জেট ল্যাগ: সময় যখন ওলটপালট

আয়, ঘুম আয়! নাহ্‌, ঘুম আসছে না। চোখের পাতা কিছুতেই বন্ধ হতে চাইছে না, ঝট করে খুলে যাচ্ছে। আবার কখনো কখনো যা, ঘুম যা" বলে ঝেঁটিয়েও ঘুমকে তাড়ানো যায় না। চোখের পাতা ভারী হয়ে শরীর নেতিয়ে বিনা নোটিশে ঘুমের রাজ্য দখল হয়ে যায়। কারও কারও জন্য পড়ার বই ভীষণ ভালো ঘুম আসার ওষুধ আর গেমস ঘুম তাড়ানোর। তবে প্রায় সব সুস্থ মানুষের জন্যই ঘুমের আসা-যাওয়া একটা রুটিন মেনে চলে। দিনের বেলা কাজ বা অকাজ এবং রাতের বেলা ঘুম। তবে এই ঘুমের রুটিনেও কখনো কখনো গোলমাল হয়ে যায়। আর যদি তুমি প্লেনে চড়ে বিপরীত টাইম জোনে চলে যাও, তবে তো গোলমেলে ঘুম হতে বাধ্য। আর একেই বলে জেট ল্যাগ। যেমন ধরো, তুমি ঢাকা থেকে দুপুরে বিমানে উঠলে। এরপর ১৪ ঘণ্টা পরে এমন একটা শহরে গিয়ে পৌঁছালে যেখানে সকাল, কিন্তু ঢাকাতে মধ্যরাত। নতুন জায়গায় পৌঁছালেও তোমার শরীর কিন্তু আগের সময় মেনেই চলতে থাকবে। তাই অবস্থা হবে দিনে ঘুমে ঢুলুঢুলু আর রাতে প্যাঁচার মতো চেয়ে থাকা।

নিশ্চয়ই তোমার মনে প্রশ্ন জাগছে, কেন এমন জেট ল্যাগ হবে? বহু বহু বছর আগে কিন্তু কারও জেট ল্যাগ হতো না। হবেই বা কী করে! তখন তো প্যাসেঞ্জার জেট এয়ারক্রাফটের মতো দ্রুতগতির যোগাযোগের মাধ্যম ছিল না। টাইম জোনগুলো ধীরে ধীরে অতিক্রম করলে, শরীর মানিয়ে নেওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু দ্রুত কয়েকটা টাইম জোন পার হয়ে নতুন জায়গায় পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে শরীর তত দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে না। খাওয়া, ঘুম, হরমোনের নিঃসরণ, শরীরের তাপমাত্রা, রক্তচাপ— সবকিছুতেই একটা গোলমাল বেধে যায়। কয় দিন পর্যন্ত জেট ল্যাগের ঝক্কি সামলাতে হবে, সেটা নির্ভর করছে কত দ্রুত তোমার শরীর নতুন টাইম জোনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে এর ওপর।

ফ্লাইটের সময়টা কত দীর্ঘ, সেটা দিয়ে কিন্তু জেট ল্যাগের হিসাব চলবে না। হয়তো তোমার ইউরোপ থেকে সাউথ আফ্রিকা যেতে ফ্লাইটে ১০ ঘণ্টা লেগে গেল। তুমি তখন বড় বড় দম নিয়ে ভাবছ, আহা! জেট ল্যাগে পড়লাম বোধ হয়। আসলে কিন্তু তা নয়। কারণ, এ ক্ষেত্রে তুমি এসেছ উত্তর থেকে দক্ষিণ। কিন্তু মাত্র পাঁচ ঘণ্টার ফ্লাইট যদি হয় যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব থেকে পশ্চিম উপকূলে, তবে সেটায় জেট ল্যাগ হবে। কারণ, যত পূর্ব দিকে যাওয়া যায়, ঘড়ির সময় তত এগিয়ে যাবে। আর যত পশ্চিমে যাওয়া হবে, ঘড়ির সময় তত পেছাবে। এ ক্ষেত্রে, আন্তর্জাতিক তারিখ রেখা পার হওয়াটা কিন্তু মুখ্য নয়। জেট ল্যাগ হিসাব করতে হবে কতটা টাইম জোন তুমি পার হচ্ছ, সেটা দিয়ে। দুইটা জায়গার মধ্যে সময়ের ব্যবধান যদি ১২ ঘণ্টার বেশি হয়, তাহলে জেট ল্যাগজনিত নানা উপসর্গের উৎপাতও বেশি হবে। তবে যেসব অসুবিধা হতে পারে, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ঘুম—অতিরিক্ত ঘুম ঘুম ভাব বা ঘুম না আসা অথবা একটানা ঘুম না হয়ে বারবার ঘুম ভেঙে যাওয়া। আর ঘুম ঠিকভাবে না হলে গা ম্যাজম্যাজ করা, মাথাব্যথা, খাবারে অরুচি, কাজে মনোযোগ কমে যাওয়া, ক্লান্তি, অবসাদ—এসব হতেই পারে। যদিও জেট ল্যাগ পুরাপুরি বন্ধ করা যাবে না। তবে নতুন পরিবেশের সঙ্গে শরীরকে মানিয়ে নেওয়ার কিছু উপায় বলে দিচ্ছি।

  • আগেই মানচিত্র দেখে নাও যে তুমি পূর্ব দিকে যাবে, নাকি পশ্চিম দিকে যাবে। কয়টা টাইম জোন অতিক্রম করতে হবে, সেটাও হিসাব করে নাও। অনলাইনেই জেট ল্যাগ ক্যালকুলেটর দিয়ে এসবের হিসাব-নিকাশ করতে পারবে। কোনো কোনো ওয়েবসাইট তো সুন্দর করে পরামর্শও লিখে দেয়। সে অনুযায়ী যেদিন ফ্লাইট, এর কয়েক দিন আগে থেকেই সময় আগিয়ে বা পিছিয়ে ঘুমানোর বা জেগে ওঠার অভ্যাস করা যায়। আর যদি তিন-চার দিনের জন্য বেড়াতে যাও আর সময়ের ব্যবধান যদি তিন-চার ঘণ্টা এদিক-ওদিক হয়, তবে বাড়ির রুটিন আর সময়সূচি মেনে ওই কয়েকটা দিন কাটিয়ে দেওয়াই ভালো।
  • জেট ল্যাগের প্রভাব কমাতে লাইট থেরাপি বেশ চমৎকার। ঘুমানো আর জেগে থাকা নিয়ন্ত্রণ করতে আলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। কখন উজ্জ্বল আলোতে যাবে আর কখন এড়িয়ে চলবে, সেটা বুঝে চলতে পারলেই হলো। ঘুমাতে হলে, বাইরে আলো থাকলেও ঘরের ভেতর পর্দা টেনে বা আই মাস্ক পরে অন্ধকার করে নাও। আর দিনের আলো না ফুটলেও ঘরে আলো জ্বেলে কৃত্রিম দিন বানিয়ে নিতে পারো।
  • প্রচুর পানি খেতে হবে। নতুন জায়গায় যাওয়ার আগে, ফ্লাইটের সময় ও সেখানে পৌঁছে। পানি শরীরকে সতেজ করবে, কিছুটা হলেও শরীরের ঝিমঝিম ভাব ও ক্লান্তি দূর করবে।

সবশেষে বলি, জেট ল্যাগ নিয়ে জটিলতার কিছু নেই। ঘুমের রুটিনে একটু না হয় তালগোল পাকল, তবু ঘুরে বেড়ানো আর ফুর্তিটাই আসল।

তথ্যসূত্রঃ টাইম