সহযোগিতা চুক্তি

মন্টুর ইচ্ছা, বড় হয়ে লেখক হবে। তাই এখন থেকেই কিছু কিছু লেখে। সে যে লেখে তা কেউ জানে না। না বাবা-মা, না স্কুলের বন্ধুরা। কেউ জানলে যে বিশেষ ক্ষতি হবে তা নয়। তার কেমন লজ্জা লাগে। মনে হয়, তার গল্প পড়ে সবাই হেসে কুটিকুটি হবে। গল্পটা যদি দুঃখের হয়, তাও হাসবে।

তাই সে লেখাপড়া শেষ করে বেশ একটু রাত হলে তারপর লিখতে বসে। লেখা শেষে খাতাটা তার টেবিলের ড্রয়ারে তালাবদ্ধ করে রাখে। তালাটা সে নিয়েছে বাবার কাছ থেকে। বাবাকে মিথ্যে করে বলেছিল, ছোট্ট বিলু তার ড্রয়ার খুলে ইরেজার কামড়ে খায়। বাবা অবাক হয়ে বললেন, ‘ইরেজার তো তেমন সুস্বাদু কোনো খাবার নয়! ঠিক আছে, তোকে একটা ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’ তারপর দিলেন এই তালাটা।

ড্রয়ারে তালা লাগিয়ে চাবিটা সে রেখে দেয় তার মানিব্যাগে। মানিব্যাগটা দিয়েছেন বড় মামা। বড় মামা বললেন, ‘ব্যাটা, তুই তো বড় হয়ে গেছিস। আগামীবার জেএসসি পরীক্ষা দিবি। হাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্ট ধরেছিস। তাহলে এই মানিব্যাগটা নে। ফুলপ্যান্টের পেছনের পকেটে রাখতে পারবি। হানড্রেট পারসেন্ট লেদার।’

ঘড়ির কাঁটা বারোটা পেরিয়ে গেছে। মা বিলুকে নিয়ে শুয়ে পড়েছেন। মন্টু তার ঘরের দরজায় গলা বাড়িয়ে দেখল, বাবা ড্রয়িংরুমের সোফায় গা এলিয়ে বই পড়ছেন। সে ঘরের দরজা ভিজিয়ে দিল। আর তখনই বাবা তার দরজায় এসে বললেন, ‘মন্টু, তুই কি এখন ঘুমাবি?’

—‘হু।’

—‘আমিও এখন শুয়ে পড়ব। কাল অফিস আছে। তোরও তো স্কুল আছে?’

—‘হু।’

—‘হু হু করছিস কেন? মুখে কথা বলা যায় না?’

সত্যি কথা হলো মন্টু এখন ঘুমাবে না। সে এখন গল্প লিখবে। সত্যি কথাটা বাবাকে বলা যাচ্ছে না। ‘আরও একটু সময় পড়ব’—মিথ্যা করে এ রকম কথাও বলা যাবে না। তাহলে বাবা এসে জোর করে তাকে শুইয়ে দেবেন। রাত ১২টার পর লেখাপড়া করা বাবা ঠিক মনে করেন না। তাই সত্য-মিথ্যা কিছু বলতে না পারায় সে হু হু করছিল।

বাবা চলে গেলে মন্টু লেখার খাতা খুলল। সে এখন একটা ভূতের গল্প লিখবে। তার বন্ধুরা ভূতের গল্প খুব পছন্দ করে। সবারই ভূতের গল্পের বই আছে। গলাকাট ভূত, ভয়ংকর ভূত, ভূতের বাচ্চা গিরিঙ্গা  এ রকম নাম বইগুলোর। মন্টুর নিজেরও ভূতের গল্প পড়তে ভালো লাগে খুব। একাকী পড়তে গেলে একটু ভয় ভয় লাগে মনে। কোনো গল্প এতটা ভয়ের যে শরীরের রোম খাড়া হয়ে যায়। আর যে গল্প যত ভয়ের সেটা তত মজার। শুধু যে তার এবং তার বন্ধুদের ভূতের গল্প ভালো লাগে তা নয়। তাদের বাংলার শিক্ষক ললিত বাবুরও ভূতের গল্প খুব প্রিয়। তিনি বলেন, ‘ভূতের গল্প ছেলে-বুড়ো সবারই ভালো লাগে।’

মন্টু গল্পের শুরুটা করল এভাবে, ‘ভূতের বাচ্চাটা খুব ফাজিল।’ এমন সময় কে যেন বলল, ‘দেখছি প্রায় প্রতি রাতেই তুমি ভূতের গল্প লিখছ।’ মন্টু চমকে উঠল। কে বলল কথাটা? বাবা না তো? ধ্যাত! বাবার কণ্ঠ এমন চিকন আর নাকি ধরনের হবে কেন? সে বলল, ‘কে কথা বলছ?’   

—‘আমি ভূতের বাচ্চা টিংকু।’

ভূতের বাচ্চা টিংকু! মন্টুর মাথার মধ্যে ঝিম করে উঠল। তবে সে মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল। অদ্ভুত কিছু দেখা বা শোনাকে বাবা বলেন হ্যালুসিনেশন। তার ক্ষেত্রে হয়তো সে রকম ব্যাপার ঘটেছে। ভূতের গল্প লিখবে বলে সন্ধ্যা থেকেই মাথার মধ্যে ছিল ভূত। এখন সে ভূতের কথা শুনতে পাচ্ছে। নিশ্চিত হ্যালুসিনেশন। সে সাহস নিয়ে বলল, ‘কোথায় তুমি?’

—‘এই যে তোমার টেবিলের কোনা থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছি।’ তার মানে হ্যালুসিনেশন নয়। সত্যি তার ঘরে ভূত এসেছে! ঠিক ভূত নয়, ভূতের বাচ্চা, যার নাম টিংকু। নামটা তো বেশ সুন্দর। মন্টু বলল, ‘তা ভূতের বাচ্চা টিংকু, তুমি আমার কাছে এসেছ কেন? আমাকে ভয় দেখাতে চাও?’

—‘ঠিক তা নয়। আমি যে আজই তোমার কাছে প্রথম এলাম তাও নয়। আমি প্রায় প্রতি রাতেই তোমার এখানে আসি। এসে তোমার পাশে বসে থেকে তোমার লেখা দেখি। তুমি ভূতের গল্প লেখো।’

ভূত প্রতি রাতেই তার ঘরে এসে তার পাশে বসে থাকে। কী ভয়ানক কথা! মন্টু বলল, ‘অথচ তোমার অস্তিত্বের জানান দিলে আজই প্রথম?’

—‘তুমি গল্প না লিখলে প্রথম দিনই যা করার করে আমি কেটে পড়তাম।’

—‘কী করতে?’

—‘ভয় দেখিয়ে তোমাকে অজ্ঞান করে দিয়ে চলে যেতাম।’

যাক বাবা! ভূতের কাছেও লেখকের বিশেষ মর্যাদা আছে। মন্টু বলল, ‘তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও?’

—‘তোমার সাথে আমি একটা চুক্তি করতে চাই, সহযোগিতা চুক্তি।’

ভূতের সঙ্গে সহযোগিতা চুক্তি! ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত। তবে মন্টু বেশ মজা পাচ্ছে। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী হয়। সে বলল, ‘কিসের সহযোগিতা চুক্তি?’

—‘আমিও তোমার মতো গল্প লিখি, তোমার মতো লেখক হবার স্বপ্ন আমার মনে।’

—‘ভূতদের মধ্যে আবার কবি-লেখক আছে নাকি?’

—‘অবশ্যই আছে, ভূতদের মধ্যে কবি-লেখক, নায়ক-গায়ক সবই আছে। রাত দুপুরে যদি তেঁতুলতলায় যাও তো আমাদের মহান শিল্পী চখা ভূতের গান শুনতে পারবে।’

—‘আমার দরকার নেই ভূতের গান শোনার।’

—‘আমাদের মধ্যে বিজ্ঞানীও আছে।’

—‘বিজ্ঞানী! কী আবিষ্কার করে তোমাদের বিজ্ঞানীরা?’

—‘আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিস। বর্তমানে আমাদের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানীর নাম কালীপদ ভূত। সে এমন একটা যন্ত্র আবিষ্কার করেছে, যা কানের কাছে ধরলে আমরা বুঝতে পারি আমাদের চারপাশে তিন কিলোমিটারের মধ্যে কে একাকী নির্জন স্থানে আছে। আমরা ছুটে গিয়ে তাকে ভয় দেখাতে পারি।’

—‘বলো কী!’

—‘তোমাদের মধ্যে যারা কানে কম শোনে, হেয়ারিং এইড ব্যবহার করে আমাদের যন্ত্রটা ঠিক তেমন।’

—‘যন্ত্রটা কি এখন তোমার কাছে আছে?’

—‘হ্যাঁ আছে, দেখাচ্ছি তোমাকে।’

একটা অদৃশ্য শীতল হাত মন্টুর কানের পাশে কী একটা লাগিয়ে দিল আর অমনি মন্টু শুনতে পেল কে একজন হেঁড়ে গলায় গান গাইছে, ‘মানুষ হইয়া মানুষরে তুই মানুষরে ক্যান চিনলি না/এত কিছু খুঁজলি ভবে মানুষরে ক্যান খুঁজলি না।’

লোকটার পায়ের শব্দও শোনা গেল। ভূতের বাচ্চা টিংকু বলল, ‘মুন্তাজ দফাদর। তেঁতুলতলা দিয়ে যাচ্ছে। ভীষণ সাহসী মানুষ। তাকে ভয় দেখানো খুব কঠিন।’

—‘এবার বলো, তোমার সাথে আমার কী ধরনের সহযোগিতা চুক্তি হতে পারে?’

—‘তোমাদের মধ্যে যেমন ভূতের গল্প খুব জনপ্রিয়, আমাদের মধ্যে মানুষের গল্প তেমন। তোমরা যেমন ভূতের গল্প লেখো কল্পনা থেকে, আমরা তেমন মানুষের গল্প লিখি কল্পনা থেকে। আমি তোমাকে ভূতদের বিষয়ে বিভিন্ন ঘটনা বলব আর তুমি আমাকে বলবে মানুষের ঘটনা। আমরা বাস্তবের সাথে কল্পনা মিশিয়ে চমৎকার সব গল্প লিখে বিখ্যাত হয়ে যাব।’

—‘তোমার সাথে চুক্তিতে আমি রাজি।’

—‘এখন থেকে আমরা তবে বন্ধু।’

—‘ভূত আর মানুষ কখনো বন্ধু হয়?’

—‘তা হয় না, তবে হলে কি কোনো দোষ আছে? তোমার হাত দাও বন্ধু, একটু হাত মেলাই।’

ভূতের সাথে হাত মেলানো! মন্টুর শরীরে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠল। সে হাত বাড়াতে দ্বিধান্বিত ছিল। টিংকু ভূত আবার বলল, ‘কই, হাতটা দাও। নাকি তুমি ভয় পাচ্ছ? বন্ধুর সাথে হাত মেলাতে ভয় কিসের?’

মন্টু সামনে হাত বাড়াল। বরফের মতো শীতল একটা স্পর্শ এসে লাগল তার হাতে। টিংকু ভূত বলল, ‘আজ তাহলে আসি। কাল থেকে শুরু হবে আমাদের সহযোগিতা চুক্তির বাস্তবায়ন। কাল আমি তোমাকে শোনাব আমার বন্ধু গামার গল্প। অদ্ভুত এক ভূতের বাচ্চা! মানুষকে ভয় দেখাতে ভয় পায়।’

—‘মানুষকে ভয় দেখাতে ভয় পায়!’

—‘হু, এই মুন্তাজ দফাদরকে ভয় দেখাতে গিয়ে নিজে এমন ভয় পেয়েছিল যে, ভয়ের চোটে বমি করে দিয়েছিল।’

—‘অদ্ভুত ব্যাপার!’

—‘কাল তুমি আমাকে কী গল্প শোনাবে?’

—‘আমি তোমাকে শোনাব আমার বন্ধু ফেকুর গল্প। খুবই অদ্ভুত এক ছেলে। ক্লাসে নাক ডেকে ঘুমায়। অথচ স্যার পড়া ধরলে হুবহু বলে দেয়।’

—‘কেমন করে?’

—‘কেমন করে তা আমাদের মাথায় আসে না।’

আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। মন্টু বলল, ‘টিংকু ভূত, তুমি কি আছ না চলে গেছ?’ কোনো উত্তর এল না। মন্টু আবার বলল। উত্তর নেই। মানে সে চলে গেছে।

মন্টু খাতা খুলে গল্পের নাম লিখল, সহযোগিতা চুক্তি। মানে এই গল্পটাই আগে লিখবে। সে যে আগে একটা লাইন লিখেছিল, ভূতের বাচ্চাটা ভীষণ ফাজিল, সেটা কেটে দিয়ে লিখল, ভূতের বাচ্চা টিংকু খুব ভালো। বড় হয়ে ও নামকরা লেখক হবে।

অলংকরণঃ ষুভ