প্রাণ ও প্রকৃতির শিল্পী

তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। এক ভবঘুরে বাঙালি যুবক ঘুরে বেড়াচ্ছেন কাশ্মীরের পথে-প্রান্তরে, পাহাড়ে-জঙ্গলে। আদিবাসীদের সঙ্গে দারুণ সখ্য তাঁর। তাদের সঙ্গেই থাকেন, খান, ঘুরে বেড়ান আর ছবি আঁকেন। ভারতবর্ষের গ্রাম-প্রকৃতি, গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ তাঁর ছবির বিষয়বস্তু। সেসব ছবি তিনি বিক্রি করেন যুদ্ধরত সৈনিকদের কাছে। সৈনিকেরা ছবি কেনেন, দু–চার টাকা দেন, তা দিয়েই সেই ভবঘুরে যুবকের পেট চলে যায়। এরই মধ্যে সিমলায় তাঁর ছবির প্রথম প্রদর্শনী হয়ে যায়। তবু শিল্পীখ্যাতি তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। সেই ভবঘুরে শিল্পীই পরে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন। তাঁকে বসানো হয় বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পীর আসনে। তিনি শেখ মোহাম্মদ সুলতান। লোকে তাঁকে চেনে এস এম সুলতান নামে।
এস এম সুলতানের ছোটবেলাটা বড় সুখের ছিল না। ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট তাঁর জন্ম। বর্তমান নড়াইল জেলার মাসিমদিয়া গ্রামে, চিত্রা নদীর পাড়ে। বাবা শেখ মোহাম্মদ মেসের আলীর মূল পেশা কৃষি। শুধু চাষবাস করে সংসার চলে না। তাই রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। মাঝে মাঝে ঘরামিগিরিও করেন। ঘরামি কি জানো তো? আগে গাঁয়ের বেশির ভাগ ঘর ছিল মাটির তৈরি। সেসব ঘরের ছাউনি দেওয়া হতো খড় দিয়ে। খড় দিয়ে ছাউনি দেওয়ার কাজটা সবাই পারত না। যিনি পারতেন, তাঁকে বলা হতো ঘরামি। রাজমিস্ত্রিদের কাজে পদে পদে শিল্পের ছোঁয়া। বাবা যখন লোকের দালানবাড়ি তৈরি করতেন, সেসবে কত কারুকাজ, নকশা করতে হয়। শিশু সুলতান যেতেন বাবার পিছু পিছু। বাবার কাজ মুগ্ধ হয়ে দেখতেন। বাবার সেই পেশাই সুলতানের ভেতরে শিল্পীসত্তার জন্ম দেয়।

রাজমিস্ত্রি হলেও সুলতানের বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। তবু তাঁকে ভর্তি করানো হয় নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে। তখন সুলতানের বয়স ১০ বছর। একদিন স্কুল পরিদর্শনে আসেন ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। সুলতান তাঁর একটা স্কেচ এঁকে তাক লাগিয়ে দেন। কিন্তু স্কুলের বাঁধাধরা নিয়ম সুলতানের ভালো লাগে না। তাই কিছুদিনের মধ্যেই লেখাপড়া ছেড়ে দেন। বাবার সঙ্গে যোগ দেন রাজমিস্ত্রির কাজে। দালানে–বাড়িতে বাবার আঁকা নকশা তাঁর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। এর মধ্যেই চলে তাঁর অঁাকাঅঁাকি। বাবা জমিদারবাড়ির দালান তৈরি করেন। সেই দালানে মনের মাধুরী মিশিয়ে নকশা আঁকেন। বাবার সঙ্গে ছেলেও হাত লাগান। জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাবা-ছেলের কাজে মুগ্ধ। তিনি সুলতানের ছবি আঁকার শখের কথা জানতে পারেন। তাঁর ছবি আঁকাআঁকির কিছু নমুনাও দেখেন। দেখে মুগ্ধ হন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সুলতানকে নিয়ে যান কলকাতায়। ভর্তি করিয়ে দেন কলকাতা আর্ট স্কুলে। সেখানে ভর্তি হওয়ার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা সুলতানের ছিল না। সেই স্কুলের পরিচালানা পর্ষদের সদস্য ছিলেন শিল্পাচার্য শাহেদ সোহরাওয়ার্দী। তিনিই বিশেষ বিবেচনায় সুলতানকে আর্ট স্কুলে ভর্তি করে নেন। জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আরেকটা বাড়ি ছিল কলকাতায়। সেই বাড়িতেই সুলতানের থাকার ব্যবস্থা হয়। কিন্তু সুলতান বরাবরই স্বাধীনচেতা মানুষ। আর্ট স্কুলের ধরাবাঁধা নিয়ম তাঁর ভালো লাগে না। ভালো লাগে না কলকতার বদ্ধ পরিবেশও। তিন বছর সেখানে কাটিয়ে একেবারে শেষ বছরে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে ফিরে আসেন গ্রামে।
গ্রামেও বেশি দিন থাকেননি সুলতান। ১৯৪৩ সালে চলে যান কাশ্মীরে। সেখানকার প্রকৃতি ও আদিবাসীদের জীবন তাঁকে গভীরভাবে আকর্ষণ করে। সেসবই ফুটিয়ে তোলেন নিজের চিত্রকর্মে। ১৯৪৬ সালে সিমলায় হয় তাঁর চিত্রকর্মের প্রথম প্রদর্শনী। কানাডিয়ান শিল্পপ্রেমী মিসেস হাডসন সেই প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। পরের বছর দেশ ভাগ হয়। সুলতান ফিরে আসেন গ্রামে। সেখান থেকে চলে যান তত্কালীন পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে। সেখানকার এক স্কুলে আর্টের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। অনেক নামীদামি শিল্পীর সঙ্গে সুলতানের পরিচয় হয় তখন। লাহোর ও করাচিতে দুটি প্রদর্শনীও হয়। সেখান থেকেই এক শিল্প সম্মেলনে যোগ দিতে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। সেটা ১৯৫০ সালের কথা। সেখানেই একের পর এক হয় তাঁর চিত্র প্রদর্শনী—নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, শিকাগো ও বোস্টনে। এরপর লন্ডনে তাঁর চিত্র প্রদর্শনী হয়। ইউরোপজুড়ে কুড়িটির মতো চিত্র প্রদর্শনী হয় তাঁর। পাবলো পিকাসো, সালভাদর দালির মতো বিখ্যাত চিত্রকরদের অাঁকা ছবির সঙ্গে সুলতানের ছবি প্রদর্শিত হয়। কিছুটা আন্তর্জাতিক খ্যাতি জোটে সুলতানের কপালে। কিন্তু সে পর্যন্তই। বাংলাদেশের মানুষ তখনো তাঁর গুণের খবর পায়নি।
১৯৫৩ সালে ঢাকায় ফেরেন সুলতান। ঢাকায় একটা চাকরির খোঁজও করেন। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ছিল না বলে ঢাকায় চাকরি মেলেনি। ফিরে যান নড়াইলে নিজের গ্রামে। নিজের এলাকায় একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করার খুব ইচ্ছা। তার জন্য ভালো একটা জায়গা চাই। সুলতান গ্রামকে, প্রকৃতিকে ভালোবাসেন। গ্রামে প্রকৃতির খুব কাছাকাছি হোক স্কুলটা, সুলতান তা-ই চাচ্ছিলেন। অনেক সন্ধান করেন। চাচুড়ী ও পুরুলিয়া গ্রামের মাঝামাঝি জায়গায় একটা ভাঙা জমিদারবাড়ির খোঁজ পান। সেটা সুলতানের পছন্দ হয়। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত করেন ‘নন্দনকানন প্রাথমিক বিদ্যালয়’ এবং ‘নন্দনকানন ফাইন আর্টস স্কুল’। পরে আর্ট স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়টি এখনো চালু আছে ‘চাচুড়ী পুরুলিয়া প্রাথমিক হাইস্কুল’ নামে। আর্ট স্কুলটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে অনেকটা অভিমান নিয়েই সুলতান চলে যান নড়াইলে। সেখানেই চলে তাঁর শিল্পচর্চা।
তাঁর ছবিতে গ্রামীণ সমাজের প্রকৃতি ও কৃষকদের জীবনচিত্রই উঠে এসেছে বারবার। বাংলার মাঠ, ফসলের খেত, টলটলে নদী, দাঁড় বাওয়া মাঝি, মাছ শিকারি জেলে, গাঁয়ের বধূ এবং বলিষ্ঠ কৃষকের ছবি এঁকেছেন তিনি পরম মমতায়। কৃষকদের ছবি তিনি এঁকেছেন পেশিবহুল শক্তিশালী পুরুষের রূপে। এদেশের কৃষকরা মোটেও তাঁর ছবির মতো শক্তিমান পুরুষ ছিলেন না সেকালে। কিন্তু যে কৃষকেরা আমাদের অন্ন জোগান, দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি যাঁরা, তাঁদের সুলতান বলিষ্ঠ, শক্তিশালী করে অাঁকতেই ভালোবাসতেন। শুধু কৃষকেরা নয়, গাঁয়ের গৃহিণীদেরও তিনি বলিষ্ঠ চেহারায় এঁকেছেন। অবশ্য দুটো নেতিবাচক ছবিও তিনি এঁকেছেন। সেই ছবি দুটো হলো হত্যাযজ্ঞ ও চর দখল। এঁকেছেন বন্যায় বিপর্যস্ত মানুষের ছবিও।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যাঁর এতগুলো চিত্র প্রদর্শনী হয়ে গেছে, ঢাকার শিল্পসমাজে তিনি অচেনাই রয়ে যান ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত। এর একটা বড় কারণ তাঁর ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগহীনতা। আসলে শহুরে জীবন কখনোই সুলতানের ভালো লাগেনি। ঢাকায় এসে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার তাগিদও তাঁর ছিল না। ১৯৭৬ সালে ঢাকার শিল্পসমাজে এস এম সুলতানের স্বীকৃতি মেলে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি তাঁর অাঁকা ছবি নিয়ে একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করে সে বছর। এরপর থেকেই দেশব্যাপী এই মহান শিল্পী ব্যাপক পরিচিতি পান।
এস এম সুলতান ছবি অাঁকতেন জলরং ও তেলরঙে। কিন্তু তাঁর কাগজ আর রঙের মান ছিল খুব সাধারণ। কিছু কিছু ছবি তিনি কয়লা দিয়েও এঁকেছেন। তাই তাঁর অনেক ছবিই নষ্ট হয়ে গেছে। এ বিষয়ে সুলতান সচেতনও ছিলেন না। সুলতান শুধু শিল্পীই ছিলেন না, তিনি সংগীত ভালোবাসতেন। খুব ভালো বাঁশি বাজাতে পারতেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে শিল্পের বীজ ছড়িয়ে দিতে যশোরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘একাডেমি অব ফাইন আর্টস কলেজ’। এখন সেটা ‘চারুপীঠ’ নামে পরিচিত।
১৯৮১ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট’ সম্মাননা প্রদান করে। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদকে ভূষিত করে। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি তাঁকে ‘আর্টিস্ট অব রেসিডেন্ট’ ঘোষণা করে। ১৯৯৪ সালে ঢাকার ‘গ্যালারি টোন’-এ শেষবারের মতো তাঁর চিত্র প্রদর্শনী হয়। সে বছরের ১০ অক্টোবর তিনি যশোরে মৃত্যুবরণ করেন।