গণিত অলিম্পিয়াডের গল্প

কেউ যখন গণিত অলিম্পিয়াড নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করে, বেশির ভাগ সময়ই মূল প্রশ্নের আগে গণিত অলিম্পিয়াডের যত ইতিহাস আছে, সেগুলো নিয়ে অনেক গল্প বলি আমি। তারপর এক–দুই কথায় বলি তার প্রশ্নের উত্তরটা। গণিত অলিম্পিয়াডের একটা অংশ পরীক্ষা, যাকে বলা হয় অলিম্পিয়াড। কিন্তু এই অংশের চেয়েও আকর্ষণীয় অনেক কিছু আছে। সেগুলো না বললে তো গণিত অলিম্পিয়াড কী বোঝা যাবে না। এ তো পরীক্ষার চাইতে অনেক বড় কিছু।
আমার জীবনের বেশ বড় একটা সময় কেটেছে গণিত অলিম্পিয়াডের সঙ্গে। ছাত্র থাকা অবস্থায় অংশ নিয়েছি, পরে কাজ করেছি অ্যাকাডেমিক টিমে। গণিতের গাড়িতে করে দেশ ঘুরে বেড়িয়েছি। গাড়িতে মোহাম্মদ কায়কোবাদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার, মুনির হাসান, তামিম শাহরিয়ার, মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে তুমুল আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে শুনেছি গণিত অলিম্পিয়াডের ইতিহাস, বিবর্তন, লক্ষ্য।
গণিত অলিম্পিয়াডের যাত্রা শুরুর গল্পটা বেশ আগের। ১৯৯৪ সালে দেশে ফেরেন জাফর ইকবাল স্যার। কায়কোবাদ স্যারের সঙ্গে মিলে করেন প্রথম গণিত অলিম্পিয়াডের পরিকল্পনা। অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। আবারও বিষয়টি নিয়ে তোড়জোড় শুরু করেন তাঁরা। ২০০১ সালে সবাইকে গণিত অলিম্পিয়াডের ধারণার সঙ্গে পরিচিত করানোর জন্য প্রথম আলোতে শুরু হয় মজার এক আয়োজন। সাপ্তাহিক এই আয়োজনের নাম ছিল ‘নিউরনে অনুরণন’। প্রতি সংখ্যায় পাঁচটি করে সমস্যা দেওয়া হতো। শিক্ষার্থীরা সেগুলোর সমাধান করে পাঠাত প্রথম আলোর ঠিকানায়। এভাবেই শুরু আজকের গণিত অলিম্পিয়াডের।
‘নিউরনে অনুরণন’ যে একটা সময় এমন ব্যাপ্তি পেয়ে আজকের এই অবস্থায় আসবে, তা কে ভেবেছিল! নিউরনে অনুরণনে সমস্যাগুলোর সমাধান দেওয়া হতো না কখনোই। ফলে, ‘আমার সমাধান ঠিক হয়েছে নাকি ভুল হয়েছে, এটি কীভাবে বুঝব’, এ–জাতীয় প্রচুর অভিযোগ আসতে লাগল। কিন্তু জাফর ইকবাল স্যার ও কায়কোবাদ স্যার এই অবস্থানে অনড় ছিলেন, কোনো অবস্থাতেই সমাধান প্রকাশ করেননি তাঁরা। তবে প্রথম আলোতে পাঠানো কারও সমাধান ঠিক হলে জানিয়ে দেওয়া হতো সেটা। নিউরনে অনুরণনের পর্ব শেষ হয়েছে প্রায় ১৫ বছর আগে, এখনো প্রথম আলোতে এর সমাধান আসে প্রতি সপ্তাহে। পনেরো বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও যে উন্মাদনা রয়ে গেছে, সমাধান জানিয়ে দেওয়া হলে এ রকম চমৎকার একটা ব্যাপার কি আমরা কখনো পেতাম?
সমস্যার সমাধান না দেওয়ার যুক্তিটা এতক্ষণে সবারই বুঝে ফেলার কথা। জাফর ইকবাল স্যারের কথাগুলো তুলে দিই এখানে, ‘এই অঙ্কগুলোর কোনো কোনোটা হবে সোজা, কোনো কোনোটা হবে কঠিন, কোনো কোনোটা হবে ইতিহাস বিখ্যাত, আবার কোনো কোনোটা হয়তো একেবারেই অসাধ্য! এ দেশের ছেলেমেয়েরা সেগুলো করতে গিয়ে চিন্তা করতে শিখবে, সৃজনশীলতা বাড়বে, কল্পনাশক্তির বিকাশ হবে। তারা আবিষ্কার করবে, অঙ্ক করা যতটুকু মজার ব্যাপার, তার থেকে এক শ গুণ বেশি মজা সেই অঙ্কটি নিয়ে চিন্তাভাবনা করা।’
২০০১ সালে শুরু হওয়া নিউরনে অনুরণনের অভাবনীয় সাড়ার পরের যাত্রাটা ধারাবাহিক। ২০০২–এ খুবই স্বল্প পরিসরে একটি গণিত অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হয় প্রথম আলো কার্যালয়ে। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৩ সালে প্রথম জাতীয় গণিত অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হয় সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এরপর থেকেই দুই ধাপে শুরু হয় গণিত অলিম্পিয়াড। প্রথমে বিভাগীয় পর্যায়ে। তারপরে সেখানকার বিজয়ীদের নিয়ে জাতীয় পর্যায়ের গণিত অলিম্পিয়াড। জাতীয় পর্যায়ের বিজয়ীদের থেকে নির্বাচিতদের নিয়ে করা হয় গণিত ক্যাম্প, সেখান থেকে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে (আইএমও) অংশ নিতে বাংলাদেশ দলের সদস্য নির্বাচন।
আইএমওর নিয়ম অনুযায়ী, প্রথম বছর বাংলাদেশ দল অংশগ্রহণ করে পর্যবেক্ষক দল হিসেবে। সেবার মুনির হাসান স্যার একাই গিয়েছিলেন। পরের বছর যায় আমাদের প্রথম দল, ২০০৫ সালে। সে বছর বাংলাদেশ দলের মোট নম্বর ছিল ৩। ২৫২ নম্বরের মধ্যে মাত্র ৩। অন্য কেউ হলে হয়তো হতাশ হয়ে সবকিছু বন্ধ করে দিতেন। কিন্তু জাফর ইকবাল, কায়কোবাদ ও মুনির স্যাররা সাধারণ কেউ নন বলেই রচিত হলো ভিন্ন ইতিহাস।
পাঠক, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ আইএমও দলের মোট নম্বর ছিল ১১৪। ৩ থেকে ১১৪। এই বিশাল পার্থক্য এক দিনে আসেনি, এসেছে ধারাবাহিকভাবে নিয়মিত উন্নতির মাধ্যমে। ২০০৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত নম্বরের ধারাবাহিকতার দিকে একবার চোখ বোলানো যাক—৩, ২২, ৩১, ৩৩, ৬৭, ৫৪, ৫০, ৭৪, ৬০, ৮৪, ৯৭, ১১২, ১১১, ১১৪। এই মোট নম্বরগুলো একটা ব্যাপারই নির্দেশ করে, সমগ্র দলের ধারাবাহিকতা এবং ক্রমে মানোন্নয়ন!
বাংলাদেশ দলের পক্ষে প্রথম একটি সমস্যা সম্পূর্ণভাবে সমাধান করেন শহীদুল ইসলাম, ২০০৬ সালে, ৪৭তম আইএমওতে। আইএমওতে একটি সমস্যার পূর্ণাঙ্গ সমাধান করতে পারলে পাওয়া যায় সম্মানজনক স্বীকৃতি। এরপর সম্মানজনক স্বীকৃতি এসেছে নিয়মিতই। ২০০৯ সালে ৫০তম আইএমওতে সামিন রিয়াসাত ও নাজিয়া নাসের চৌধুরী নিয়ে আসেন বাংলাদেশ দলের ব্রোঞ্জ পদক। একই সঙ্গে দুটি পদক। এরপরে ব্রোঞ্জ পদকও নিয়মিত হয়ে যায়। ৫৩তম আইএমওতে বাংলাদেশ দলের পক্ষে প্রথম রৌপ্য পদক নিয়ে আসেন ধনঞ্জয় বিশ্বাস, ২০১২ সালে। রৌপ্য পদক নিয়মিত হলেও ধরি ধরি করেও আকাঙ্ক্ষিত স্বর্ণপদক আর দেখা দিচ্ছিল না। অবশেষে ২০১৮ সালে, ৫৯তম আইএমওতে বাংলাদেশ দলের হয়ে প্রথম স্বর্ণপদক নিয়ে এল আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরী।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ দলের মোট স্বর্ণপদক ১টি, রৌপ্য ৬টি, ব্রোঞ্জ ২২টি এবং সম্মানজনক স্বীকৃতি ২৭টি।
গণিত অলিম্পিয়াডের মূল লক্ষ্য ছিল সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা যেন গণিতে আগ্রহ খুঁজে পায়, ভালোবাসা খুঁজে পায়, সমস্যা সমাধানের চেয়ে সমস্যাটি নিয়ে অনেক বেশি চিন্তাভাবনা করে, তা উৎসাহিত করা। শুধু আইএমওতে ভালো ফলাফল করা বা পদক অর্জন উদ্দেশ্য ছিল না কখনোই। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ দলের আজকের এই অবস্থান গণিত অলিম্পিয়াডের মূল দর্শনের অনেক ফলাফলের মধ্যে একটা ফল মাত্র।
গণিত উৎসবের সমগ্র পদ্ধতি আরেকবার একটু বলি। ডিসেম্বর মাস থেকে দেশব্যাপী শুরু হয় গণিত অলিম্পিয়াডের আয়োজন। মোট চারটি ক্যাটাগরিতে গণিত অলিম্পয়াডে অংশগ্রহণ করে শিক্ষার্থীরা। প্রাইমারি ক্যাটাগরিতে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি, জুনিয়র ক্যাটাগরিতে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম, সেকেন্ডারি ক্যাটাগরিতে নবম-দশম এবং হায়ার সেকেন্ডারি ক্যাটাগরিতে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা অংশ নেয়। প্রথম পর্যায়ে হয় বিভাগীয় উৎসব। এ জন্য কতগুলো অঞ্চলে ভাগ করা হয় সারা দেশকে। একটি করে বিভাগীয় উৎসব হয় প্রতিটি অঞ্চলে। গত বছর বিভাগীয় উৎসব হয়েছিল ৩০টি, এ বছর ৬৪ জেলাতেই পৃথকভাবে গণিত অলিম্পিয়াডের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।
বিভাগীয় পর্যায়ের বিজয়ীরা এসে অংশগ্রহণ করে জাতীয় উৎসবে। সারা দেশের সব বিজয়ীর মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় আরেকটা পরীক্ষা। প্রাইমারির শিক্ষার্থীদের জন্য দুই ঘণ্টা, জুনিয়রের শিক্ষার্থীদের জন্য তিন ঘণ্টা, সেকেন্ডারি ও হায়ার সেকেন্ডারির শিক্ষার্থীদের জন্য চার ঘণ্টার এ পরীক্ষা হয় উৎসবের প্রথম দিনে। জাতীয় উৎসবের বিজয়ীদের নিয়ে এরপরে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় ক্যাম্প। আবাসিক এই ক্যাম্পে কখনো টানা ৫ দিন, কখনোবা টানা ৭ দিন, আবার কখনো টানা ১০–১২ দিন ধরে চলে গণিত অনুশীলন। ক্যাম্পের ট্রেইনার এবং ফ্যাসিলিটেটর হিসেবে থাকেন গণিত অলিম্পিয়াডেরই পুরোনো ক্যাম্পের সদস্যরা। জাতীয় ক্যাম্পের আরও পরে অনুষ্ঠিত হয় এক্সটেনশন ক্যাম্প এবং তারপরে আইএমও ক্যাম্প। আইএমও ক্যাম্পের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে গঠন করা হয় ছয় সদস্যবিশিষ্ট আইএমও দল।
গণিত অলিম্পিয়াডের প্রস্তুতি নিতে চাইলে ধাপে ধাপে এগোতে হবে সবাইকে। যারা আগে কখনোই গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করেনি তাদের জন্য পরামর্শ হচ্ছে, একদম শুরুতে নিজের বই সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা থাকা, পাশাপাশি নবম-দশম শ্রেণির জ্যামিতি বই পুরোটা পড়ে ফেলতে হবে। এ ছাড়া অনলাইনে Kushtia Math Circle–এর ওয়েবসাইটে অনেক নোট এবং প্রবলেম সেট দেওয়া আছে, এগুলো পড়তে পারো। পাশাপাশি গণিত অলিম্পিয়াডের আগের বছরগুলোর প্রশ্ন ডাউনলোড করতে পারো ওয়েবসাইট থেকে। সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করাও প্রয়োজন। কেউ চাইলে AIME, NIMO, OMO থেকে সমস্যা সমাধান করতে পারো। সঙ্গে সঙ্গে সমস্যা সমাধানের দর্শন বোঝার জন্য এবং ধারাবাহিকভাবে চিন্তাশক্তির উন্নয়ন করতে চাইলে মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং মুহাম্মদ কায়কোবাদের নিউরনে অনুরণন এবং নিউরনে আবারো অনুরণন বই দুটি পড়া মোটামুটি অপরিহার্য। বাড়তি প্রস্তুতি হিসেবে কেউ চাইলে দেখতে পারো brilliant.org বা expii.com ওয়েবসাইটের বিষয়গুলোও।
পরের ধাপটা আরেকটু কঠিন। কিছু সমস্যা সমাধানভিত্তিক বই সম্পূর্ণ পড়ে ফেলতে হবে এ ধাপে। বাংলা বইয়ের মধ্যে প্রাণের মাঝে গণিত বাজে, একটুখানি গণিত, ম্যাথোস্কোপ খুবই চমৎকার বই শুরু করার জন্য। ইংরেজি বইয়ের মধ্যে ‘The Art & Craft of Problem Solving’, ‘104 Number Theory Problems’, ‘Principles & Techniques of Combinatorics’, ‘Plane Euclidean Geometry’—এইগুলো হচ্ছে একদম শুরুর দিকের বই। অলিম্পিয়াডের সমস্যাগুলো মূলত চারটি অংশ থেকে করা হয়, Algebra, Number Theory, Combinatorics ও Geometry। কাজেই পৃথকভাবে এই চারটি বিষয়ের জন্যই গড়ে তুলতে হবে দক্ষতা। আমাদের উপমহাদেশীয় অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা মূলত কারিকুলামের কারণেই জ্যামিতিতে স্বাভাবিকভাবে অধিকতর দক্ষ হয়ে থাকে। তাই আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অনেক দেশের চেয়ে জ্যামিতিতে আমাদের ফলাফল তুলনামূলকভাবে ভালো।
এর পরের ধাপটা পুরোপুরিই আত্মনির্ভর। কেউ যখন এই ধাপগুলো পার হয়ে আসবে, তখন আস্তে আস্তে আরও অনেক কিছু সম্পর্কেই জানবে সে। সম্যক ধারণা পাবে বিভিন্ন ম্যাগাজিন, ফোরাম, ওয়েবসাইট ইত্যাদি সম্পর্কে। দেশের অন্যান্য প্রতিযোগীর সঙ্গে বাড়বে যোগাযোগ। বাইরের দেশের প্রতিযোগীদের ফলাফল, তাদের শক্তিশালী বিষয়, দুর্বল বিষয়, আমাদের দুর্বলতা সম্পর্কে জানাশোনা হবে। আর এগুলো ধরে রাখতে পারলে ভালো কিছু আশা করা যেতেই পারে।
এ–সংক্রান্ত প্রচুর তথ্য এবং রিসোর্স রয়েছে অনলাইনে। সাহায্য করার জন্য আছে বিডিএমও ফোরাম। এর বাইরেও বিভিন্ন অলিম্পিয়াডের পুরোনো অংশগ্রহণকারীরা তো বসেই আছেন সাহায্য করার জন্য। আরও জানতে চাইলে আইএমওতে অংশগ্রহণকারী আদীব হাসান ও তারিক আদনানের গণিত অলিম্পিয়াডে প্রস্তুতি–সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা আকারে নোট আছে ফেসবুকে। প্রতিটি বিষয়ের জন্য আলাদাভাবে সেটাও পড়ে দেখতে পারো। খুবই উপকারী এবং চমৎকারভাবে গোছানো আছে প্রতিটি নোট।
তো মোটামুটি ধারণা তো আমাদের হয়েই গেল। গণিত অলিম্পিয়াডের শুরু, পথচলা, কীভাবে কাজ করে, প্রস্তুতি কীভাবে নেব—এ সব নিয়ে ধারণা হয়ে গেলে বাকি থাকে শুধু একটাই, প্রস্তুতি নেওয়া আর অংশগ্রহণ। তাহলে শুরু করা যাক!
গণিত অলিম্পিয়াডের স্লোগানটা জানো তো?—গণিত শেখো, স্বপ্ন দেখো।

লেখক: একাডেমিক কাউন্সেলর, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড