রসগোল্লাটা কথা বলে!

রসগোল্লাটা বলল, আমায় খেয়ো না গুটলু। আমার হ্যাপাটাইসিস বি হয়েছে।

—কী হয়েছে? রসগোল্লার কথায় চমকে গিয়ে অজান্তেই প্রশ্নটা বেরিয়ে আসে গুটলুর মুখ দিয়ে, কী হয়েছে?

রসগোল্লাটা বলল, হ্যাপাটাইটিস বি। সংসারের নানা হ্যাপা সামলাতে সামলাতে ক্লান্ত হয়ে শেষমেশ আক্রান্ত হলাম হ্যাপাটাইটিস বি-তে। কঠিন ভাইরাস। বাপের নাম ভুলিয়ে ছাড়ে। এই যেমন আমি এই মুহূর্তে বাবার নামটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না। আচ্ছা গুটলু, তুমি কি আমার বাবার নামটা একটু মনে করিয়ে দিতে পারো?

রসগোল্লা যে কথা বলতে পারে সেটা জীবনে প্রথম শুনতে পেয়ে এমনিতেই ঘাবড়ে গেছে গুটলু। তার ওপর কী বিদঘুটে প্রশ্ন রসগোল্লাটার! গুটলু তাই বিস্ময় না লুকিয়েই বিরক্তি প্রকাশ করল, আরে বাবা আমি কী করে জানব তোমার বাবার নাম? আর তা ছাড়া রসগোল্লাদের বাবাদেরও নাম থাকে নাকি?

—থাকে থাকে। ক্যানো থাকবে না? রসগোল্লারা মানুষ নয় বলে তাদের নামও থাকতে নেই নাকি! তুমি মরণচাঁদের নাম শোনোনি? কিংবা আলাউদ্দিন সুইটমিটের নাম?

—তাতো শুনেছি।

—তাহলে? মরণচাঁদ ঘোষের ফ্যাক্টরিতে তৈরি সব মিষ্টির বাবা হচ্ছেন শ্রীমান মরণচাঁদ ঘোষ। তেমনি  আলাউদ্দিন সুইটমিটের ফ্যাক্টরিতে বানানো মিষ্টিদের কাছে ওদের বাবার নাম জিজ্ঞেস করলে ওরা বলবে, আমাদের বাবার নাম জনাব আলাউদ্দিন। 

রসগোল্লাটার কথায় ভারি আশ্চর্য হলো গুটলু। আরে তাই তো! ব্যাপারটা এভাবে তো কখনো ভাবা হয়নি! নিজের বিস্ময়ভাব কাটিয়ে গুটলু পালটা প্রশ্ন করল, তোমার নিজের নামটা মনে আছে তো? নাকি হ্যাপাটাইটিসের হ্যাপায় ওটাও ভুলে বসে আছ?

—না না। নিজের নাম এখনো ভুলে যাইনি। শুধু বাবার নামটা ভুলেছি। আমার নাম লাটাকবম।

—লা টাক্ বম্?

—লা টাক বম নয়, লাটাকবম। একসঙ্গে উচ্চারিত।

লাটাকবমের কাছ থেকে ‘একসঙ্গে উচ্চারিত’ টাইপের কঠিন বাংলা শুনে গুটলু নতুন করে ঘাবড়ে গেল, তুমি তো দেখছি বাংলা ভাষাটাও দারুণ রপ্ত করেছ!

—রপ্ত করেছি মানে! বাংলা তো আমার পিতৃভাষা। পিতৃভাষা কি রপ্ত করতে হয় নাকি? ওটা আপনিতেই এসে যায়।

—পিতৃভাষা! পিতৃভাষা কেন? মাতৃভাষা নয় কেন?

—আরে কী মুশকিল! আমাদের মা থাকলে তো মাতৃভাষা থাকবে! আমাদের তো কোনো মা-ই নেই!

—আহারে! কী হয়েছে তোমাদের মায়ের?

—ওহ্‌ হো কী করে বোঝাই তোমাকে। মিষ্টিদের কোনো মা থাকে না। ওদের থাকে শুধু বাবা। কখনো মহিলাদের নামে কোনো মিষ্টির দোকান দেখেছ? নিত্যলাল সুইটমিট আছে। যাদব ঘোষ মিষ্টান্নভান্ডার আছে। কিন্তু মহিলাদের নামে মিষ্টির দোকান? কাভি নেহি।

লাটাকবম নামের মিষ্টি ছেলেটাকে ভারি মিষ্টি মনে হলো গুটলুর কাছে। বেশ জ্ঞানী এই মিষ্টিপুত্রটি।

গুটলু আজ একলা একা। বাড়িতে কেউ নেই। বাবা অফিসে। মা কলেজে। বাংলার প্রফেসর মা। সারাক্ষণ কঠিন কঠিন বাংলা শব্দ ব্যবহার করে বাবাকে জব্দ করার তালে থাকেন। বাবা পড়েছেন ইংরেজি সাবজেক্টে। বাংলায় অতিশয় কাঁচা। আর সেই সুযোগে বাবাকে নাকাল করেন মা সব সময়। সহজ কথাটাও মা বলেন খুব কঠিন করে। এই যেমন সেদিন বললেন, গুটলুর আব্বা তুমি আবারও সেই ইয়েলো কালারের ব্লেজারটা পরেছ! আমার তো বিবমিষা জাগছে!

বাবা সরল দৃষ্টিতে মাকে জিজ্ঞেস করলেন, বিবমিষাটা কী?

মা তখন আরেক কাঠি ওপরে উঠলেন, সামান্য বিবমিষা শব্দটা শুনেই তুমি ও রকম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লে!

বাবা তখন অহেতুক জরুরি একটা কাজের তাড়ায় তড়িঘড়ি ঘর থেকে পালিয়ে বাঁচলেন।

গুটলুর এখন সামারের ছুটি। ছুটির দিন ছাড়া বাবা-মায়ের সঙ্গে কোথাও যাবার নেই। এই সময়টায় ঘরে বসে বসে টায়ার্ড হওয়া ছাড়া কিছুই করার থাকে না গুটলুর। কতক্ষণ আর টিভি দেখা যায়! কতক্ষণ গেম খেলা যায়! ছোট্ট একটা ভাই বা বোন থাকলেও হতো। ওটাকে মারধর করে সময় পার করা যেত আরামসে। কিন্তু কী কপাল! গুটলুর কোনো ভাইবোনও নেই। সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকা একটা কাজের মেয়ে অবশ্য আছে বাড়িতে। রুকিয়া বেগম। কিন্তু নাম জিজ্ঞেস করলে বলবে, শাবানা। ছোটবেলায় সে নাকি চিত্রনায়িকা শাবানার মতো সুন্দরী ছিল দেখতে। গ্রামের লোকজন তাই ওকে নাকি রুকিয়া বেগম না বলে শাবানা বেগম বলত। শাবানা অথবা রুকিয়া সারাক্ষণ কিচেনে রান্নাবান্না আর বাথরুমে কাপড় ধোয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কথা বলতে গেলেই আজব একটা হাসি দিয়ে বলবে, গুটলু ভাইজান আপনে আমারে ডিসটাব দিয়েন্না। কাজকাম সুময়মতো শ্যাষ না করলে খালাম্মায় বকব। আর শোনেন, আপ্নে ফিরিজ খুইল্লা চুরি কইরা মিষ্টি খাইয়েন্না। খালাম্মায় শ্যাষে আমারে সন্দেহ কর্বো!

আসলে, শাবানার কথাতেই ফ্রিজে থাকা মিষ্টির কথা মনে পড়েছিল গুটলুর। গুটলু তখন চুরি করে এক পিস রসগোল্লা খাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে চুপিচুপি ফ্রিজ খুলে একটা রসগোল্লাকে পাকড়াও করে ওটাকে মুখে পুরতে যেতেই রসগোল্লাটা কথা বলে উঠেছিল।

ফ্রিজের দরজা খুব সাবধানে আলতো করে বন্ধ করতে গিয়েও শব্দ হলো খানিকটা। আর সেটা কেমন করে যেন পৌঁছে গেল বাথরুমের দিকেও। আর সঙ্গে সঙ্গে বাথরুম থেকে শাবানা বেগম চিল্লিয়ে উঠল, গুটলু ভাইজান ফিরিজ খুলোনের আওয়াজ পাইলাম য্যান!

শাবানা বেগমের চিল্লানিতে চমকে যাওয়াতে গুটলুর হাত থেকে টুপ করে পড়ে গেল লাটাকবম, মানে রসগোল্লাটা। গুটলু সেটা বেসিনের সিংকে ধুতে গেলে আর্তনাদ করে উঠল লাটাকবম...আরে আরে করো কী করো কী!

—ফ্লোরে পড়ে গিয়ে তোমার গায়ে ময়লা লাগল যে! তাই তোমাকে ধুয়ে নিচ্ছি। গুটলু বলল।

—না না খবরদার। আমাকে পানিতে ভিজিও না প্লিজ! পানিতে ভেজালে আমার ঠান্ডা লেগে যাবে। আর ঠান্ডা লাগলেই আমার ব্রংকাইটিস হবে। আর ব্রংকাইটিস হলে তো কাশতে কাশতেই মরে যাব আমি।

লাটাকবমের কথায় কান না দিয়ে বেসিনের কল ছেড়ে পানিতে খুব ভালো করে ওকে ধুয়ে নিল গুটলু। তারপর খুব আয়েশি ভঙ্গিতে রসগোল্লাটাকে মুখের ভেতরে চালান করে দিয়ে স্লো মোশনে চিবিয়ে চিবিয়ে সাবড়ে দিল। তারপর বীরত্ব জাহির করল, আমার সঙ্গে চালাকি!? তোমার হ্যাপাটাইটিস বি হয়েছে? পানিতে ভেজালে ব্রংকাইটিস হবে? যাও বাছাধন। তোমার সব জারিজুরি ফিনিস। গুটলু একটা কঠিন জিনিস। গুটলুকে বোকা বানানো অত ইজি না। বুঝেছ রসগোল্লার বাচ্চা! আবার কিনা কথা বলে! তাও আবার আম্মার মতোন কঠিন বাংলায়! আরে ব্যাটা তোর মা কি বাংলার প্রফেসর? আর প্রফেসরই বা হবে কোত্থেকে, মিষ্টিদের তো মা-ই থাকে না!

ঘটনার পরদিন বিকেল থেকে ঘটতে শুরু করল বিপত্তি। গা কাঁপিয়ে জ্বর এল গুটলুর। সঙ্গে খুক খুক কাশি। কিচ্ছু খেতে পারে না। কোনো খাবারেই রুচি নেই। সব খাবার কেমন বিস্বাদ ঠেকে। চোখ দুটো হলুদ বর্ণ। ডাক্তার আঙ্কেল ব্লাড আর ইউরিনের কত্ত রকম টেস্টই না করালেন! এক্স-রে করালেন চেস্ট-এর। দুদিন পরে রিপোর্ট পাওয়া গেল। দুটি কঠিন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে গুটলু। হ্যাপাটাইটিস বি আর ব্রংকাইটিস।

একলা একলা বিছানায় শুয়ে থেকে গুটলু এখন লাটাকবমের কথা ভাবে। খুব মন খারাপ হয় ওর। রসগোল্লাটা তাহলে সত্যি কথাই বলেছিল!

অলংকরণঃ তারিক সাইফুল্লাহ