মিস্টার অ্যান্ড মিস প্রাথমিক চিকিৎসক

ভেজা হাতে সুইচ স্পর্শ করলে শক তুমি খেতেই পারো
ভেজা হাতে সুইচ স্পর্শ করলে শক তুমি খেতেই পারো

কম্পিউটার অন করতে গিয়ে, সিপিইউতে পেনড্রাইভ ঢোকাতে গিয়ে কিংবা মোবাইলে চার্জ দিতে গিয়ে ছোটখাটো শক তো ডালভাত। কিন্তু ব্যাপারটা যদি তোমার আশপাশে কারও ক্ষেত্রে ছোটখাটো না হয়ে খানিকটা বড় লম্বা হয়ে যায়, তখন তুমি কী করবে, সেটা জানো তো? জানলে তুমিও বনে যেতে পারবে প্রাথমিক চিকিৎসক!

মনে রাখবে, শক আক্রান্ত ব্যক্তিকে সবার আগে যেটা করতে হবে, সেটা হলো, তাকে সংযোগ থেকে সরিয়ে আনা। দ্রুত বৈদ্যুতিক সুইচ বা বাড়ির মেইন সুইচটি অফ করে ফেলতে পারলে কাজটা সত্যিই সহজ হয়ে যাবে। আর কখনোই যেটা করবে না, সেটা হলো, আক্রান্ত ব্যক্তিকে খালি হাতে ধরা। রাবারের স্যান্ডেল পরে কম্বল দিয়ে চেপে তাকে সরানো বুদ্ধিমানের কাজ। এটা লক্ষ রাখতে হবে, নিজের শরীর যেন ভেজা না থাকে। অথবা শুকনো কাঠের টুকরা দিয়েও তাকে বৈদ্যুতিক উৎস থেকে সরিয়ে নিতে পারবে।

এরপর শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃৎস্পন্দন পরীক্ষা করে দেখতে হবে। মাথাকে দেহের তুলনায় নিচে রাখতে হবে, এবং পা ওপরে তুলে ধরতে হবে। শরীরের পুড়ে যাওয়া অংশ বরফ, অয়েন্টমেন্ট বা তুলা দিয়ে ব্যান্ডেজ করা উচিত নয়। বরং জরুরি ভিত্তিতে তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

তোমরা যারা গ্রামে থাকো, তারা তো হরহামেশাই পুকুর-নদীতে গোসল করতে পারো, কিন্তু শহরের ছেলেমেয়েদের সে সুযোগ নেই বললেই চলে। তবে অনেকে সুইমিংপুলে সাঁতার শিখতে বা কাটতে যাও। তোমাদের কাউকেই ভয় দেখানোর জন্য বলছি না, বলছি মানসিকভাবে প্রস্ত্তত থাকার জন্য। হঠাৎ একদিন শুনতেই পারো বাঁচাও বাঁচাও ডাক, দেখতেই পারো হাবুডুবু খেতে থাকা কোনো বন্ধু বা বান্ধবীর বাঁচার আকুতিতে কাঁপতে থাকা একজোড়া হাত।

তখন সিনেমার নায়কের মতো লাফিয়ে পড়ে তার কাছে গেলেই তাকে তুলে নিয়ে আসতে পারবে যে এমন নয়, কিন্তু নিজে খুব ভালো সাঁতার কাটতে পারলে তবেই কাছে যাবে, এবং অবশ্যই তোমাকে জড়িয়ে ধরতে দেবে না। না পারলে অন্য কারও সহায়তা নেবে।

পানিতে ডুবে যাওয়া মানুষকে বাঁচানোর জন্য তোমাকে অবহ্যই ভালো সাঁতারু হতে হবে
পানিতে ডুবে যাওয়া মানুষকে বাঁচানোর জন্য তোমাকে অবহ্যই ভালো সাঁতারু হতে হবে

পানি থেকে তাকে ওঠানো মানেই কিন্তু বাঁচিয়ে ফেলা নয়। প্রথমেই ডুবে যাওয়া লোকের মুখ ও নাক পরিষ্কার করবে। পেট থেকে পানি বের করার জন্য মাটিতে উপুড় করে শোয়াবে। নাক-মুখ বন্ধ হয়ে যেন বন্ধুটি মারা না পড়ে, সে জন্য তার হাত দুটো কপালের নিচে রাখবে। এবার একটি বালিশ বা কাপড় তার পেটের নিচে রাখবে এবং পিঠে হালকা করে চাপ দিতে থাকবে। কী যেন বলে একে, ও হ্যাঁ মৃদু চাপ।

সাপে কাটা স্থানের উপরে বাঁধ দিয়ে দ্রুত নিকটস্থ চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে
সাপে কাটা স্থানের উপরে বাঁধ দিয়ে দ্রুত নিকটস্থ চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে

কুকুর হইতে সাবধান লেখা থাকলে আমি একটু নিশ্চিন্ত বোধ করি। আমার কেন যেন মনে হয়, যে বাড়িতে ওটা লেখা থাকে, সে বাড়িতে আসলে কুকুরই নেই কিংবা থাকলেও তেমন একটা দশাসই কিছু হবে না। কিন্তু বেশির ভাগ বাড়িতেই তো এ রকম কিছু লেখা নেই, সেসব একটা বাড়ির সামনে গিয়ে কামড় যে কেউই খেয়ে বসতে পারে। তুমি চিকিৎসা জানো না বলে কী, তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে? অতীতে কী করেছ জানি না, আজ থেকে তোমারও কিছু করণীয় তুমি মাথায় ঢুকিয়ে ফেলতে পারো। ওকে?

কুকুর-বিড়াল কামড়ালে, তুমি আবার কামড়াতে যেয়ো না। কুকুরের কাজ কুকুর করেছে কামড় দিয়েছে পায়, তা বলে কুকুরকে কামড়ানো কি মানুষের শোভা পায়? তাহলে তুমি কী করবে, সেটাই শুনে রাখো। কুকুর বা বিড়ালটাকে মোটামুটি চিহ্নিত করতে হবে। চিকিৎসক জিজ্ঞেস করলে যেন বলতে পারো ব্যাটা দেখতে অন্তত কেমন ছিল। এবার কামড়ের স্থান সাবানপানি দিয়ে ধুয়ে ফেলো, কামড়ের স্থান মানে কিন্তু বাড়ির পাঁচিলের ডান পাশের ফুটপাত নয়, পায়ের যে জায়গাটিতে কামড় দিয়েছে, সে জায়গাটি ধুয়ে লোকটিকে নিকটবর্তী হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়ো।

আচ্ছা ধরো, হঠাৎ স্কুলে বা বাসায় কিংবা খেলার মাঠে আহত হয়ে অথবা কোনো কারণ ছাড়াই কারও শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল, তুমি মি. প্রাথমিক চিকিৎসক তখন নিশ্চয়ই বসে থাকতে পারবে না। তুমি দ্রুত তার কাছে গিয়ে মুখে মুখ লাগিয়ে বা নাকেমুখে কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস দেবে, প্রয়োজনে বুকে শ্বাসের তালে তালে চাপও দিতে পারো, তারপর দ্রুত হাসপাতালে পাঠিয়ে তবেই তুমি বিশ্রাম নেবে। বেশি করে সাহস দেবে। কেবল রোগীকেই নয়, তোমার নিজেকেও, জরুরি মুহূর্তে সাহস হারালে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজই মিস হয়ে যাবে।

খেলতে গিয়ে মাঠে নয়, এমনকি কম্পিউটার গেমস নাড়াচাড়া করতে গিয়েও কেটেছিঁড়ে রক্তপাত হলে সবার আগে রক্ত পড়া বন্ধ করতে হবে। সরাসরি রক্তপাত যেখান থেকে হচ্ছে, সেখানেই পরিষ্কার কাপড় বা তুলা দিয়ে চেপে ধরে রাখতে হবে। মোটামুটি বন্ধ হয়ে এলে প্রেশার ব্যান্ডেজ দিয়ে বেঁধে নিতে হবে। হাত বা পা কাটলে তা উঁচিয়ে ধরে রাখবে। আর হ্যাঁ, ময়লাযুক্ত কিছু দিয়ে কেটে থাকলে অবশ্যই ক্ষতস্থান স্যাভলন বা ডেটল দিয়ে পরিষ্কার করে এতে অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম ব্যবহার করতে হবে। তার পরও ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হলে, বুঝবে হাসপাতালের জন্য গাড়ি ডাকার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। দেরি করবে না, তোমাকে হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে আবার খেলতে হবে না?

খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলে, হঠাৎ রান্নাঘর থেকে চিৎকার শুনতে পেলে, না, মাছ বা মুরগির চিৎকার নয়, এরা তো ইতিমধ্যেই খুন হয়ে চুলায় চড়েছে, তাহলে কে? যে রান্না করছিল সে-ই হতে পারে। গিয়ে দেখলে যা ভাবছিলে তা-ই, বুয়া চিৎকার করছিল, তার হাতে আগুন বেশ খানিকটা পুড়ে গেছে, এখন কী করবে? হুম... আমি বলে দিচ্ছি, প্রথমে পোড়া স্থান প্রচুর পরিমাণ ঠান্ডাপানি দিয়ে বারবার ধুতে হবে। আরেকটা কথা, পোড়া স্থানে অবশ্যই পরিষ্কার ড্রেসিং ব্যবহার করতে হবে, প্রচুর পানি, শরবত, স্যালাইনপানি খেতে হবে। কারণ, পোড়া স্থান দিয়ে শরীরের প্রচুর পানি-লবণ বের হয়ে যাওয়ায় রোগীর আরও দৈহিক সমস্যা তৈরি হতে পারে। ব্যস, তারপর রোগীর অবস্থা বুঝে হাসপাতালে নিয়ে যাবে!

মনে রেখো, এই লেখা পড়ার পর থেকে তুমি প্রাথমিক চিকিৎসা জানো। তোমার এখন অনেক দায়িত্ব, বুঝলে মিস্টার অ্যান্ড মিস প্রাথমিক চিকিৎসক। ভালো প্রাথমিক চিকিৎসক সে-ই, যে কতদূর চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারে সেটা যত দূর জানে, তার চেয়ে বেশি জানে কোথায় গিয়ে তাকে থামতে হবে এবং কখন রোগীকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে!

ছবিঃ মাসুদুল হক

মডেলঃ ইভা, বিভা, নিহাল, পলাশ, সাদ, নয়ন ও নিশান