দুঃসাহসী পুতুলের গল্প

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

গা ছমছম করা অন্ধকার। তার ওপর ঝমঝম আষাঢ়ে বৃষ্টি। এক হাত দূরের লোককে চেনা যায় না। আবহাওয়ার এমনি প্রতিকূল অবস্থার ভেতর দিয়ে আমরা ২০ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধার দল পার্বতীপুর এসে পৌঁছালাম। আমাদের উদ্দেশ্য হলো পার্বতীপুর, সৈয়দপুর, রংপুর এবং দিনাজপুরের রেল ও সড়কসেতু ধ্বংস করা, যাতে পাক হানাদার বাহিনীরা নির্বিঘ্নে চলাফেরা না করতে পারে।

রাত প্রায় শেষ। আশ্রয়ের প্রয়োজন। তিনজন তিনজন করে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে আমরা তিন-চার গ্রামজুড়ে থাকার পরিকল্পনা করলাম। যাতে করে একসঙ্গে সবাই ধরা না পড়ি। তা ছাড়া আশপাশের খবরাখবর এবং পরিস্থিতি জানা দরকার। এভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলে খবরাখবর আদান-প্রদানে সুবিধা হয়। তিন দিনের মাথায় আবার রাত ১০টায় টাস্কের হাটে মিলিত হওয়ার জন্য সবাইকে বলা হলো। আমি আমার ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা খালেদ ও মনসুর—এই তিনজন বৃষ্টির মধ্যেই কাকভেজা হয়ে রওনা দিলাম। মনসুর এই এলাকার, সে তার মামার বাড়িতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করল। আমরা যখন মনসুরের মামা মুনসী আসগর আলী সাহেবের বাড়িতে পৌঁছালাম, তখন ফজরের আজান পড়ছে। তিনটি টিনের ঘর নিয়ে আসগর সাহেবের বাসা। বাড়ির পশ্চিম দিকটা জলাজঙ্গলে ভর্তি। পূর্বদিকে খোলা ধানখেত। বাড়ির সামনে দিয়ে গিয়েছে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের কাঁচা রাস্তা। তারপর শুরু হয়েছে পাড়ার অন্যান্য বাড়ি। বাড়ির কোনার ঘরটায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হলো।

মুনসী সাহেব আমাদের অভয় দিলেন, এখানে ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমাদের হেফাজতের দায়দায়িত্ব তাঁর। মনসুর চলে গেল তার বাড়িতে। ও চলে যাওয়ার পর পরই অমরা সটান বিছানায় শুয়ে পড়লাম এবং ক্লান্ত শরীরে মুহূর্তের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল ১০টায় ঘুম ভাঙল। বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু আকাশে মেঘের আনাগোনা আছে। আমরা ঘরের মধ্যেই শুয়ে রইলাম। একটু পরে দরজায় টোকা দিয়ে দরজার কপাট খুলে ঘরের মধ্যে একটি কিশোরী মেয়ে এসে দাঁড়াল। লকলকে কলমিলতার মতোন দেহের গড়ন। চাপা গায়ের রং। চোখ-মুখে একটা ভয়ের চিহ্ন নিয়ে আমাদের বলল, আপনারা এখন বাইরে যাবেন না। হাতমুখ ধোয়ার জন্য পেছনের পুকুরে চলেন।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

: তুমি কে?

: আমি পুতুল, আসগর মুনসীর মেয়ে, মনসুর আমার মামা।

: বাবা সামনের রাস্তার টং ঘরে বসে আছে, পাহারা দিচ্ছে। আমাকে বলেছে আপনাদের দেখাশোনা করতে।

: আচ্ছা পুতুল, তোমাদের বাড়িতে আর কে কে আছে?

: মা আছে, আর আমার ছোট বোন রানী, অবশ্য ও এখন মায়ের কোলে।

পুতুল আমাদের রাস্তা দেখিয়ে বাড়ির পেছনে নিয়ে এল। আমি ও খালেদ হাতমুখ ধুয়ে ঘরে গিয়ে চৌকির ওপরে বসলাম। পুতুল থালায় করে পাকা কাঁঠালের কোয়া আর খই খেতে দিল।

: এখন কাঁঠাল আর খই খান। মা ভাত বসাইছে, হলেই এনে দেব।

: আমরা কে, তুমি কি জানো?

: হ্যাঁ, বাবা বলেছে।

: তোমার ভয় লাগছে না?

: না, ভয় লাগব ক্যান, এখন তো সারা দেশে যুদ্ধ চলছে। আমাদের গাঁয়ের অনেক লোক যুদ্ধে গেছে, আমার মামাও গেছে।

: তুমি স্কুলে যাও না?

: আমি এইটে পড়ি, আগে স্কুলে যেতাম, এখন দেশে যুদ্ধ তাই আর যাই না। ক’দিন আগে ‘বাচ্চা বিহারি’ পার্বতীপুরের রাজাকার কমান্ডার, গাঁয়ে এসে অনেক লোক ধরে নিয়ে গেছে, তার মধ্যে অনেক মেয়ে ছিল। এর পর থেকে আর বাড়ির বাইরে যাই না। তা ছাড়া দুদিন এ বাড়িতে থাকি, বাকি দিন পাশের গাঁয়ে খালার বাড়ি থাকি। এক বাড়িতে বেশি দিন থাকি না।

: পাকিস্তান আর্মিরা বুঝি এদিকে খুব আসে?

: প্রায় আসে, সাথে বিহারিরা থাকে, ওরাই ওদের নিয়ে আসে। যেদিন পার্বতীপুরে বাঙালি-বিহারির মারামারি হলো, সেদিন ওরা রাতে এসে আমাদের পুবপাড়ার হিন্দু গ্রাম পুড়িয়ে দিল আর অনেক মেয়েরে ধরে নিয়ে গেল। বাকিরা ভারতে চলে গেছে। এখন হিন্দু পাড়ায় আর কেউ নেই।

আমাদের কথার মধ্যেই মুনসী সাহেব এসে গেলেন।

: কমান্ডার সাহেব, আপনাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?

: আরে না ভাই, তা ছাড়া আপনার মেয়ে বেশ প্রাণবন্ত, ও আমাদের বেশ ভালোই দেখাশোনা করছে।

: ওকে নিয়েই যত জ্বালা বুঝলেন, যা দিনকাল পড়েছে।

: মুনসী সাহেব, বাচ্চা বিহারি কে?

: ও হারামজাদার কথা বলবেন না, আস্ত শয়তান, জল্লাদ একটা। বেটা আগে ছিল সৈয়দপুর রেল কারখানার লেবার, এখান হয়েছে রাজাকার কমান্ডার। এই এলাকায় যত অত্যাচার-অনাচার হয়, সব কুকর্ম তার।

: আপনার পাড়ার লোকজন কী রকম?

: ভালো, সবাই ভালো, তবে দু-চারজন যে মোনাফেক নেই, তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

: এর আগে এখানে কোনো মুক্তিবাহিনীর দল এসেছিল?

: না, আপনারাই প্রথম। তবু সাবধানের মার নেই। আমি তাই মনসুরকে ওর বাড়িতে থাকতে নিষেধ করেছি। রাতে শুধু গিয়ে দেখা করে এসেছে। ও আছে অন্য এক বাড়িতে। এ ছাড়া দিনের বেলায় ওকে পাড়ায় ঘুরে বেড়াতে নিষেধ করেছি। বলা তো যায় না, কার মনে কী আছে। হয়তো ওকে দেখে কেউ ক্যাম্পে খবর দেবে।

: আজ রাতে ওর সাথে দেখা করা দরকার।

: কোনো অসুবিধা নেই, পুতুল নিয়ে যাবে রাতে ওর বাড়িতে। আমি অন্য পাড়া থেকে বাকিদের নিয়ে আসব।

আর কিছুক্ষণ দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার পর উনি চলে গেলেন। বর্ষণমুখর দুপুর। ঘরে বসে আমরা অস্ত্রগুলো পরিষ্কার করছিলাম। পুতুল বসে বসে দেখছিল। ওর চোখে অবাক করা অনেক প্রশ্ন। জীবনে সে রাইফেল দেখেনি। হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে অনেক কৌতূহল নিয়ে দেখছিল। আমি যখন গ্রেনেডগুলো পরিষ্কার করছিলাম তখন সে বলল, এগুলো কী?

: এগুলোকে গ্রেনেড বলে, এগুলো বোমা, ছুড়ে মারলে প্রচণ্ড শব্দ হয় আর অনেক লোক মারা যায়।

: একটা দেখি?

আমি একটা গ্রেনেড ওর হাতে দিলাম, অবশ্য ভেতর থেকে ডেটনেটর খুলে রাখলাম।

: এগুলো কীভাবে ছুড়ে মারে?

: তুমি শিখবে?

: জি

আমি পুতুলকে দেখালাম কীভাবে সেফটি পিন খুলে লিভার জোরে চেপে ধরে গ্রেনেড ছুড়তে হয়। পুতুল চার-পাঁচবার পিন খুলে জোরে লিভার চেপে ধরে খুবই আগ্রহের সঙ্গে গ্রেনেড ছোড়ার প্র্যাকটিস করল।

: আমি ছেলে হলে মুক্তিযুদ্ধে যেতাম।

: তাই?

: হ্যাঁ, আমাকে রাইফেল চালানো শেখাবেন?

: এখানে তো শেখানো যাবে না, গুলি করলে শব্দ হবে।

: ও আচ্ছা, তাহলে থাক।

এর মধ্যেই পুতুলের মায়ের ডাক এল। ও চলে গেল, ফিরে এল দুপুরের খাবার নিয়ে। ছোট বোন যেমন বড় ভাইকে যত্ন করে খাওয়ায়, তেমনি যত্ন করে সে আমাদের খাওয়াল। খাবারের পর সে বলল, আপনারা এখন শুয়ে পড়েন, কোনো ভয় নেই। আমি আছি, কোনো কিছু হলে জাগিয়ে দেব। ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়ে সে চলে গেল।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

পুতুল চলে যাওয়ার পর আমরা দুজনে ঘুমিয়ে পড়লাম। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না। ঘুম ভাঙল পুতুলের ডাকে। দরজা খুলে দেখি বৃষ্টি ধরে এসেছে। মাগরিবের আজান পড়ছে। নামাজ শেষে সন্ধ্যা রাতেই আমরা রওনা দিলাম মনসুরের বাড়ির উদ্দেশে। মাঠঘাট আষাঢ়ের ঢলের পানিতে থই থই করছে। সরু পায়ে চলা পথগুলো কাদায় ভর্তি এবং পিচ্ছিল। তার ওপর রাতের আঁধার। সব মিলিয়ে চলাচল বড়ই কঠিন। পুতুল আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলছে, ওর পেছনে আমি এবং আমার পেছনে খালেদ। হঠাৎ ঝপ করে শব্দ হলো এবং তার সঙ্গে তারেক ভাই বলে চিৎকার শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখি, খালেদ পা পিছলে পাশের এক পুকুরে গলাপানিতে অস্ত্রসহ পড়ে গেছে। ওর করুণ অবস্থা দেখে আমি হেসে উঠলাম। আমার দেখাদেখি পুতুলও খিলখিল করে হেসে উঠল। তাড়াতাড়ি ওকে হাত ধরে টেনে তুললাম। ওর অবস্থা একবারে অবর্ণনীয়। ভিজে জবুথবু। ভেজা কাপড়েই সে আমাদের সঙ্গে হাঁটতে লাগল। মনসুরের বাড়ি পৌঁছে দেখি, ইতিমধ্যে সবাই প্রায় এসে গেছে। সবাই আশপাশের কিছু না কিছু খবর নিয়ে এসেছে। পরিস্থিতি এবং খবরাখবর আলোচনা করে আমরা সবাই নিম্নের সিদ্ধান্তে একমত হলাম,

—বাচ্চা বিহারি রাজাকার কমান্ডারকে গুলি করে মারতে হবে।

—টাস্কের হাটের কাছে পার্বতীপুর-সৈয়দপুর রেল ব্রিজ ধ্বংস করতে হবে।

—রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের ওপর ব্রিজ ধ্বংস করতে হবে।

এ অপারেশনগুলো করতে হলে প্রতিটি টার্গেট নিপুণভাবে রেকি করতে হবে এবং তার জন্য সময়ের প্রয়োজন। প্রাথমিক পর্যায়ে কে কীভাবে রেকি করে তথ্য সংগ্রহ করবে তার একটা পরিকল্পনা করা হলো। তথ্য সংগ্রহের পর, অপারেশন প্ল্যান। তারপর আক্রমণ। এগুলো সম্বন্ধে আলোচনা করতেই অনেক রাত হয়ে গেল। রাতের খাবার মনসুরের বাড়িতে খেয়ে পুতুলকে সঙ্গে করে বাড়ি এলাম। বাড়ি এসেই এক ঘুম।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

ঘুম ভাঙল গুলির শব্দে। টাকডুম, টাকডুম গুলির শব্দ শুনেই বুঝতে পারলাম এগুলো পাকবাহিনীর জি-থ্রি রাইফেলের ফায়ার। ধড়মড় করে বিছানা থেকে উঠে পড়লাম। অস্ত্র হাতে বাইরে এলাম। ইতিমধ্যে মুনসী ও পুতুল উঠে পড়েছে। মুনসী সাহেব আমাকে ইশারায় বললেন জঙ্গলে লুকিয়ে পড়তে। পুতুল দৌড়ে এসে আমাদের জঙ্গলের ভেতরে নিয়ে গেল। একটু পরে মুনসী এসে বলল, পাকিস্তানি বাহিনী পশ্চিম পাড়ায় গুলি করছে। মনে হয় ওখানে যারা আছে, তাদের কেউ দেখে ফেলে ক্যাম্পে খবর দিয়েছে। আপনারা এই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পালিয়ে যান।

জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আমরা যেতে লাগলাম। জঙ্গল পার হতেই দেখি ছেলে, মেয়ে, বুড়োবুড়ি সবাই যে যেদিকে পারে পালাচ্ছে। আর গুলির শব্দও বেশি করে শোনা যাচ্ছে। মনে হয় আমাদের লোকজন সবাই পালিয়েছে, তা না হলে তারা তো গুলি করত। কিছুই বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ কেন আক্রমণ এল। নিশ্চয় কেউ ক্যাম্পে খবর দিয়েছে। চলতে চলতে হঠাৎ পুতুল দাঁড়িয়ে পড়ল এবং আমাকে বলল, আমাকে দুটো গ্রেনেড দ্যান।

: তুমি গ্রেনেড দিয়ে কী করবা?

: আপনারা এখন হিন্দু পাড়ায় চলে যান, যাওয়ার সময় একটা বাঁশের সাঁকো পড়বে। আপনারা সাঁকো পার হয়ে গেলে আমি গ্রেনেড নিয়ে সাঁকোর ওপারে ঝোপের মধ্যে বসে থাকব। ওরা এলেই গ্রেনেড ছুড়ে মেরে পালাব। আমাকে ওরা ধরতে পারবে না।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

আমার কিছু বলার আগেই পুতুল দুটো গ্রেনেড নিয়ে ব্যাগটা ফেরত দিয়ে বলল, আপনারা তাড়াতাড়ি চলে যান। আমরা দুজনে হিন্দু পাড়ার দিকে দৌড় দিলাম। পাড়ার সামনেই বিরাট খাল। আষাঢ়ের পানিতে টই টই। খালের ওপরে পানি ছুঁই ছুঁই দুটো বাঁশ দিয়ে তৈরি একজন একজন করে পার হওয়ার একটি সাঁকো। ভালো ব্যালান্স না জানলে পড়ে যাওয়ার নব্বই ভাগ সম্ভাবনা আছে। যাহোক, কোনোমতে আমরা পার হয়ে গেলাম। দেখলাম পুতুলও পার হয়ে আসছে। আমাদের দেখেই ইশারায় পাড়ার ভেতরে চলে যেতে বলল। জনশূন্য পাড়া। একটা পরিত্যক্ত বাড়ির কোনায় দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলাম। রাইফেলগুলো ইতিমধ্যে কক করে নিয়েছি যদি শত্রু সামনাসামনি পড়ে যায় তবে গুলি চালাব। হঠাৎ একঝাঁক গুলি আমাদের মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল। বুঝতে পারলাম, পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের দেখে ফেলেছে। একটু পরেই ওদের চিৎকার শুনতে পেলাম, ‘উধার মুক্তি হ্যায়’। ফায়ারের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে দিল। কিন্তু এ পাড়ায় আসতে হলে বাঁশের সরু সাঁকোর ওপর দিয়ে আসতে হবে এবং এটা পাকিস্তানি সেনাদের জন্য খুবই কঠিন কাজ। চিন্তা করছি কী করব। এমন সময় প্রচণ্ড শব্দে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে পর পর দুটো গ্রেনেড ফাটার শব্দ হলো এবং তার সঙ্গে মরণ আর্তনাদ। ব্যাপারটা কী দেখার জন্য আড়ালে আড়ালে খালের কাছে যেতেই দেখি, পুতুল দৌড়ে পাড়ার দিকে আসছে। আমাকে দেখে বলল, দুটা গ্রেনেড ফাটায়ে দিছি। সাঁকো ভেঙে গেছে।

: খানসেনারা কোথায়?

: পালিয়েছে।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

ইতিমধ্যে খালেদ এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। এখন আর খানসেনাদের তরফ থেকে কোনো ফায়ার হচ্ছে না। আমরা দুজনে সামনে গিয়ে দেখি, বাঁশের সাঁকোটি ভেঙে পড়ে আছে আর তিনটা খানসেনার লাশ খালের পানিতে ভাসছে। রক্তে লাল খালের পানি। এটা একটা মোক্ষম সুযোগ শত্রুকে হকচকিয়ে দেওয়ার। আমি আর খালেদ দুজনে মিলে ব্রাশফায়ার করলাম সামনের জঙ্গলের দিকে। আমাদের ফায়ারের পরে শত্রুর তরফ থেকে কোনো ফায়ার এল না। তার পরিবর্তে দক্ষিণ দিক থেকে এসএলআর ও নাইন এমএম কারবাইনের গুলির শব্দ ভেসে এল। বুঝতে পারলাম, আমাদের দল ওখানে আছে। আমরাও ফায়ার শুরু করলাম এবং আরও দুটো গ্রেনেড আমার থেকে নিয়ে পুতুল খালের ওপারে ছুড়ে মারল। প্রচণ্ড শব্দে সেগুলো বার্স্ট হলো। এবার প্রায় চারদিক থেকেই আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ফায়ার শুরু করল। মাঝেমধ্যে দু-একটা গ্রেনেডও ফাটাল। শত্রু এবার হকচকিয়ে গেল। যখন তারা দেখল চতুর্দিক থেকে তারা আক্রান্ত হয়েছে, তখন রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে যেতে শুরু করল। কারণ, পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিবাহিনীকে প্রচণ্ড ভয় করে। ইচ্ছা করলে ওদের পিছু ধাওয়া করা যেত কিন্তু সেটা হিতে বিপরীত হবে। কারণ, পরবর্তী সময়ে এ গ্রামগুলোতে ওদের অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যাবে। ইতিমধ্যে দলের সবাই এসে গেল। সবাইকে বললাম, এখানে থাকা নিরাপদ নয়। আজকের মধ্যেই এখান থেকে সরে পড়তে হবে। পুতুলকে দেখিয়ে বললাম, এই অসমসাহসী কিশোর মেয়েটি আজ আমাদের প্রাণ রক্ষা করেছে। কোনোরকম ট্রেনিং ছাড়াই সে পরপর দুটো গ্রেনেড মেরে খানসেনাদের হত্যা করেছে। মনসুর তার ভাগনিকে মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক আদর করল। আমি পুতুলকে বললাম এই গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে চলে যেতে। কারণ, এখানে থাকা তার জন্য আর নিরাপদ নয়। পুতুল জেদ ধরল আমাদের সঙ্গে যুদ্ধে যাবে। অনেকভাবে বুঝিয়ে তাকে মানানো গেল। আমরা চলে গেলাম গ্রাম ছেড়ে, সঙ্গে নিয়ে গেলাম অসমসাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা কিশোরীর স্মৃতি।