স্বপ্নময় মরুভূমি

অনেক অনেক দিন আগে থেকেই মরুভূমি মানুষের মনে সৃষ্টি করেছে অদ্ভুত এক আকর্ষণ। কেউ বাড়িতে ফায়ার প্লেসের পাশে বসে পড়েছে মরুভূমিসংক্রান্ত বই, কেউ লিখেছে কবিতা, আবার কেউ তর্ক জুড়ে দিয়েছে যে মরুভূমির বিপুল বালুরাশির নিচে নিশ্চয়ই আছে বিশাল পরিমাণ খনিজ সম্পদ। এমনকি মরুভূমিকে পোষ মানিয়ে কীভাবে তা সুজলা-সুফলা করে তোলা যায়, এ বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করার মতো মানুষেরও অভাব হয়নি। কিন্তু এমন মানুষ খুবই কম, যারা অভিযানে বেরিয়েছে মরুভূমি আবিষ্কার করতে। অজস্র ধন্যবাদ সেই অতি অল্পসংখ্যক অকুতোভয় মানুষকে, যাদের জন্য তৈরি করা গেছে পৃথিবীর প্রায় সব মরুভূমির মানচিত্র।
এমন অনেক অভিযান চলেছে ঊনবিংশ শতাব্দীতে। সাহারা, সিন্ধু, আরবসহ আফ্রিকা, এশিয়া আর আমেরিকার অনেক মরুভূমি অতিক্রম করেছে মানুষ। এসব অভিযানে অনেক অভিযাত্রী হারিয়েছে তাদের প্রাণ—পিপাসায়, খিদেয়, জ্বরে কিংবা স্রেফ অদৃশ্য হয়ে গেছে; কিন্তু যারা সফল হয়েছে, সারা পৃথিবীর জিয়োগ্রাফিক্যাল সোসাইটি তাদের আবিষ্কারকে করেছে সাদরে বরণ। একটা মরুভূমি তখনো রয়ে গেছে অজেয়—পামির আর পুব তুর্কিস্তানের মাঞ্চুরিয়ার মাঝখানের তিন হাজার ছয় শ মাইলজুড়ে থাকা গোবি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গাড়োয়ান আর উটচালকদের বলা ভয়ংকর সব গল্পের কারণেই সম্ভবত অভিজ্ঞ অভিযাত্রীরা এড়িয়ে গেছে গোবিকে, অনেকে আবার সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করেছে যে এটা একটা শয়তানের রাজ্য।
অবশেষে এগিয়ে এল নিকোলাই মিখাইলোভিচ প্রেজেভ্যালস্কি নামের একজন রাশিয়ান। কুলজা থেকে লোপ নোর আর কানলান পবর্তমালাব্যাপী এই ঊষর ভূখণ্ড অতিক্রমের ভার নিল সে; দীর্ঘ অভিযানে নিকোলাই চালাবে এক নিখুঁত, পুঙ্খানুপুঙ্খ জরিপ। আরও অনেক রাশিয়ান অভিযাত্রী ছিল, কিন্তু প্রেজেভ্যালস্কি সবার সেরা। অভিজ্ঞ এই জরিপকারী এশিয়াটিক রাশিয়ায় চালিয়েছে নানা অভিযান, তারপর ফিরে এসে রিপোর্ট পেশ করেছে সাইবেরিয়ান তুন্দ্রা অঞ্চল থেকে আফগানিস্তান সীমান্তের আমুদরিয়া নদী পর্যন্ত কিছু এলাকার উন্নতির সম্ভাবনা নিয়ে।
রাশিয়ান বিজ্ঞান একাডেমি তার এসব অভিযানকে খুব গুরুত্ব দিল যেগুলোর একটা ছিল ‘দ্য গোল্ডেন রোড টু সমরখন্দ’, যখন ঘুরে এসেছে সে তৈমুর লং আর চেঙ্গিস খানের প্রাচীন নগরীতে, আবিষ্কার করেছে ভূগর্ভস্থ ঝরনা আর হ্রদ, কৃষিকাজে এসব কাজে লাগানোর ফলে নিষ্ফলা মরুভূমি সত্যিই আজ হয়েছে সুজলা-সুফলা।
প্রেজেভ্যালস্কিকে পাঠানো হলো কাজাখস্তানের রাজধানী আলমা-আতায়। রাজধানীর অবস্থান রাজ্যের সর্বদক্ষিণ-পুব প্রান্তে, যার সামনেই তুষার-চিত্রিত অপূর্ব তিয়েন শান পর্বতমালা। জারের সময়ে আলমা-আতা ছিল সেনাদের স্থায়ী আবাস, প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ার ফলে সেখানে পাঠানো হতো রাজনৈতিক বন্দীদের। আলমা-আতা একটা ছোট, নির্জন জায়গা, কিন্তু তাতে জরিপকারীর কোনো অসুবিধা হলো না, কারণ সে বুনো গ্রামাঞ্চল ভালোবাসে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে যখনই প্রেজেভ্যালস্কির চোখে পড়ল তিয়েন শানের চুড়োগুলো, তার ভেতরে জাগল পর্বতমালার ওপারের গোবি মরুভূমি অতিক্রমের আকুলতা। সব রাশিয়ানের মতো তার ভেতরেও রয়েছে পুব আর পশ্চিমের প্রতি মিলিত প্রবল টান, কিন্তু তার বেলায় যেন পুবের প্রতি টানটা প্রবলতর। আপন মনে সে বলল, ভৌগোলিক দিক থেকে বিবেচনা করলে সে একরকম গোবিতে এসেই পড়েছে বলা যায়। এখন মাঞ্চুরিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত না এগিয়ে সে কীভাবে ফিরে যেতে পারে?
প্রেজেভ্যালস্কি জানে, এই পরিকল্পনায় আছে কতটা পরিশ্রম আর কতখানি কষ্ট তাকে সহ্য করতে হবে। তার এই অভিযানে লাগবে লম্বা সময়, আর যত সাদাসিধেভাবেই এটার আয়োজন করা হোক না কেন, সরকারি অনুদান আর আর্থিক সাহায্য ছাড়া সে সম্ভবত কুলিয়ে উঠতে পারবে না। তার পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করে সে চিঠি পাঠাল তার কাজের সমর্থক বেশ কয়েকজন পণ্ডিতের কাছে, আর সেসব চিঠির জবাব না আসা পর্যন্ত তার অবসর কাটাতে লাগল বাজারে আর চায়ের দোকানগুলোতে, খোশগল্পে মাতল বশি (উটচালক), গাড়োয়ান আর বারবার মরুভূমি অতিক্রমকারী ফেরিওয়ালাদের সঙ্গে। তারা বহুভাষিক—তুর্কি, কিরঘিজ, চীনা, তিব্বতি, কিন্তু তাদের একটা বিষয়ে মিল—গোবিবিষয়ক আলোচনায় লক্ষণীয় অনীহা। জায়গাটা অশুভ, বলল তারা, সেখানে অসংখ্য কোয়েইদের (ধূলিদানব) আনাগোনা, বালু সেখানে গান গায়, মানুষের নাম ধরে ডাকে আর সারা রাত গোঙায় অপার্থিব সব স্বর। প্রেজেভ্যালস্কি বিস্তারিত জানতে চাইতে, মাথা নাড়াতে লাগল তারা গোমড়ামুখে। না। এর চেয়ে বেশি কিছু তারা জানে না, কারণ, ওটা শয়তানের রাজ্য, পেটের দায় না থাকলে ওই রাজ্য তারা অতিক্রম করত না।
বিক্ষিপ্ত, অনিশ্চিত কিছু তথ্য জোগাড় করল, প্রেজেভ্যালস্কি, কিন্তু তাতে না কমে বরং বাড়ল তার রহস্যময় গোবি আবিষ্কারের কৌতূহল। তারপর যখন একটা চিঠিতে একাডেমি তার পরিকল্পনায় প্রকাশ করল তীব্র আগ্রহ আর বহন করতে চাইল অভিযানের ব্যয়ভার, সে হলো আনন্দে আটখানা। শিগগির সে নেমে পড়ল আয়োজনে, ভাড়া করল এক গাড়োয়ান, যার খচ্চরে টানা গাড়িতে নেওয়া সম্ভব, তার যন্ত্রপাতি আর মালপত্র, প্রথমে সে যাবে আলমা-আতার উত্তর-পুবের কুলজাতে, অর্থাৎ গোবির রাশিয়ান অংশে, তারপর সেখান থেকে পেরোবে তিয়েন শান। পর্বতমালা পেরোনোর পর তার অভিযান হয়ে পড়বে দুর্বোধ্য, যেহেতু গোবির কোনো নিখুঁত মানচিত্র নেই, যন্ত্রপাতিগুলো তার সাহায্যে আসবে নিশ্চয়ই, কিন্তু বেশির ভাগই তাকে চলতে হবে অনুমাননির্ভর হয়ে।
প্রেজেভ্যালস্কি তার অভিযান শুরু করল সুন্দর আবহাওয়ায়, কিন্তু শিগগিরই বইতে লাগল উত্তুরে দমকা বাতাস, তার গাড়োয়ান আর সে ধূসরিত হয়ে গেল বালুর মোটা মোটা দানায়, বুজে গেল নাক, ফলে চোখ বন্ধ করে হামাগুড়ি দেওয়া ছাড়া উপায়ান্তর রইল না। রাত নামতে তাপমাত্রা যখন নেমে গেল শূন্যের নিচে, থামার সিদ্ধান্ত নিল সে, এই পরিস্থিতিতে হাতড়াতে হাতড়াতে এগোনোর কোনো অর্থ হয় না। আর বদমেজাজি তুর্কি গাড়োয়ান বেশ আরামপ্রিয়, ফলে ঢুকে পড়ল সে প্রেজেভ্যালস্কির তাঁবুতে। প্রথমটায় আরেকজন মানুষের বাড়তি উষ্ণতা ভালোই লাগল তার, কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তুর্কির ভেড়ার লোমের কোট থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে উকুন চড়াও হলো তার ওপর।
জ্বালাতনে কাটল নির্ঘুম রাত। ভোর নামতেও বাতাসের বেগ কমল না, যন্ত্রণাদায়ক বালু-ঘূর্ণির মাঝেই অতি ধীরে তারা এগোতে লাগল কুলজা অভিমুখে।
কুলজাকে ‘মরূদ্যান’ বলার মানে হয় না। সত্যি যে এখানকার এলোমেলো কুটিরগুলোর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ইলি নদী, কিন্তু অধিবাসীদের অবিরাম নিক্ষিপ্ত আবর্জনা আর মলমূত্রে তার পানির এমনই করুণ অবস্থা যে ফুটিয়ে ছাড়া তা পানের অযোগ্য। প্রেজেভ্যালস্কি লক্ষ করল, গোবির অধিবাসীরা একেবারেই ভ্রমণকারীদের সঙ্গে আলাপ করতে চায় না। তারা বাস করে তাদের ছোট্ট পৃথিবীতে, সব আগন্তুককে দেখে সন্দেহের চোখে। তিয়েন শান অতিক্রম করার জন্য দরকারি মালবাহক জোগাড়ের ক্ষেত্রে মহামুশকিলে পড়ে গেল প্রেজেভ্যালস্কি । কোনো লোকের দিকে এগোলেই ঘুরে দৌড় দিল সে, যেন তাকে শয়তানে তাড়া করেছে। তাই দেরির জন্য ভেতরে-ভেতরে ফুঁসলেও কয়েক দিন থাকারই সিদ্ধান্ত নিল, ঘনিষ্ঠতা কাজে লাগতে পারে ভেবে। ধারণা সত্য হলো তার। বেশ কিছু লোক সে জোগাড় করে ফেলেল সপ্তাহখানেকের মধ্যেই। গোবির সব বশি, গাড়োয়ান আর মালবাহকদের মতো এদেরও দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। প্রথম শ্রেণি গোমড়ামুখো আর নীচ, সর্বনিম্ন শ্রমের বিনিময়ে হাতিয়ে নিতে চায় সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক: দ্বিতীয় শ্রেণি ভালো শ্রম দেয়, কিন্তু দুহাতে অকাতরে এবং নির্বিকারভাবে দান করে দেয় নিয়োগদাতার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটাও।
তিয়েন শান অতিক্রম মোটেই সহজ হলো না। কারণ, পর্বতমালাটার আপাতশান্ত চেহারার আড়ালেই লুকিয়ে আছে গোপন বিপদ। কোনো ঢাল খুবই খাড়া; কোনো পাথর একজন মানুষের ভার বহন করতেও অক্ষম, গিরিপথগুলো দুর্গম, এসবের পাশাপাশি সার্বক্ষণিক নেচে গেল বাতাস, ছুরির খোঁচার তীব্রতা নিয়ে। প্রেজেভ্যালস্কি অনেক কষ্টে ফিরে যাওয়া থেকে বিরত করল মালবাহকদের। একসময় গিরিপথ পেরিয়ে সংকীর্ণ একটা শৈলশিলার ওপর পা রাখতে সে দেখতে পেল পর্বতের সবুজ পাদদেশ। নতুন আশার সঞ্চার হলো মালবাহকদের মনে, কুলজা থেকে চড়াইয়ের চেয়ে এই উতরাই কষ্টকর হলেও কাজটা সারা গেল মাত্র এক বস্তা খাবার হারানোর বিনিময়ে। রাতের মতো তারা তাঁবু গাড়ল খুদে একটা উপত্যকায়, যেখানে হানা দিতে পারল না বাতাস। যার পাশ দিয়ে বয়ে চলা ছোট একটা ঝরনা তাদের জোগাল সুপেয় পানি। রুচি বদলানোর সুস্বাদু ছোট মাছ—‘মিয়েন’ নামক ম্যাকারনির মতো এক জাতের ফালি খেতে খেতে একদম চড়া পড়ে গিয়েছিল তাদের পেটে। মালবাহকদের পূর্ণ বিশ্রাম দিল প্রেজেভ্যালস্কি। খুশি হয়ে বেশির ভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটাতে লাগল তারা। কিন্তু প্রেজেভ্যালস্কির ঘুম নেই। আলমা-আতা থেকে তার যাত্রাপথের এক নিখুঁত জরিপ করতে লাগল সে।
যাবতীয় তথ্য জোগাড় করে প্রেজেভ্যালস্কি জানল গোবি পেরোনোর জন্য তিনটি কাফেলা পথ অনুসরণ করতে পারে সে। প্রথমটা কারাশার হয়ে দক্ষিণ-পুবে, দ্বিতীয়টি তারফান হয়ে পুবে, আর তৃতীয়টি উরুমশি হয়ে উত্তর-পুবে। তারফানের অবস্থান নাকি পৃথিবীর স্থলভাগের গভীরতম খাদে, তাই সে বেছে নিল দ্বিতীয় পথ। সামনের দিকে তাকাতে গুরু গুরু করে উঠল তার বুকের ভেতরটা। বালুময় মরুভূমি এমনিতেই শূন্য, কিন্তু এখানে ধূসরাভ-কালো নুড়ি বুকে ধারণ করে গোবি যেন হয়ে উঠেছে অশুভ।
চিহ্ন প্রায় মুছে যাওয়া কাফেলা পথটা ধরে চলল তারা কোনোমতে। কখনো হোঁচট খেল আবার কখনো পিছলে পড়ল পায়ের তলা থেকে নুড়ি সরে যেতে। এখানে নেই কোনো পানির গর্ত, নেই কোনো রকম গাছপালার চিহ্ন। সাধারণত ঠান্ডা মেজাজের প্রেজেভ্যালস্কি রেগে আগুন হয়ে গেল যখন সে দেখল যে একজন মালবাহক তার অতি প্রয়োজনীয় মশকটা দান করে দিয়েছে এক যাযাবরকে।
দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যার দিকে আবার উঠল বাতাস, তাঁবুতে শুয়ে-শুয়ে প্রেজেভ্যালস্কি শুনতে পেল গোবির কণ্ঠস্বর। সে জানে যে শব্দগুলো হচ্ছে বাতাস বালিয়াড়িতে আর বালুর গর্তে ধাক্কা খাওয়ার ফলে। তবু এপাশ-ওপাশ করতে করতে আধো ঘুম আধো জাগরণে বোধ হারিয়ে গেল তার। মনে হলো চিত্কার আর গোঙানির ফাঁকে ফাঁকে মরুভূমি যেন স্পষ্ট তাকে বলছে, ‘ফিরে যাও! ফিরে যাও! এটা শয়তানের রাজ্য, এখানে আমরা তোমাদের চাই না।’ সে একজন সাহসী মানুষ, বিপদে অভ্যস্ত, কিন্তু সব রাশিয়ানের মতোই তার ভেতরেও রয়েছে অতীন্দ্রিয়বাদের বিশ্বাস, তাই সকাল না হওয়া পর্যন্ত রইল সে গুটিসুটি মেরে, শরীর ঘেমে একাকার।


পরদিন সে দেখল গোবির মরীচিকা, যা সম্বন্ধে তাকে সাবধান করা হয়েছে আগেই। হঠাৎ তাদের সামনে উদয় হলো এক কাফেলা। প্রথম উটটাকে চালাচ্ছে এক বশি, সেটার পেছনে পেছনে চলেছে আরও ১১টা উট, প্রতিটার পিঠে পণ্যদ্রব্যের গাঁট এবং উটগুলোর পেছনে খচ্চরে টানা গাড়ির সারি। সবকিছু সে দেখতে পেল পরিষ্কার, এমনকি কোনো গাড়োয়ান তুর্কি আর কোনোটা চীনা। তার মালবাহকেরাও দেখতে পেল এই দৃশ্য। অথচ কাছাকাছি যেতেই আচমকা অদৃশ্য হয়ে গেল পুরো কাফেলা। অবিশ্বাসে চোখ পিটপিট করল প্রেজেভ্যালস্কি, তারপর এগিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে পরীক্ষা করল নুড়ি বিছানো পথটা, কিন্তু সেখানে না আছে কোনো খুরের ছাপ কিংবা কোনো চাকার দাগ। এ বিষয়ে সে যখন জানতে চাইল, তার মালবাহকেরা আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাত ছুড়ে দিল শূন্যে। এটা স্রেফ একটা জাদু, ব্যাখ্যা করল তারা, এই জাদু গোবি মাঝেসাঝেই দেখায়!
ধূসর কালো সেই শূন্যতার ভেতর দিয়ে আরও এক সপ্তাহ এগোনোর পর তারা পৌঁছাল তারফানে। দূর-উত্তরে ভেসে আছে ২২ হাজার ফুট উচ্চতার বোগদো-ওলার (ঈশ্বরের পর্বত) বরফমোড়া সব চুড়ো, যার নিচে বেলেপাথরের পাহাড়ের সারি, চীনারা যেগুলোকে বলে ‘আগুনের পাহাড়’ সংগত এক নাম, কারণ, সূর্যালোকে পাহাড়গুলো হয় টকটকে লাল। তাদের পাশ থেকেই নুড়িবিশিষ্ট ঢাল নেমে গেছে সাগরপৃষ্ঠের প্রায় ১ হাজার ফুট নিচের এক গর্তে। দক্ষিণে নোনা জলাভূমির বিশাল বিস্তার, সেগুলোর ওপারে কুরুক তাঘ (শুকনো পাহাড়) নামক পাহাড়শ্রেণি এবং গর্তের তলদেশে তারফান জ্বলছে প্রকাণ্ড এক পান্নার মতো।
তিয়েন শানের বরফ গলে নেমে আসার ফলে এখানে সৃিষ্ট হয়েছে ভূগর্ভস্থ কুয়ো, যেগুলোর পানি ব্যবহার করে কৃষিকাজে চালানো হয় কারেজ (Karez) পদ্ধতিতে, এটার আবিষ্কর্তা পারস্যবাসী, আর পদ্ধতিটা তারা আজও ব্যবহার করে। এখানে যেমন দিতে হয়েছে অনেক শ্রম, তার ফলও হয়েছে আশ্চর্যজনক। তবে কৃষিকাজে লাগলেও কেন যেন ভূগর্ভস্থ এই পানি খাওয়া যায় না।
তারফানই হলো গোবির একমাত্র মরূদ্যান, যা অব্যর্থ এবং নিয়মিতভাবে ফলায় প্রচুর শস্য। গ্রীষ্মে এখানে জন্মে আঙুর, তরমুজ, পিচ আর কুল। বাজারে ঘোরাফেরা করতে করতে গোবির এই রূপের পার্থক্য দেখে প্রেজেভ্যালস্কি বিস্ময় না মেনে পারল না, মনে তার জাগল কবে কোথায় যেন পড়া এক কবিতা—
মরুভূমির বালির মোড়,
চোখে নামায় স্বপন ঘোর...

তারফানের প্রতিটি বাড়ির রয়েছে তলকুঠুরি, গ্রীষ্মকালে পরিবার আশ্রয় নেয় সেখানে। অবসরে ওই ঠান্ডায় বসে তারা খায় রসাল তরমুজ আর শহরের ঠিক বাইরের একটা ঝরনা থেকে আনা পানি। তুর্কি ছোট ছোট ছেলেরা সতেজ এই পানি আনে কাঠের বালতিতে করে, গাধার পিঠে ঝুলিয়ে। এখানে পরিশ্রম ছাড়া কেউ থাকে না, কারণ অলসের জন্য মরুভূমি বিপজ্জনক। প্রেজেভ্যালস্কিও করতে লাগল পরিশ্রম, প্রকাণ্ড এই গর্তের—যা নিশ্চয় সৃিষ্ট হয়েছে খুবই বড় মাপের কোনো ভূমিকম্পে—সম্পূর্ণ আর নিখুঁত একটা জরিপ তাকে করতেই হবে।
মালবাহকদের আবার জড়ো করে সে রওনা দিল দক্ষিণে, বুক ফেটে যেতে চাইল অসহ্য তৃষ্ণায়, জ্বালা করতে লাগল চোখ, চামড়ায় শুরু হলো তীব্র জ্বলুনি। শুকনো পাহাড়শ্রেণির কাছে আসতেও স্বস্তি মিলল না, ঝুরঝুরে কালো বালু সরে যেতে লাগল পায়ের তলা থেকে। এখানে গাছপালা বলতে জীর্ণ নলখাগড়া, বাড়ব্যাহত টামারিস্ক ঝোপ আর বাতাসে সব পাতা ঝরে পড়া নগ্ন সরু পপলার। প্রায় নিশ্চল এই জগতে সচল কেবল কোয়েই, হঠাৎ করে তাদের দিকে তা এগিয়ে এল লম্বা কালো থামের মতো, তাদের কালো বালুতে ঢেকে ফেলে করল দম বন্ধ করার জোগাড়। মরুবাসী শপথ করে বলল যে তারা সব সময় আসে জোড়া ধরে—একটা দানব আর অন্যটা দানবী, শেষমেশ মিলিত হয়, তারপর একত্রে হারিয়ে যায় দুজনে।
দীর্ঘ আর ক্লান্তিকর এই যাত্রার শেষে দলের সবাই হাঁফ ছাড়ল লোপ নোরের মরূদ্যানে পৌঁছে। উর্বরা তারফানের সঙ্গে এই জায়গার পার্থক্য বিরাট, এখানে দেখা গেল লবণাক্ত জলাশয়ে ঘেরা এলোমেলো কিছু কুটির। দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ আর মাটির পাত্রের নানা রকম টুকরা পেয়ে প্রেজেভ্যালস্কি বুঝতে পারল যে একদা এখানে মাথা উঁচু করেছিল গর্বিত এক নগর। অবশ্য অধিবাসীদের কাছ থেকে কোনো তথ্য সে সংগ্রহ করতে পারল না, এরা অনুর্বরা মাটি থেকে জীবিকার কঠিন সংগ্রামে ব্যস্ত, অতীত গৌরবের খেয়ালি গল্পে মাতার সময় এদের নেই।
প্রকৃতপক্ষে লোপ নোরেই তার যাত্রার সমাপ্তি টানতে চেয়েছিল প্রেজেভ্যালস্কি, কিন্তু এখন তার ভেতরে জাগল চীনা দুর্গ কিআয়ুকাওয়ানে যাওয়ার এক অপ্রতিরোধ্য আকুলতা, এই দুর্গ হলো গোবির পুবের প্রবেশদ্বার। মালবাহকদের সঙ্গে মেলা কথা-কাটাকাটি আর বিপুল পরিমাণ ঘুষ দিতে চাওয়ার পর সে রাজি করাতে পারল তাদের, সুতরাং শুরু হলো আরেক মরু অভিযান। শিগগিরই পরিবর্তিত হলো গোবির চেহারা, কালো বালুকে সরিয়ে জায়গা দখল করল হলুদ বালু, কিন্তু হাঁটার অস্বস্তি তাতে মোটেই দূর হলো না। গ্রীষ্ম বিদায় নেওয়ায় দিন এখন সূর্যালোক ঝকঝকে, তবু সূর্যাস্তের পর তাপমাত্রা নেমে গেল শূন্যে। আরও এগোতে উধাও হলো বালু, বহুরঙা নুড়িতে মরুপথটাকে মনে হতে লাগল মোজাইক করা।
মরূদ্যানের শহর তুনওয়াংয়ে পৌঁছাতে সেটাকে বেড় দিয়ে প্রেজেভ্যালস্কি গেল ক্রিসেন্ট মুন হ্রদ দেখতে, যেখানে গান গাইল বালিয়াড়ি, তবলা বাজাল, তারপর ছাড়ল সুরেলা টংকার যেন একসঙ্গে বেজে উঠল অজস্র বেহালা।
পথ সহজ হয়ে এল। বেশ কয়েকটা মরূদ্যান পেরিয়ে উপস্থিত হলো তারা কিআয়ুকাওয়ান, অতীতে যেটাকে বলা হতো কোয়েইমেনকাওয়ান (দানবদের প্রবেশদ্বার)। সুড়ঙ্গ কেটে তেরি খিলানের নিচ দিয়ে ঢুকল তারা শহরে। সফলভাবে শেষ হলো প্রেজেভ্যালস্কির সুদীর্ঘ অভিযান, তারপরও সে তাকাল গোবির অসীম বিস্তারের দিকে। বনবন করে ঘুরতে ঘুরতে ক্রমেই লম্বা হতে লাগল দুই কোয়েই, অজান্তেই বিড়বিড় করতে লাগল সে নরম সুরে—
মরুভূমির বালির মোড়,
চোখে নামায় স্বপন-ঘোর...