট দিয়েছ ধূপের গন্ধ আসছে।
কি বলিস এত দামি সেন্ট...।
তোমাকে কেমন লাগছে বলব খালা?
বল।

অলংকরণ: অশোক কর্মকার
অলংকরণ: অশোক কর্মকার

তোমাকে দেখলে রবি বাবু লিখত, ‘আমি সকল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি ছিনতাইকারীর আশায়’ তোমার শরীরে এখন কয় কেজি সোনা আছে খালা।
চুপ কর। আপা এত কষ্ট করল। তাও তুই তোর বাবার মতোই...।
আর কিছু শুনতে পাই না। বরযাত্রী আসার হট্টগোল শুরু হয়ে যায়। সিরাজ নামক যুবকের সঙ্গে পরিচয়টাও স্থগিত হয়ে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হট্টগোল তীব্র হয়। কারণ বরের খালাতো ভাইয়ের শ্যালককে কে নাকি গাধা বলেছে। কাছে গিয়ে দেখি ভদ্রলোক ভীষণ উত্তেজিত। ‘আ-আ-আমাকে বলে গা-গাধা। জা-জা-জানে আমি কে?’ উত্তেজনার কারণেই কিনা কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই মুখ দিয়ে পিচকারীর মতো থুতু বের হচ্ছে। মনে হয় সে কারণেই ওনার ধারে কাছে কেউ নাই।
খুব দ্রুতই হট্টগোল কমে যায়। আমি ভেতরে গিয়ে সিরাজ সাহেবকে খুঁজতে থাকি।
আমাদের খুব গরম লাগছে। ওই বড় স্ট্যান্ড ফ্যানটা আমাদের টেবিলে দিয়ে যান। এক রূপসী তরুণী আহ্লাদী স্বরে আমাকে বলে। আমার সদা ভঙ্গুর সন্মানবোধে মৃদু আঘাত লাগে। এ রকম আদেশের সুরে না বললেইতো…হয়তো রূপসী তরুণীরা আদেশ করতেই অভ্যস্ত…এসব ভাবতে ভাবতেই দেখি দুই সুবেশী তরুণ বিশাল স্ট্যান্ড ফ্যানটা নিয়ে এগিয়ে আসছে। রূপসী তরুণীদের সেবা আমাকে দিয়ে আর হয় না।
খাওয়ার আয়োজন শুরু হয়। সিরাজ সাহেবকে কোনার এক টেবিলে একা দেখে এগিয়ে যাই। নিজের নাম পরিচয় দিই।
ও আপনি তাহলে লাউয়া কুটুম।
মানে? আমি জিজ্ঞেস করি।
লতায় পাতায় আত্মীয়। কিছু মনে করবেন না। আমি এভাবেই কথা বলি। আমার নাম সিরাজুদ্দৌলা। বিয়ের কনে আমার খালাতো বোন।
ও আপনি তাহলে বাংলার শেষ নবাব। পরিহাস সুরে বলি আমি।
হুমম। জানেন ক্যাডেট কলেজে আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর নাম কি ছিল?
কি নাম ছিল?
মীরজাফর।
বলেন কি। বাংলাদেশের কোনো বাবা-মা ছেলের নাম মীরজাফর রাখে এটাইতো জানতাম না।
এভাবেই আলাপ চলতে থাকে। সিরাজ ভাই এমবিএ পাস করে চট্টগ্রামের এক ব্যাংকে চাকরি করছেন। বয়সে আমার চার-পাঁচ বছরের বড় হবেন। তাই খুব সহজেই তুমি করে বলা শুরু করেন। এর মাঝে টেবিলের অন্যান্য আসনও ভরাট হয়ে যায়। টেবিলে রোস্ট রেজালাও এসে যায়।
তুমি আর কী খাবা। শরীরেতো কিছু নাই। সিরাজ ভাই বলেন। আমি একটু হাসি। অপ্রিয় এই বিষয়ে কিছু বলতে চাই না।
ইউরিয়া সার খাইছো কখনো? সিরাজ ভাই আবার বলেন।
মানে?
আরে গরু যদি ইউরিয়া সার খাইয়া মোটা তাজা হতে পারে তাহলে তুমি পারবা না কেন?
টেবিলের ওই পাশে বসা দুই কিশোরী ফিক করে হেসে ফেলে সিরাজ ভাইয়ের কথায়। আমার ভীষণ রাগ হয়। কী কারণে যে এই লোকের সঙ্গে খাতির করতে গেলাম।
জানি তোমার খুব রাগ হচ্ছে। আরে আমিতো মশকরা করলাম। এই কারণেই সবাই আমাকে এড়িয়ে চলে। তবে আমার জীবনে যে কি অপমান...সিরাজ ভাইয়ের গলার স্বর যেন কেমন শোনা যায়। আমার রাগ একটু কমে। আবার টুকটাক কথা শুরু হয়। ওনার ক্যাডেট জীবনের গল্প করতে থাকেন। অসাধারণ রসবোধের কারণেই শুনতে বেশ ভালো লাগে।
খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই আবার হইচই শোনা যায়। এবারের কারণ দামি শাড়ির ওপর রেজালার ঝোল। এর বেশি জানতে আমার আগ্রহ হয় না। সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে ঝুলে থাকি। আর তা ছাড়া যত বেশি ঝামেলা বিয়ে নাকি তত সুখের হয়। খাওয়া শেষ করে দুজনেই নিচে নেমে এলাম।
আপনি কি সব জায়গাতেই এভাবে কথা বলেন? পান খেতে খেতে সিরাজ ভাইকে জিজ্ঞেস করি।
হ্যাঁ। সব জায়গাতেই সত্যি কথাটা সহজভাবে বলি। তবে আগে এ রকম ছিলাম না। সত্যি মিথ্যা কোনো কথাই বলতাম। ক্যাডেট কলেজের পোলাপান আমারে কি বলতো জান?
কি?
হাফ লেডিস।
তাই নাকি আশ্চর্য!
চলো একটু হাঁটি। রাত প্রায় দশটা। আজ শিশির মনে হয় একটু বেশি পড়েছে। গাছের পাতা, মাটি, রাস্তার ধুলো সামান্য ভেজা ভেজা। আমরা বিএনপি অফিসের দিকে আস্তে আস্তে হাঁটি।
আমি যখন ক্লাস ফোরে তখন বাবা আবার বিয়ে করে আমাদের ছেড়ে চলে যান। আমরা চট্টগ্রাম নানার বাড়িতে চলে যাই। সিরাজ ভাই আবার নিজে থেকেই বলা শুরু করেন।
নানা যথেষ্ট ধনী ছিলেন। তাই টাকা–পয়সার সমস্যা বেশি হয় না। কিন্তু মামা–খালারা সব সময় বাবাকে নিয়ে কথা বল​ত। হয়তো ভালোর জন্যই বলত। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি কুঁকড়ে যেতাম। দিন যায়। জালিয়াতির অভিযোগে বাবার চাকরি চলে যায়, জেল হয়। আর কীভাবে কীভাবে যেন খবরগুলি ঠিকই নানাবাড়িতে চলে আসে। ভালো কিছু করলে আত্মীয়রা বলত, ‘বাবার মতো হোস না সিরাজ’ আর খারাপ করলেই বলত ‘যেমন বাপ তেমন ছেলে...রক্তের দোষ।’ লজ্জায় অপমানে মরে যেতে ইচ্ছে করত। আচ্ছা রক্ত পরিষ্কার করার কোনো যন্ত্র কি আছে? এতটুকু বলে পাশের এক দোকান থেকে সিগারেট কিনে ধরান সিরাজ ভাই।
জানি না তোমাকে এত কথা কীভাবে বলছি। হয়তো তোমার সঙ্গে আর দেখা হওয়ার সম্ভাবনা কম বলেই বলতে পারছি। আবার বলা শুরু করেন সিরাজ ভাই।
ক্যাডেট কলেজে গিয়েও সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকতাম। কেউ যেন আমার পারিবারিক ইতিহাস জানতে না পারে। প্রথম বছর কেউ জানেও নাই। কিন্তু কীভাবে কীভাবে যেন সবাই ঠিকই জেনে যায়। বন্ধুরা কখনো কিছু বলত না। কিন্তু তারপরও সব সময় মনে হতো আড়ালে নিশ্চয় সবাই আলাপ করে...হাসে। এর মাঝে বাবার আরও দুটা অপকর্মের কথা প্রকাশ পায়। কী যে লজ্জা, কী যে অপমান। এ সময়ে কতবার যে আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেছি...সাহস হয় নাই। ইউনিভার্সিটি এসে মনে হলো এভাবে বাঁচা যায় না। কঠিন সত্যকে যেমন সহজে স্বীকার করে নেব তেমনি কঠিন সত্য বলতেও দ্বিধা করব না। সেই থেকে...আমার বন্ধু এখন খুব কম...। জানো তিন বছর আগে বাবা মারা গেল। হাসপাতালে খুব অসুস্থ ছিল। ভেবেছিলাম যাব না...এই লোকটার জন্য জীবনে কত অপমান সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু গেলাম এবং আশ্চর্য কী জান, লোকটার প্রতি একটুও রাগ, ঘৃণা হলো না...একটু করুণাই হলো। বাবার শেষ চার দিন আমি হাসপাতালেই ছিলাম। কথা বলার অবস্থায় ছিল না বাবা। কিন্তু চোখের তারায় কী যে আকুতি...এতটুকু বলতেই এক ছেলে হন্তদন্ত হয়ে এসে বলে, ‘তুমি এখানে সিরাজ ভাই। খালাম্মা, মামা সবাই তোমাকে খুঁজছে। তাড়াতাড়ি আস।’
বিদায় নেন সিরাজ ভাই। বাসায় ফিরতে ফিরতে ভাবি জীবন হয়তো কখনো খুব নিষ্ঠুর। তবে সে জীবনকে সহজভাবে নিতে সাহস লাগে। সিরাজুদ্দৌলা ভাইয়ের তা আছে।