ক্রাক্রা

কাকরাইলের বড় আমগাছটায় বসবাস করে এক কাক, তার স্ত্রী আর তাদের ছোট্ট ছেলে ক্রাক্রা। কদিন আগেই জন্ম হয়েছে ক্রাক্রার, এখনো চোখ ফোটেনি। ক্ষিদে পেলে চিউচিউ করে ডাকে সে। আত্মীয়স্বজনেরা দূর-দূরান্ত থেকে দেখতে আসে ওকে। ঠোঁট দিয়ে আদর করে শুভকামনা জানায়। ক্রাক্রার মা-বাবা খুব খুশি। ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন তাদের। বড় হয়ে কাকের মতো কাক হবে, চড়ুইয়ের বাসায় হানা দেবে, মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করবে আরও কত কী!

কিন্তু ক্রাক্রা একটু বড় হতেই তাদের আশা পরিণত হলো হতাশায়। কারণ, ক্রাক্রা অন্য কাকদের মতো নয়। ওর বয়সী সব কাক বলিষ্ঠ কণ্ঠে তীব্র সুরে ‘কা কা’ করে ডাকে, গান গায়। অথচ ক্রাক্রার গলা দিয়ে বের হয় কেমন যেন চিকন সুর! মনে হয় টুনটুনি, দোয়েল অন্য কেউ ডাকছে। কোনো কাক এভাবে ডাকেনি কখনো। কাকসমাজে এখন মুখ দেখাতে পারছে না ক্রাক্রার মা-বাবা। সবাই ছি ছি করছে তাদের নিয়ে।

ক্রাক্রার মা প্রতিদিন ভোরে উঠে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘আমার ছেলেটা এমন হলো কেন? আমরা কী দোষ করেছিলাম? এই কণ্ঠ নিয়ে ও কী করে মানুষকে বিরক্ত করবে? কী করে ভয় দেখাবে ছোট পাখিদের?’

‘দুঃখ কোরো না ক্রাক্রার মা’, স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেয় ক্রাক্রার বাবা। ‘আসলে আমাদের ভাগ্যটাই খারাপ।’

কালো ডানায় চোখ মুছতে মুছতে ক্রাক্রার মা বলে, ‘চল, ওকে নিয়ে ডাক্তার দাড়কাকের কাছে যাই। দেখি উনি কী বলেন।’

ডাক্তারের কাছে যেতে একদমই ভালো লাগে না ক্রাক্রার বাবার। শহরের ওই দিকের খোলা ডাস্টবিনগুলো সরিয়ে ফেলেছে মানুষ। ক্রাক্রার বাবা ভেবেই পায় না মানুষ এত নোংরা হয় কী করে! এত সুন্দর ডাস্টবিনগুলো সরিয়ে ফেলল! তবুও সে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘চলো’।

এক বিকেলে ক্রাক্রাকে নিয়ে তার মা-বাবা ডাক্তার দাড়কাকের চেম্বারে এল। কাকসমাজে ডাক্তার দাড়কাক একজন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চিকিৎসক। দুই মাস আগে তার সিরিয়াল নিতে হয়। কাকলীর পুরান এক কাঁঠালগাছের ওপর তার চেম্বারে রোগী গিজগিজ করছে। অধিকাংশই ভুগছে হজমের সমস্যায়। ‘নিশ্চয় মিনারেল ওয়াটার খেয়েছে। নইলে পেটে সমস্যা হওয়ার কোনো কারণই নেই।’ মনে মনে ভাবল ক্রাক্রার বাবা। ডানে তাকাতেই দেখা গেল কয়েকটা কাকের চোখে ব্যান্ডেজ। ‘ইশ, নিশ্চয় বিরিয়ানির প্যাকেট থেকে খাবার খেতে গিয়ে চোখে হাড্ডির গুঁতো লেগেছে ওদের! আমারও একবার এমন হয়েছিল, কী যে কষ্ট!’ ভেবে শিউরে উঠল ক্রাক্রার বাবা। 

অনেকক্ষণ পর এল ক্রাক্রার সিরিয়াল। ডাক্তারকে ঘটনা খুলে বলতে গেল ক্রাক্রার মা। ইশারায় চুপ করতে বললেন ডাক্তার। ক্রাক্রার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বলো তো বাবা, তোমার সমস্যাটা কী?’

‘আমার তো কোনো সমস্যা নেই।’ মিনমিন করে বলল ক্রাক্রা। ওর কণ্ঠ শুনেই চমকে উঠল ডাক্তার দাঁড়কাক। উঠে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ পায়চারি করল সে। তারপর নিজের আসনে বসে ক্রাক্রার মা-বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি দুঃখিত। এ রোগের কোনো চিকিৎসা আমার জানা নেই। দীর্ঘ ডাক্তারি জীবনে আমি এমন রোগী কখনো দেখিনি। খুবই দুঃখিত আমি। ইয়ে...আপনাদের কোনো ভিজিট দিতে হবে না।’

ডাক্তারের কথা শুনে চিৎকার করে কেঁদে উঠল ক্রাক্রার মা-বাবা। ক্রাক্রা কিছুই বুঝতে পারল না। তবে এটুকু বুঝল, তার অনেক বড় একটা অসুখ আছে। সে বোধ হয় আর বাঁচবে না। মা-বাবাকে কাঁদতে দেখে সেও কাঁদতে লাগল।

দিনে দিনে আরও বড় হতে লাগল ক্রাক্রা। কিন্তু তার কণ্ঠ আর বদলাল না। কবিরাজ, ভেষজ ওষুধ সব ব্যর্থ। শেষে এক বুদ্ধিজীবী কাকের পরামর্শে ক্রমাগত বরফকুচি খাওয়ানো হলো ক্রাক্রাকে। কিন্তু লাভ হলো না। ক্রাক্রার কণ্ঠ আগের মতোই রয়ে গেল; অন্য পাখিদের মতো চিকন। কাকদের ভাষায় ‘ককর্শ’। কাকসমাজে সে এখন হাসির পাত্র। তাকে দেখলেই সবাই মুখ বাঁকিয়ে হাসে। কেউ তার সঙ্গে খেলে না। প্রথম দিকে ক্রাক্রা খুব কষ্ট পেত। এখন আর তেমন কষ্ট পায় না সে। অন্যদের কাছ থেকে দূরেই থাকে সে। কোনো বন্ধু নেই। তাই একাই উড়ে বেড়ায় ও।  

দুপুরের কড়া রোদে বৈদ্যুতিক তারের ওপর বসে ছিল ক্রাক্রা। হঠাৎ পাশের ডাস্টবিন থেকে ভেসে আসা সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণ পেল সে। দ্রুত উড়ে গিয়ে ডাস্টবিনটার ওপরে বসল ক্রাক্রা। ‘আহ্‌, কী মজার খাবার!’ বুক ভরে শ্বাস নিতে নিতে ভাবল সে। ফুলে ঢোল হয়ে থাকা একটা সুস্বাদু মরা ইঁদুরের দিকে এগোতেই তার পথরোধ করল আরও কয়েকটি কাক। বাসার আশপাশে অনেকবার এই কাকগুলোকে দেখেছে ক্রাক্রা। কখনোই ভালো মনে হয়নি এদের। বখাটে কাক সব। এদের মধ্যে যে কাকটা সবচেয়ে শক্তিশালী, সে ক্রাক্রাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘তোর এত বড় সাহস? আমাদের সঙ্গে এক ডাস্টবিনে খেতে আসিস? যা ভাগ এখান থেকে। তুই কাকসমাজের কলঙ্ক, অভিশাপ। এই ডাস্টবিনের খাবার শুধু কাকদের জন্য। তুই কাক না। হে.হে.হে.।’

খুব কষ্ট পেল ক্রাক্রা। আসলেই কী সে  অভিশাপ? তার কণ্ঠটা অন্য কাকদের মতো নয় বলে কী সে কাকসমাজে থাকতে পারবে না? চোখে পানি চলে এল ক্রাক্রার। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে বিকেল হয়ে গেছে টেরও পেল না সে। তারের ওপর বসে মনের দুঃখে গান গাইতে লাগল ক্রাক্রা। কিছুক্ষণ পর সে খেয়াল করল, কয়েকটা মানুষের বাচ্চা রাস্তা থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সবার চোখে বিস্ময়। একটা বাচ্চা বলল, ‘দেখেছিস, এই কাকটার ডাক কত মিষ্টি? অন্য কাকদের মতো কর্কশ না! কী সুন্দর!’

‘ঠিক বলেছিস।’ আরেকটা বাচ্চাও একমত হলো। ‘মনে হচ্ছে যেন গান গাইছে কাকটা। কী অদ্ভুত! কাকও গান গাইতে পারে!’ 

ক্রাক্রা মানুষের ভাষা বোঝে না। কিন্তু বাচ্চাগুলোকে দেখে ঠিকই বুঝলো ওরা তাকে পছন্দ করেছে। কী লজ্জার ব্যাপার! কাক হয়ে সে মানুষকে আনন্দ দিচ্ছে? কোথায় তার গান শুনে মানুষ বিরক্ত হবে, তাড়িয়ে দেবে তা না, ওরা মন দিয়ে শুনছে? ছি। আসলেই সে কাকসমাজের কলঙ্ক। ক্রাক্রা ভাবল সে আর এই অভিশপ্ত জীবন রাখবে না। বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিটারে বাড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করবে।

কাঁদতে কাঁদতেই তীব্রগতিতে ট্রান্সমিটার লক্ষ্য করে উড়তে লাগল ক্রাক্রা। তার মনে পড়ল মা-বাবার কথা। ওর জন্য অনেক অপমান সইতে হয়েছে তাদের। আর না। মনে পড়ল ডাস্টবিনের মরা ইঁদুরের কথা। এমন মজার খাবার আর খাওয়া হবে না। ট্রান্সমিটারের কাছাকাছি চলে এসেছে সে। হঠাৎ শুনতে পেল কে যেন তাকে ডাকছে। পেছনে তাকাবে না ভেবেও তাকাল ক্রাক্রা। একটা দোয়েল ছুটে আসছে তার দিকে। ইশারায় থামতে বলছে।

থামল ক্রাক্রা। একটু পর দোয়েল ওর পাশে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘ওহ, এত দ্রুত উড়তে পারো তুমি! যাক, থেমেছ তাহলে। শোন, আমি কিউকিউ। আন্তবিভাগীয় পক্ষীসংগীত প্রতিযোগিতার একজন আয়োজক। তোমার গান শুনলাম। কাক হয়েও তোমার ভয়েস এত ভালো যে কী বলব! কী পরিষ্কার দরাজ গলা...আহা! তুমি আমাদের প্রতিযোগিতায় অংশ নিলে খুব ভালো হবে।’

‘ইয়ে মানে আমি...’ আমতা আমতা করল ক্রাক্রা। কিউকিউ হেসে বলল, ‘আমাদের অনুষ্ঠানটা অনেক দিন থেকেই হচ্ছে, কিন্তু একটু একঘেয়ে হয়ে গেছে। বোঝই তো, ঘুরেফিরে সেই নির্দিষ্ট কিছু পাখি বারবার পুরস্কার পাচ্ছে। কোনো কাক এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় না। অনেক আগে তারা প্রতিযোগী হিসেবে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে কম নাম্বার পেয়েছে। কাকদের কণ্ঠ তো ফাটা বাঁশের মতো কর্কশ। কিন্তু ওরা প্রতিযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলল। বিচারকার্য নাকি স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানের হয়নি। গাইতে না জানলে মাইক নষ্ট আর কী!’

‘মুখ সামলে কথা বলো’। প্রচণ্ড রেগে গেল ক্রাক্রা। ‘কাকদের নিয়ে বাজে কথা বললে এক ঠোঁকরে তোমার চোখ গেলে দেব।’ কিউকিউয়ের চোখের কাছে ঠোঁট নিয়ে বলল সে।

‘না না, ঠিক আছে। আসলে আমি ওভাবে বলিনি...’ ভয়ে পিছিয়ে এল কিউকিউ। ‘আসলে কাকদের কণ্ঠটা একটু জোরালো,...মানে কড়া আর কী! একেবারে খারাপ না, কর্কশ...ইয়ে... জোরালো কণ্ঠেরও তো দরকার আছে, তাই না?’

‘হুম। তো আমাকে কী করতে হবে?’ এখনো রেগে আছে ক্রাক্রা। ‘আমি অংশ নিলে তোমার কী লাভ?’

‘অনেক দিন পর একটা কাক সংগীত প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে- খবরটা আলোড়ল সৃষ্টি করবে না? পত্রিকা আর চ্যানেলগুলোতে ব্রেকিং নিউজ আসবে। সবার আগ্রহ বাড়বে। কাকসমাজে এ অনুষ্ঠানের টিআরপি ভালো না। তুমি থাকলে ওরাও দেখবে। অনুষ্ঠান হিট। এটাই আমার লাভ। তা ছাড়া তুমি বেশ ভালো গাও। আমরা শুধু ব্যবসাই করি না, সুপ্ত প্রতিভাকে প্রতিষ্ঠিত করাও আমাদের কাজ...হে.হে.হে। তো তুমি রাজি?’

‘হু।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ক্রাক্রা।

পরের ঘটনাগুলো ঘটলো বেশ দ্রুত। নির্ধারিত দিনে প্রতিযোগিতার ভেন্যু দোয়েল চত্বরে এল ক্রাক্রা। বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রচুর পাখি এসেছে এখানে। ওকে দেখে হাসাহাসি শুরু করল অন্য প্রতিযোগীরা। এমনকি বিচারকেরাও মুখ টিপে হাসছে। কিন্তু শেষ প্রতিযোগী হিসেবে ক্রাক্রা গান শুরু করতেই একদম স্তব্ধ হয়ে গেল সবাই। এ এক অন্যরকম গান। এমন সুর কেউ শোনেনি আগে।

দীর্ঘ এক টান দিয়ে গান শেষ করল ক্রাক্রা। চোখের কোণে জল। বিচারক আর অন্য প্রতিযোগীরাও চুপ। কেউ পছন্দ করেনি আমার গান-ভাবল ক্রাক্রা। হঠাৎ সব পাখি একসঙ্গে কিচিরমিচির করে উঠল! জায়গায় উড়ে ক্রাক্রাকে অভিবাদন জানাল বিচারকেরা। চারদিক থেকে ভেসে এল ‘ক্রাক্রা ক্রাক্রা’ স্লোগান। এই প্রথম ক্রাক্রা বুঝল প্রশংসা ব্যাপারটা কী! খুব আনন্দ হলো তার।

একটু পর আনন্দ আরও বেড়ে গেল ক্রাক্রার। প্রথম কাক হিসেবে আন্তবিভাগীয় পক্ষীসংগীত প্রতিযোগিতার সেরা শিল্পী হয়েছে সে। সবাই অভিনন্দন জানাল তাকে। লজ্জায় লাল হয়ে গেল ক্রাক্রা। সব পাখির মধ্যে তারটাই সেরা কণ্ঠ! কী আশ্চর্য। সে তাহলে ফেলনা নয়। আনন্দে কাঁদতে শুরু করলো ক্রাক্রা। তাকে মাঝে রেখে নাচতে লাগল অন্য প্রতিযোগী পাখিরা।

খবরটা প্রচার হতে বেশি দেরি হলো না। ছুটে এলো ক্রাক্রার মা-বাবা। অন্য কাকরাও কাজ ফেলে চলে এল দোয়েল চত্বরে। সবাই খুব খুশি। কণ্ঠ নিয়ে অনেক খোঁচা সইতে হয়েছে সমগ্র কাকসমাজকে। কিন্তু এবার একেবারে মোক্ষম জবাব দেওয়া গেছে। আর এ কাজটা করেছে ক্রাক্রা। যাকে তারা কাক বলে স্বীকারই করত না! কত বড় ভুল। ‘ক্রাক্রা ক্রাক্রা’ স্লোগান শুরু করল তারা। ওদিকে ক্রাক্রাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল তার মা। ক্রাক্রার বাবা এদিক-ওদিক তাকিয়ে ডাস্টবিন খুঁজছিল। একটা ডাস্টবিন পেলে সবাইকে নিয়ে জম্পেশ খাওয়া-দাওয়া করা যেত। ভাবল সে।

তারপরের ইতিহাস তো সবারই জানা। ক্রাক্রাকে আর কেউ অপমান করে না। উল্টো সে-ই এখন কাকদের সবচেয়ে বড় তারকা। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটা বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়ার প্রস্তাব পেয়েছে সে। অনেকেই ক্রাক্রার কাছে গান শিখতে আসছে। কাকরাইলের দিকে গেলে দেখা যায়, বৈদ্যুতিক তারের ওপর বসে দলবল নিয়ে মনের সুখে গান গাইছে ক্রাক্রা। কী সুন্দর সেই গান!